আঁরার ঐতিহ্য আঁরার বলীখেলা
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:০৭
“ওভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান ওভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান,
দইজজার কূলত বসত গরি শিনাদি ঠেগাই ঝড় তুয়ান”
মেজ্জান, বলীখেলা, সাম্পান, শুটকি, বেলা বিস্কুটের কথা উঠলে কোন কথা নেই আঁরা চাটগাঁইয়া। এই শব্দগুলো এখন শুধু ঐতিহ্য বহন করে না চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাস লোকজ সাংস্কৃতির অংশও বটে। বলীখেলার নাম শুনে ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই। বলীখেলা হচ্ছে এক ধরনের কুস্তি খেলার মতো যে খেলায় নির্মল আনন্দ উপভোগ করা যায়। মেলাপর্বন লোকসাহিত্যর ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশে বলীখেলা শুধু মাত্র চাটগাঁইয়াদের। ‘বলীখেলা’ শব্দটা আমাদের। চট্টগ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতি সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ উপভোগ করে। কথায় আছে, “চাটগাঁইয়া পোয়া মেডিত পইড়লে লোআ” চাটগাঁইয়া নওজোয়ানরা শৌর্যবীর্যের অধিকারী সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলীখেলা বললে চট্টগ্রামের মানুষ আনন্দে ভাসে। বলীখেলা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা। বলী শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- শক্তি বা পরাক্রমশালী লোক, বীরপুরুষ,শক্তিশালী। অর্থ শুনে বুঝা যায়, বলীখেলা মানে শক্তিশালীর মল্ল¬যুদ্ধ বা কুস্তি প্রতিযোগিতা। বলীখেলা চট্টগ্রামের লোক সংস্কৃতির অংশ। চাঁটগার মল্ল নামে খ্যাত বহু আদিকালের হিন্দু মুসলিম পরিবারে দেখা যায়। মল্ল শব্দের অর্থ কুস্তিগির, বলী হলো খালি হাতে কুস্তি ধরা।
বলীখেলার ইতিকথা
গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর মতে, “চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস বিখ্যাত। এসব পরিবারের প্রায় সবকটিই পটিয়া থানায় অবস্থিত। যেমন: পটিয়া আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরির চিকন মল্ল, জিরির ইদ ও নওয়াব মল্ল, পারিগ্রামের হরি মল্ল, হাইদগাঁও এর অলি মল্ল, পেরালার নানু মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, গোরাহিত মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল, শোভদ-ির তোরপাচ মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, গৈড়লার ছুয়ান মল্ল । এ মল্ল হলো বলী বা কুস্তিগীর। যাঁরা কুস্তি বা বলী ধরে তাঁদেরকে মল্ল বলা হয়।”
ব্রিটিশ আমল থেকে বলীখেলার আয়োজন হয়ে আসছে। চাটগাঁইয়া বয়োজৈষ্ঠ্যদের মুখে শুনা যায় চাটগাঁ হলো মল্ল/ কুস্তিগীর/ বলীর শহর। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় মল্ল পরিবার বসবাস করত। ধারনা করা হয় চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে বলী খেলার প্রচলন শুরু হয়। ভারতবর্ষের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতান পরবর্তীতে ব্রিট্রিশ শাসন শুরু হয়। ব্রিট্রিশবিরোধী আন্দোলনকে চাঙ্গাকরার জন্য যুব সমাজকে শক্তিমত্তা প্রদর্শন সহ তাঁদের ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করতে সে সময় বিত্তবানেরা মাইকিং করে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলিখেলার আয়োজন করতেন। সুনাম ও খ্যাতি অর্জনের জন্য অনেকে এ খেলার আয়োজন করতেন যা আজ আর কারো বলীখেলা অজানা নয়।
পটিয়ার চরকানাই ও বাজি পুইজ্যার পটিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ বলিখেলা। সত্তরের দশকে এ বলীখেলার ও মেলা বন্ধ হয়ে যায়। এর অপর নাম সফর আলী মুন্সীর বলিখেলা। যেদিন বলিখেলা হতো সেদিন খেলা শেষে নানাপ্রকারের বাজি পোড়ানো বা ফোটানো হতো এজন্য এটি বাজপ্ইুজ্যার বলিখেলা নামেও পরিচিত ছিল।
বলিখেলার উদ্ভবের ইতিকথা সম্পর্কিত বিবরণে কবি আলাদীন আলীনূর লিখেছেন, “কবি কালীদাসের জন্মভূমি পশ্চিম মালব অর্থাৎ পটিয়ার মালিয়ারা থেকে এবং কবি আফজাল আলীর জন্মভূমি পূর্ব মল্লর অর্থাৎ সাতকানিয়ার মল্ল বা মিলুয়া থেকে সর্বপ্রথম মল্লক্রীড়ার অনুষঙ্গী হিসেবে বলিখেলার উদ্ভব হয় এবং তা সমগ্র চট্টগ্রামে জনপ্রিয়তা লাভ করে।”
আদিকালথেকে পটিয়ায় তুফায়েল আলী মুন্সীর বলীখেলার ও টেগর পুনির বলীখেলার বেশ সুখ্যাতি ছিল। বৈশাখ মাসে এ খেলার আয়োজন করা হতো। পটিয়ায় সর্বপ্রথম খেলার আয়োজন করেন, পটিয়া পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের (পাইকপাড়া) পরীর দিঘি এলাকার প্রয়াত তুফায়েল আলী মুন্সী। পরীর দিঘির দক্ষিণ পাড়ে তোফায়েল আলী মুন্সীর খেলা নামেও একসময় বলীখেলার প্রচলন ছিল। পরবর্তীতে পরীর দিঘির খেলা নামে যা পরিচিতি লাভ করে। পাকিস্তান আমলে পরীর দিঘির বলিখেলা বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে চল্লিশের দশকের দিকে তাঁর ছেলে পটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মনির আহমেদ বলীখেলার আয়োজন করতেন।
পরবর্তীতে পঞ্চাশের দশকের দিকে পটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান প্রয়াত আমজু মিয়া সওদাগর এ খেলা নিজ নামে প্রবর্তন করেন। ফলে পটিয়ায় “ আমজুর বলীখেলা” নামে প্রচলন হয়। আমজু মিয়া সওদাগর মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলে আবু মুছা সওদাগর এ খেলার আয়োজন করতেন। বর্তমানে আমজু মিয়া সওদাগরের উত্তরসূরি এ খেলার আয়োজন করেন। আমজু মিয়া সওদাগরের চাচাতো ভাই হাজি আবুল বশর (৭৩) জানান, “১৯৫৫ সাল থেকে আমজু মিয়ার বলিখেলা উপভোগ করে আসছি তবে তাঁর পূর্বে বলিখেলার প্রচলন শুরু হয় পটিয়ায়। সর্বশেষ পটিয়ায় ২০১৮ সালে আমজু মিয়ার ১১৫তম বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়।
এখন বলীখেলা বললে, সমগ্র দেশে ব্যাপক পরিচিত ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, লালদিঘীর মাঠের “জব্বারের বলীখেলা” । চাটগাঁ নগরীতে ১৯০৯ সালের ২৬ এপ্রিল বকশিহাটের বদরপাতি এলাকার গোলাম রসুল সওদাগরের পুত্র আবদুল জব্বার সওদাগর ছিলেন কংগ্রেসী ও স্বদেশী আন্দোলনের সংগঠক। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তরুণসমাজকে শারীরিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে বলীখেলার আয়োজন করেন। তারই ধাবাহিকতায় জব্বারের বলীখেলা নিয়মিত আয়োজন হয় চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে। কোভিড-১৯ এর কারণে গত দুবছর বন্ধ থাকলেও ২০২২ ইং মে মাসে ঐতিহাসিক লালদীঘির মাঠে ১১৩তম জব্বারের বলীখেলা সম্পন্ন হয়। জব্বারের বলীখেলার সমগ্র বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিত লাভ করে। বর্তমানে বলীখেলা বললে জব্বারের বলীখেলা সবার মুখে মুখে।
বলীখেলা প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক ইতিহাসবিদ শামসুল হোসাইনের মতে, “ চট্টগ্রামে ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে বলীখেলার প্রচলন ছিল। সুলতানী আমল থেকে সেনাবাহনিীর প্রয়োজনে কুস্তির চর্চা হতো চট্টগ্রামে। তখন চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেনারা ছিলেন মূলত পাদতিক। তাই কুস্তির মধ্য দিয়ে শারীরিক সামর্থ ধরে রাখার প্রয়োজন ছিল তাদের। এরপর মল্ল সম্প্রদাযলে মানুষজন গ্রামে গ্রামে বৈশাখ মাসে বলীখেলার আয়োজন করতেন।পরবর্তীতে ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার পরে চট্টগ্রামে যেটা চালূ করেন, তার সঙ্গে গভীর রাজনৈতিক যোগ ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মুসলিম সম্প্রদায়ের তরুণদের টানতেই তিনি বলীখেলা চালু করেন”।
বলীখেলা নিয়ে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক আবদুল আলিম বলেন, “যে খেলায় নির্মল আনন্দ আছে যে খেলায় সর্বস্তরের মানুষ নির্মল আনন্দ খুঁজে পায় সেটার নামই বলীখেলা। ১৯৬৯-৭০ সালের কথা, ছেলেবেলায় নির্মল আনন্দ খুঁজে পেতাম আমজু মিয়ার বলীখেলায়। প্রতিক্ষায় থাকতাম কখন বৈশাখ মাস আসবে কখন বলীখেলা শুরু হবে। বলীখেলার চেয়েও বেশি আনন্দপেতাম মেলায়। ঢোলের তালে তালে শুরু হতো বলীখেলা। খেলার মাঠের চারিদিকে হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে বসে বলীখেলা উপভোগ করত। বাশীর আওয়াজ উপচেপড়া মানুষের ভীড় চিৎকার চেচাঁমেছি সন্ধ্যায় আঁতাশ বাজীর উৎসব আহা কি নির্মল আনন্দ উপভোগ করতাম। কালের বিবর্তনে সেটা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে”।
লেখক ও গবেষক ইতিহাসের খসড়ার সম্পাদক মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, “১৯৭০ সালের পূর্ব থেকে পটিয়ায় বলীখেলার প্রচলন ছিল। তুফান আলী মুন্সির বলীখেলা, পরীরদিঘির বলীখেলা, ভাটিখাইনের বারেক চেয়ারম্যানের বলীখেলাসহ আরও বেশ কয়েকটি বলীখেলার বিলুপ্ত হয়েগেছে। সত্তরের দশকে পটিয়ায় বলীখেলার আয়োজন করে আসছে “আমজু মিয়া” সওদগারের পরিবার। পটিয়ায় আমজু মিয়ার বলীখেলা নামে ব্যাপক পরিচিত। আমজু মিয়ার বলীখেলায় বহুদুরদুরান্ত থেকে লোকজন উপভোগ করতে আসত। সেসময় গ্রামের মানুষের বিনোধনের দারুণ উৎসহ ছিল বলীখেলা। ছোটবেলায় বলীখেলার চেয়েও বেশি উপভো করতাম লোকজ শিল্পের মেলা । মেলা থেকে বাহারী রঙের খেলনা , আসবাবপত্র কিনে নিয়ে যেতাম। মেলায় প্রত্যেন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ আসত বলীখেলা দেখতে। বলীখেলা অনেকটা মানুষের মিলনামেলায় পরিণত হতো, মানুষের মধ্যে একটা হৃদ্যিক সেতুবন্ধন রচনা হতো। এটা ছিল অনেকটা নির্মল বিনোধনের মতো। এখন নির্মল বিনোধন নেই ”।
১৯৫৫ সালে জন্ম আবদুল জব্বার সওদাগরের ছেলের ঘরের নাতী শওকত আনোয়ার বলেন, “আমার দাদা জব্বার সওদাগর মারা যাওয়ার পর জব্বারের বলীখেলা দায়িত্ব নেন আমার বাবা । বলীখেলা এতটা প্রসারিত ছিল না । লালদিঘী এলাকার বলীদের জন্য আয়োজন করতেন, ঢোলের তালে তালে বলীরা আসত আমরা তখন ইশকুল বেলায় পড়ি আমরাও তাদের পিছু পিছু ঘুরতাম। বাবার মুখে শুনেছি বলীখেলা প্রচল হওয়ার পর বলীরা মাস দুয়েক আগে থেকে এসে আমাদে বাড়ির একটা বৈঠকখানা ছিল সেখানে তারা থাকতেন। খাওয়া ধাওয়া করতেন, বলীখেলার অনুশীলন ও শারীরিক কসরত ও প্রস্তুতি নিতেন। বাবার মৃতুর পর ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি আরও বলীখেলার সাথে জড়িয়ে গেছেন। সত্তরের দশক থেকে বিভিন্ন জেলা থেকে কুস্তিগীররা জব্বারের বলীখেলায় আসতে শুরু করেন। জব্বারের বলীখেলা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হওয়ার পর সমগ্র দেশের মানুষ জানতে পারে জব্বারের বলীখেলার সম্পর্কে।
বলীখেলার দাওয়াত ঘোষণা কিভাবে হতো
আগেকার দিনে বলীখেলা দিনতারিখ ঠিক হলে হাটবাজারে ঢোল পিটিয়ে লোকজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হতো। কেউ কেউ কেরোসিনের টিন/চামড়ার ঢোল পিটিয়ে গ্রামেগঞ্জে বলিখেলার দাওয়াত করত। মাইকের মাধ্যেমে মানুষদের বলীখেলা উপভোগ করার জন্য সবিনয় দৃষ্টি আকর্ষণ করত।বলীখেলা যেদিন শুরু হবে ঢোল ব্য-পার্টি বা আনসার বাজা পার্টির বাদ্যের আওয়াজে মুখরিত থাকত শহর। বর্তমান সময়ে কার্ড ও ক্ষুদে বার্তা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্টিং মিডিয়ায় ঘোষণা দেয়া হয় যে, জব্বারের বলী খেলাশুরু হতে যাচ্ছে । ভেন্যু, সময় এবং উদ্ভোধক ও অতিথি, আয়োজকদের নামও ঘোষণা করা হয়।
বলীখেলা কোথায় বেশি আয়োজন হয়ে আসছে
সমগ্র বাংলাদেশে বলীখেলাকে সবচেয়ে বেশি পরিচিত করেছে চট্টগ্রাম নগরীর লালদিঘীর মাঠের “জব্বারের বলীখেলা” এছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার উল্লেখযোগ্য রয়েছে, পটিয়া তোফায়েল আলী মুন্সীর বলীখেলা, পরীর দিঘীর বলীখেলা, আমজু মিয়ার বলীখেলা, ভাটিখাইনের বারেক চেয়ারম্যানের বলীখেলা, সিআরবির শিরিষতলার শাহাব উদ্দিনের বলীখেলা, হাটহাজারীর ফতেপুরের বলীখেলা, মাদার্শার বলী নোয়াপাড়ার বলীখেলা, নোয়াপাড়ার বলীখেলা, নাজির হাটের বলীখেলা, বড়তাকিয়ার বলীখেলা,ভুজপুরের বলীখেলা, করের হাটের বলীখেলা, ছালিমপুরের বলীখেলা, নদীমপুরের বলীখেলা, চুয়ারখাঁর বলীখেলা, ফটিকছীড়র বলীখেলা, বেতাগীর বলীখেলা, রাণীরহাটের বলীখেলা, সাতকানিয়ার বলীখেলা, রামুর বলীখেলা, কক্সবাজারের বলীখেলা।
বলীখেলা বা কুস্তিখেলার পদ্ধতি ও পুরষ্কার
প্রাচীনকাল থেকে বলীখেলারর কিছু নিয়ম আইন ছিল, বলীদের উভয় খালি হাতে হাফপেন্ট বা নেংটি পড়ে কুস্তি বা বলী ধরতে হবে। হাতের আঙ্গুলে কোন ধাতব বস্তু কিংবা আংটি শিকল থাকতে পারবে না। বলীদের হাতে মাঠি বা বালি মারতে পারবে না। পেটে চোখে মাথায় বুকে কানে আঘাত করা যাবে না। ঘুষি ,লাথি দেয়া যাবে না। চুল বা কানে ধরে আঘাত করা যাবে না। হাতে পায়ে হাটুর উপর নিচের দিকে প্যাঁচ দিতেপারবে কৌশলে । তবে শারীরিক আঘাত হয় এমন কোন প্যাঁচ বা কৌশল করা যাবে না। বলী শুরু হওয়ার আগে দুই বলী নাচানাচি করতে পাররবে তবে দিগম্বর হওয়া যাবে না। শরীরে কোন তৈলাক্ত পদার্থ বা ঘি চর্বি তৈল ব্যবহার করা যাবে না। হাতে নখ ছোট থাকতে হবে। দুই বলী ব দুই কুস্তিগীর বলী ধরার পূর্বে সালাম ও কুশল বিনিময় করে আনন্দের সাহিত বলীখেলঅ শুরু করবে। পিঁপ পি করে রেফারীর বাঁশি ঢোলের বাদ্যযন্ত্রে তালে তালে শুরু হবে বলী খেলা। দুজনের মধ্যে কৌশল শক্তিপরীক্ষার খেলা চলতে থাকে বেশ কয়েক মিনিটধরে সাধারনত ১৫ থেকে ২০ কিংবা ২৬ মিনিট পর্যন্ত চলতে থাকে লড়াই। কৌশলে হাত- পায়ের পেঁচ বা কসরত আর বাহুবলীরা শক্তি দিয়ে অপরজনকে মাটিতে ফেলে পিঠ ঠেকাতে পারলেই জিতে যান একজন বলী। নিয়ম ভঙ্গ করে যদি কেউ কাউকে আঘাত করে তখন ফাউল হয় । আগেকার দিনে কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে তাকে শাস্তি স্বরূপ বেত্রাঘাত ও জরিমানা করা হত। বিজয়ীদেরকে বলীখেলায় চ্যাম্পিয়ানদেরকে সোনা রূপার মেডেল, ট্রফি সাথে নগদ টাকা প্রদান করা হয় আবার আগেরকার দিনে গ্রামে গঞ্জের বলীখেলায় নগদ টাকা , টেলিভীশন ও দামী জিনিসপত্র পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হয়ে থাকে।
হাত-পায়রে প্যাঁচ বা কসরত আর শক্তি দিয়ে অপরজনকে মাটিতে ফেলে পিঠ ঠোকতে পারলেই জিতে যান একজন বলী।
বিখ্যাত বলীদের নামের তালিকা
দক্ষিন চট্টগ্রামের পরাণ সিকদার বলী, নাজির বলী, ঠেকর মুনশীর বলী, তুফান বলী, আলী মুন্সী বলী, আহাদ বলী, গইন্যা বলী, মীরা বলী, রহমান বলী, করিম বলী, রফিক বলী, গুন্নু বলী।
চাটগাঁ শহরের বিশেষ করে উত্তর চট্টগ্রামের বিখ্যাত বলীদের উল্লেখযোগ্য নামের তালিকায় আছে- অলী বলী, টুইখ্যা বলী, বাদশা বলী, হামজা বলী, হামিদা বলী, লালমিয়া বলী, দুইধ্যা বলী, এয়াকুব বলী, সুলতান বলী, ওয়ালী বলী, বাদশা বলী, ইউছুপ বলী, খাজা বলী, লেদুবলী, তজু বলী, আবুল্যা বলী, আবদুল হাকিম বলী, জালাল বলী, নুরা বলী, বজল বলী, হামদু বলী, আবদুল গফুর বলী, চুন্নু বলী, এজাহার আলী বলী, সোনা মিয়া বলী, সুলতান বলী, আশিক্য বলী, জেবল বলী, শ্রীম- বলী, অনিক্যবলী, মতি মাষ্টার বলী, উল্লেখ এজাহার বলী, নাজিমবলী, কালু বলী,অলী বলী, টেকনাফের আলম বলী, কুমিল্লার সোহারাব বলী।
সাম্প্রতিকসময়ে জব্বারের বলীখেলায় বিভিন্ন সময়ে চ্যাম্পিয়ান রানার্স আপ বলীদের মধ্যে রয়েছে,মালেক বলী, কক্সবাজার জেলার রামুর দিদার বলী , চকরিয়ার তারেকুল ইসলাম প্রকাশ জীবন বলী গত ২০২২ সালে বলীখেলায় কুমিল্লার শাহাজালাল বলীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ান হয় । মমিন বলী, সৃজন চাকমা বলী।
বলীখেলা ও লোকজ শিল্পের সমাহার ও বৈশাখী মেলা
মহাত্মা গান্ধী চট্টগ্রাম পরিদর্শনে এসে একদা বলেছিলেন, “ চট্টগ্রাম সর্বত্রে এগিয়ে”। কথাটি এমনি বলেননি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার আন্দোলন এবং স্বাধীনতার ঘোষণাও হয় কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে। তাছাড়া আমদের রয়েছে সৃষিটকর্তার অপরূপ তুলিতে আঁকা ছবির মতো, প্রকৃতির সৌন্দর্যরাণী পাহাড় পর্বত, নদী, সমুদ্র, উপত্যকা, নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি, কালচার বিশেষ করে বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লোকজ শিল্পের মেলা বসে। বৈশাখ মাসে হয় বিধায় অনেকে বৈশাখী মেলাও বলে। মেলা কিন্তু বলীখেলার ভাবমূর্তি ও গাম্ভির্যতা আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে । জব্বারের বলীখেলা বা বিভিন্ন উপজেলায় বলীখেলাকে কেন্দ্র করে মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় । বলীখেলাকে ভিত্তি করে লোকজ শিল্পের ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রসারও লাভ করেছে। দেশের প্রত্যেন্ত অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা চারু শিল্প কারু শিল্প, মৃৎ শিল্প সামগ্রী নিয়ে মেলায় স্টল দেয় কেউ কেউ রাস্তায় প্রসরা সাজিয়ে বসে। বিকিকিনি সদাইপাতিও বেশ ভালো হয়। ঘরকন্নার জিনিসপত্র বিশেষ করে রন্ধন শিল্পীদের রসুই ঘরে ব্যবহৃত জিনিসপত্র মেলায় উঠে। মাটির হাঁড়ি পাতিল, ফুলের টব, মুর্তি, সানকি, মালশা, বাঁশের ও বেতের তৈরী চালইন, বিচইন, কুলা, ঢালা, ঢোলা, ঝুড়ি, উইজ্যা, লোহার তৈরী দা, বটি কোদাল, ধামা, ছুরি, খুন্তি, হামান দিস্তা, তাওয়া, গৃহসজ্জার আসবাবপত্র, সাজসজ্জা, কারুপণ্য, মাদু, শীতলপাটি, তালপাতার পাখা, পাটের তৈরী জিনিসপত্র, নকশী কাঁতা, গাছের চারা, ফুলদানি, নানা রকমের খেলনা মুরালী বাঁশি। খাবারের স্টল, পিঠা পুলি, মোয়া, গজা, খই, সবাই পাওয়া যায়। বলীখেলা ও মেলা শুরু হলে, আনন্দকিল্লা, নন্দনকানন, লালদীঘির মাঠ থেকে কোতোয়ালি , চেরাগী পাহাড় ডিসিহিলের আশেপাশে যানবাহন চলাচল অনেকটা বন্ধ থাকে। মানুষের ভীর ব্যবসায়ী ও ফুটপাতের হকারদেও চেঁচামেচি ও হাঁকডাকে একটা উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আনন্দমুখর তাঁকে মেলার পরিবেশ। মানুষ বলীখেলা ও বৈশাখীমেলায় নির্মল আনন্দ ফেরী করে বেড়াই।
বলীখেলা আমাদের চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের খেলা। বলীখেলা আমাদের শেকড়ের খেলা ও বিনোদনের উৎসহবটে। দেশের মানুষ জানে এটা চট্টগ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতি। কালের বিবর্তনে আকাশ-সংস্কৃতি এবং ডিজিটালের জাঁতাকলে বলীখেলা যেন হারিয়ে না যায়। ঢাকঢোল পিটিয়ে আতশবাজি উৎসবে বলীখেলার আনন্দ ঝর্ণাধারা ছড়িয়ে পড়–ক সমগ্র দেশের মানুষের হৃদয়ে। নাগরদোলা, বাঁশি, টমটম গাড়ির শব্দ, লোকজ শিল্পের প্রাণের মেলা অনন্তকাল বেঁচে থাকুক গ্রাম বাংলায়। আঁরার ঐতিহ্য আঁরার বলীখেলা।
তথ্যসূত্র: বন্দর শহর চট্টগ্রাম, গবেষক আবদুল হক চৌধুরী, প্রফেসর আবদুল আলিম, গবেষক শামসুল হক, সম্পাদক ইতিহাসের খসড়া, চট্টগ্রামের বলীখেলা, আবুল হাশেম ও জব্বার সওদাগার ও আমজু মিয়ার পরিবারবর্গ।
লেখক: লেখক ও প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই