Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলা নববর্ষে ঐতিহ্যের ধারক কটিয়াদীর গাছতলার পূজা

সুমিত বণিক
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:১৩

কিশোরগঞ্জ জেলার মধ্যে কটিয়াদী উপজেলা একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদের নাম। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই উপজেলার নাম নানাভাবে আলোচিত। এই জনপদেই কটিয়াদী উপজেলা সদরের পশ্চিমপাড়াস্থ শ্রী শ্রী মহামায়া গাছতলার বেদীটি অত্র এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক ধর্মীয় পবিত্র স্থান হিসেবেই সুপরিচিত। সর্বোপরি অত্র এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ নানা মানুষের কাছে এই স্থানটি ঐতিহ্যবাহী পূণ্যস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে সাধারণত ধর্মীয় যে কোন স্থানের ঐতিহ্য বা গুরুত্বের পেছনে একটা আধ্যাত্বিক বা অলৌকিক ইতিহাস লুকানো থাকে। এই স্থানটি নিয়েও এমন অনেক অলৌকিক ও আধ্যাত্বিক ঘটনার কথা লোক মুখে শোনা যায়। তবে এলাকার প্রবীণদের মতে, এই মহামায়া গাছতলাটির বয়স প্রায় দুইশত বছরেরও অধিক।

বিজ্ঞাপন

তবে এই স্থানের ইতিহাস নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য ভিত্তিক লিখিত প্রকাশনা বা গবেষণা না খুঁজে পেলেও, এটি এখন শ্রীশ্রী মা মহামায়া মায়ের পূজার সর্বজনীন অনুষ্ঠান স্থল হিসেবেই পরিগণিত হয়ে আসছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস মতে, এই বৃক্ষের মাঝে আদ্যাশক্তি শ্রী শ্রী মা মহামায়া অধিষ্ঠিত আছেন। সেই ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভক্তি থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ এখানে প্রতি বছরের ১লা বৈশাখে (পঞ্জিকা মতে) শ্রীশ্রী মা মহামায়ার পূজা, ও প্রাণী বলিদান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পূজা উপলক্ষ্যে গাছতলার বেদীকে ঘিরে নানা পণ্যের পসরা নিয়ে মেলা বসে।

সর্বোপরি সারা বছরই নানা আয়োজনে ও ধর্মীয় উপাচারে মহামায়া মায়ের পূজা অনুষ্ঠিত হলেও, বাংলা নববর্ষে যেন এক অপূর্ব নতুন সাজে সজ্জিত হয় শ্রী শ্রী মহামায়া গাছতলা। নানা রংঙের নতুন অসংখ্য শাড়ী দিয়ে আচ্ছাদিত থাকে শ্র্রী শ্রী মহামায়া গাছতলার ঐতিহাসিক বটবৃক্ষটি। এই অনুষ্ঠানটি এই এলাকায় সর্ববৃহৎ আকারে উদযাপিত হয়। এ পূজা উপলক্ষ্যে এলাকায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। নানা রংয়ের ও বিভিন্ন ধরণের জিনিসের পসরা নিয়ে মেলা বসে। এলাকার ছোট বড় অসংখ্য মানুষ নতুন কাপড় পরিধান করে পূজা দর্শন করতে যায়। এলাকার অনেকের কাছেই করোনাকালে এই বেদীতে মা মহামায়ার পূজার স্মৃতিগুলো বড্ড অপ্রত্যাশিত। কারণ অনেকেই এই একটি দিনের আশায় সারা বছর অপেক্ষার প্রহর গুণেও পূজো দেখতে যেতে পারেন নি । কারণ বিগত করোনাকালে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে আয়োজকদের পক্ষ থেকে বর্ণাঢ্য প্রস্তুতি থাকলেও করোনার সময় অদৃশ্য ভাইরাসের সংক্রমণরোধে সরকার কর্তৃক আরোপিত কঠোর স্বাস্থ্যবিধি ও ঘোষিত লকডাউনের কারণে শ্রী শ্রী মা মহামায়া গাছতলা প্রাঙ্গণে ছিলো কঠিন নীরবতা। পূজা উপলক্ষ্যে মেলা ও নানা জিনিসের পসরা বসেনি বলে, ছোট-বড় অনেকেরই মন ছিলো মলিন।

বিজ্ঞাপন

মেলা প্রাঙ্গণেই শুধু এ মেলার বিস্তার নয়। মেলা উপলক্ষে অনেকেই এলাকার জামাই আর আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ জানায়। তাই বাড়িতে বাড়িতে খই, মুড়কি, নারকেল আর দুধের নাড়ু বানানো হয়। মেলা থেকে নানা জিনিস কিনে নেওয়া বা খাওয়ার রেওয়াজটিও এখনো ধরে রেখেছেন নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষেরা। স্থানীয় অনেকেই বিয়ের পর নববধূকে বাড়িতে নিয়ে উঠার আগে শ্রীশ্রী মা মহামায়া বেদীকে কে প্রণাম করে তারপর নববধূকে নিয়ে বাড়িতে উঠেন। অনেক ক্ষেত্রে ছোট শিশুদের অন্নপ্রাশনের (শিশুর মুখে প্রথম অন্ন স্পর্শ করানোর সামাজিক অনুষ্ঠান) আনুষ্ঠানিকতাও এই বেদী তলায় হয়ে থাকে। অমাবস্যা –পূর্ণিমা তিথিতে প্রদীপ প্রজ্বলন ও বিধি অনুযায়ী নিয়মিত পূজার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

এই মহামায়া গাছতলা বা বেদীতে স্থানীয় অনেকেই উপবাস থেকে নিত্য পূজা করে থাকেন। সেই সাথে কটিয়াদীসহ আশেপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকেও এই বেদীতে পুণ্যার্থীদের নিয়মিত আসতে দেখা যায়। শুধু ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য নয়, এই এলাকার অগণিত নবীন-প্রবীণ মানুষের মনে এই বেদীকে ঘিরে রয়েছে, অনেক মধুর ও অম্লান স্মৃতি। কিন্তু করোনাকালে সরকার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞার কারণে উক্ত দুই বছর শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক শাস্ত্রীয় সীমিত উপাচারে মা মহামায়ার পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। দেশ ও দশের মঙ্গল কামনার পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের হাত রক্ষার পাবার প্রার্থনাও জানানোর মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছিলো করোনাকালে শ্রীশ্রী মা মহামায়া মায়ের পূজা। বিগত বছর থেকে শ্রী শ্রী মহামায়া গাছতলার পূজা আবার আগের পুরোনো আমেজে ফিরে এসেছে। এই উৎসব শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা পালন করে থাকলেও এটি এখন হয়ে উঠেছে কটিয়াদীতে নববর্ষ উদযাপনের এক অভিন্ন সর্বজনীন উৎসব হিসেবে। সেই সাথে কটিয়াদীর এই শ্রী শ্রী মা মহামায়া গাছতলার এই পূজা হয়ে উঠেছে বাংলা শুভ নববর্ষে এলাকার সামাজিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক হিসেবে।

লেখক: জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

বাংলা নববর্ষে ঐতিহ্যের ধারক কটিয়াদীর গাছতলার পূজা সুমিত বণিক

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর