মোঘল আমলের ঐতিহ্য চকবাজারের ইফতার
২৫ মার্চ ২০২৩ ১৭:২৯
প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকার নাম শুনলেই সবার মনে আসে ভোজন রসিকতা। আর এখানে প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন খাবার পাওয়া যায়। আর এই খাবার খুবই মুখরোচক। পুরনো ঢাকার সব জায়গাতেই কম বেশি এরকম খাবার পাওয়া যায়, তবে কিছু কিছু এলাকা যেন খাবারের জন্যই পরিচিত। যেমন নাজিরা বাজার, ইসলামপুর, গেণ্ডারিয়া, নারিন্দা, চকবাজার, রায় সাহেব বাজার, লক্ষীবাজার, ধুপখোলা। তবে ইফতারের জন্য পরিচিত চকবাজার। আর চকবাজারে ইফতারের ঐতিহ্য মোঘল আমল থেকে হয়ে আসছে। প্রায় ৪০০ বছর আগে মুঘল শাসনামলে বুড়িগঙ্গার তীরে ছোট্ট করে গড়ে উঠেছিল এই চকবাজার। আর খুব অল্প সময়ে এখানে ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে ওঠে। মূলত সর্বপ্রথম ১৬০৪ সালে ঢাকা বাংলার রাজধানী হয়। তারপর থেকে পুরান ঢাকা উন্নত হতে শুরু করে। ঢাকার দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খাঁ ১৭০২ সালে চকবাজারকে একটি আধুনিক এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করেন।
মুঘল শাসনামল থেকেই মসলাদার বিভিন্ন খাবারের প্রচলন করা হয়। পুরান ঢাকার রাস্তার প্রতিটি গলিতে কাচ্চি বিরিয়ানি, মোঘলাই পরোটা, হালিম, বিভিন্ন পদের কাবাব, বোরহানি, মাংস ভুনা পাওয়া যায়। তবে চকবাজার সেই মসলাদার মোঘলাই খাবারের ঐতিহ্য বহন করে আসছে বছরের পর বছর। রমজান মাসে স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি দূর প্রান্তের মানুষ ছুটে আসে চকবাজারের ইফতার বাজারে। তেল, ঘি এবং অধিক মসলা ব্যবহার করে তৈরি করা করা হয় জালি কাবাব, আস্ত মুরগির এবং কোয়েলের রোস্ট, রুমালি রুটি, কবুতরের রোস্ট, খাসির গ্লাসি, বটি কাবাব, সুতি কাবাব, খাসির লেগ রোস্ট, দই বড়া, শাহী জিলাপি, বোম্বে জিলাপি, রেশমি জিলাপি, পনির সমুচা, মুরগি মসল্লম, টানা পরোটা, শাহী পরোটা, প্যাঁচ পরোটা, হালিম, শিক কাবাব, হাড়িয়ালি কাবাব, কোফতা কাবাব ইত্যাদি। আরও আছে কাচ্চি, তেহারি, দম বিরিয়ানি, কাবলি পোলাও, চাপ পোলাও, হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি, নবাবি বিরিয়ানি যেগুলোর কথা না বললেই নয়। তবে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ১ কেজি ওজনের শাহী জিলাপি। কথিত আছে চকবাজারের শাহী মসজিদের নাম অনুসারে অনেক খাবারের নামকরণ করা হয়।
মিষ্টি খাবারের মধ্যে আছে জাফরানি শরবত, কুলফি মালাই, লাচ্ছি, ফালুদা, লেবুর শরবত, পেস্তা বাদামের শরবত, মাঠা, লাবাং, তোকমা দানার শরবত, বেলের শরবত, গুড়ের শরবত, ফিরনি, দই, জর্দা, শাহী টুকরা, লাড্ডু, মনসুর, খাজালা (বোম্বে কনফেকশনারি এবং আলাউদ্দিন সুইট মিট অথবা চকবাজার শাহী মসজিদ সংলগ্ন এলাকা), ঘুগনি আর বুট। তবে লক্ষীবাজার, রায় সাহেব বাজারের বিউটি লাচ্ছি অধিক জনপ্রিয়। এছাড়া নাম না জানা অনেক আইটেম। কিন্তু চকবাজারের সবচেয়ে আকর্ষণ হল বড় বাপের পোলায় খায়। নামটা অদ্ভুত শোনালেও এই খাবারটি খেতে খুবই মজা। চকবাজারের সর্বত্রই এই খাবারের দেখা মিলবে কিন্তু স্থানীয়দের মতে হাজী শহীদ বাবুর্চি ই এই খাবারের সর্বাধিক পরিচিত কারিগর। তার মতে, এটি পুরান ঢাকার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী খাবার যেটি বানানো হয় ৩৬ রকমের উপকরন আর ১৮ পদের মশলা দিয়ে, যা নাকি খুব সহজেই রোজাদারদের সারা দিনের খাবারের পুষ্টি যুগিয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের কাবাব ক্রেতাদের মন ভালো করে দেয়। এর মধ্যে মুরগী, কবুতর, কোয়েল পাখি, খাসি, গরু মাংসের কাবাব উল্লেখযোগ্য। ঢাকার ঘিঞ্জি গলির ভিতরেই লুকিয়ে আছে শত বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ অনেক পদের খাবার।
শুধু চকবাজারই নয়, পুরান ঢাকার অলিগলি ঘুরে দেখলে দেখা মিলবে হাজার খানেক খাবারের দোকান, যেগুলোতে রমজান মাসে বিশেষ খাবারের পসরা দেখা মিলে। বিভিন্ন স্বনামধন্য খাবারের দোকানগুলোর তুলনায় স্থানীয় দোকান গুলোতে খুবই কম দামে খাবার গুলো বিক্রি করা হয়ে থাকে। রমজান মাস ছাড়াও পুরান ঢাকার খাবারের দোকানগুলোতে মানুষের ভিড় বারো মাসই লেগে থাকে। অনেক স্থানীয় ব্যবসায়ী আছে যারা তাদের পূর্বপুরুষদের এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ ২ বছর সংকীর্ণ হলেও এই বছর নতুন রুপ ফিরে পেয়েছে। আর এ যেন একটা উৎসবে মেতে ওঠে। এখানে মুসলমানদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের মানুষও আসে। সর্বোপরি, পুরান ঢাকার চকবাজার মোঘল আমলের ঐতিহ্য বহন করে আসছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই