দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুল থেকে
৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৪৫
এখানে প্রকৃতির নিয়মে ভোর হয়, সন্ধ্যা হয়, নেমে আসে রাত। দিনরাত্রি বিরামহীন চলমান থাকে পড়াশোনা। বাইরের জগত থেকে আমরা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন থাকি। প্রায় চার বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত করলাম দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুলে। স্মৃতি ভীষণ তাড়া করে বেড়ায় পরদেশের এই অচেনা ভূবনে। বর্তমানে আমি জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী; আমি কিছুটা স্বাধীনতা পেলেও স্কুল আমাকে নেতৃত্বস্থানীয় জায়গা দিলেও বলব আমি অনেকটা পরাধীন। এই বয়সে এসে যখন আমরা একটু প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে, সমস্ত আনন্দ নিজেদের করে নিতে চাই, সেখানে আমরা কঠোর নিয়মশৃঙ্খলায় বন্দী। পুরো পৃথিবী একদিকে আমরা আরেকদিকে। হ্যাঁ, জানি আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই এত নিয়মকানুন।
সারা সপ্তাহে আমি অধীর আগ্রহে বসে থাকি কখন সেই ছোট্টো এনালগ মোবাইলে একটু মা-বাবার কন্ঠ শুনতে পারবো। সেই দিনটা হলো ‘শনিবার’। পুরো সপ্তাহের মধ্যে শনিবার দিনটি আমার জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের। ওই দিনটাতে নিজেকে নিজের বাড়ির মধ্যে মনে হয়, যেন চলে আসি মাতৃভূমির খুব কাছাকাছি। মা-বাবার কন্ঠ শুনলেই মনে হয় যেন খুব কাছ থেকে আমাকে আদর-স্নেহ করছে। আধাঘন্টা প্রত্যেকে সময় পায় মোবাইলে কথা বলার জন্য। আধাঘন্টা পর যখন মোবাইলে কথা বলা শেষ করে শিক্ষকের নিকট জমা দিই, পৃথিবীর সমস্ত দু:খ যেন আমাকে পরাজিত করছে। চোখের কোণে কোন মায়ায় অশ্রু এসে ভিড়ে তার ব্যাখ্যা নেই।
এখানে কাউকে মন খুলে কিছু বলার উপায় নেই। সবাই সময়ের সাথে সাথে বিরামহীন ছুটতে থাকে। নিজেকে ভীষণ প্রাণহীন মনে হয়। তারপরও আমার কলম থেমে থাকে না। এতদূর থেকে পড়তে এসছি; তখন আপন মনে পড়তে থাকি।
সময়ে সময়ে ক্লাস, ক্লাসের অনুশীলন অব্যাহত থাকে পাশাপাশি হাজারো দায়িত্ব। আমি সময়কে সঙ্গী করে বিরামহীন ছুটতে থাকি। তবে কোথাও যেন মস্তিষ্কের সাথে আমার একটা তীব্র স্নায়ুযুদ্ধ সংঘটিত হয়, তা হলো আবেগ। কারণ দিনশেষে সবকিছু সফলভাবে পরিসমাপ্তি করতে পারলেও একটি জায়গায় নিজেকে হারাতে হয় তা হলো মা-বাবার সাথে একটু দেখা করা, তাদের একটু স্পর্শ পাওয়া। সে ক্ষেত্রে দুরত্ব সবচেয়ে বড় বাঁধা। তবে আমার প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা আমাকে আরও আবেগের বন্যায় ভাসায়।
আজ নিজেকে নিয়ে ভেবে অবাক হই বোর্ডিং স্কুলে আসার আগে মা-বাবাকে ছাড়া কোথাও থাকতে পারতাম না, বাসায়ও একা থাকতে ভালো লাগতো না। কিন্তু এখানে পরিবেশ আমাকে শিখিয়ে ও বুঝিয়ে দিয়েছে এখানে দিনশেষে তুমি যখন নিদ্রামগ্ন হবে তখন তোমার সঙ্গী হবে কেবল প্রাণহীন এক বিছানা ও কোলবালিশ। কত ছোট-ছোট কোমল শিশুর বালিশ ভিজে যায় তাদের অশ্রুজলে। তারা শুধু মা-বাবার জন্যই এভাবে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে, সমস্ত ক্লান্তি ও দু:খ নিয়ে। এই পরিবেশে আমার অত চাহিদাও থাকে না। আমি একদিকে খুব ভাগ্যবান সাধারণ বোর্ডিং স্কুলে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে যে একটা দুরত্ব থাকে; শাসন ও নিয়মকে কেন্দ্র করে আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। কারণ আমি সবসময় আপ্রাণ চেষ্টা করি সময়ের আগেই শিক্ষকদের দেওয়া কাজগুলো সম্পাদন করে রাখার। শিক্ষকদের শাসনের থেকেও বেশি ভালোবাসা ও স্নেহ পাই। তারপরও দিনশেষে মাতৃভূমির যে গন্ধ, মায়ের আচলের পরশ, বাবার স্নেহ এবং সকল প্রিয়জনদের ভালোবাসা ভীষণ কাঁদায়, সেই কোমল অনুভূতিতে দিনশেষে আমি পরাজয় মেনে নিই।
পরিশেষে এই বলে শেষ করি-
“মন যখন অব্যক্ত বেদনায় বেদনার্ত
অবিরত অশ্রু শুধু হয় বিনির্গত। “
সারাবাংলা/এজেডএস