দিল্লির দরবারে ব্রিটিশরাজ
২৬ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৩০
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। ১৮৫৮ সালে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ভারতশাসন আইন পাসের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারতের প্রশাসনিক দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়। ভারতে প্রবর্তিত হয় ব্রিটেনের রানীর সরাসরি শাসন। ১১ হাজার মাইল নৌপথ পাড়ি দিয়ে ব্রিটেনের চেয়ে তের গুণ বড় ভারতবর্ষকে শাসন করতে লাগল ব্রিটিশরা। রাজপরিবারের কেউ ভারতের মাটিতে পা না রেখেই ৫০ বছর দোর্দন্ড প্রতাপে তারা শাসন করে এই বিশাল দেশটি।
পিতা ৭ম এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর ৪৫ বছর বয়সী পঞ্চম জর্জ ব্রিটেনের সিংহাসনে বসেন। ব্রিটেনের পাশাপাশি তিনি আয়ারল্যান্ডেরও রাজা হন। পিতা ও দাদী কুইন ভিক্টোরিয়া বয়সের ভারে ন্যূব্জ ছিলেন। দীর্ঘ নৌযাত্রার ধকল সইবার ক্ষমতা তাদের ছিল না। ফলে ব্রিটেনের সবচেয়ে দামী উপনিবেশ ভারতবর্ষ তাদের চর্মচক্ষে দেখার সুযোগ মিলেনি। রাজা জর্জ সিংহাসনে বসেই সিদ্ধান্ত নিলেন সাত সাগর তের নদীর ওপারের বিশাল সাম্রাজ্যটি একবার দু’চোখে দেখে আসবার।
১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাজা পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেক হয় দিল্লির অদূরবর্তী বুরাডিতে। এর আগে ১৯১১ সালের ২২ জুন ওয়েস্টমিনিস্টার এ্যাবেতে তার অভিষেক হয়। এখানেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এছাড়া সৈনিক ও নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের এক মাসের অতিরিক্ত বেতন প্রদান, ঢাকায় একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ, ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ প্রাপ্ত ভারতীয়দের নাম ঘোষণা ইত্যাদি। এসব দান ঘোষণার পর ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্যার, রাজা, মহারাজা, নওয়াব, রায় বাহাদুর ও খানবাহাদুর প্রভৃতি সম্মানসূচক উচ্চ খেতাবে ভূষিত করেন।
এ দরবারে রাজা জর্জ ব্যাপক শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের ঘোষণা দেন। যেমন- ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ বা বাতিল, যুক্ত বাংলার জন্য গভর্নর-ইন-কাউন্সিল সৃষ্টি, বিহার, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুরকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এদের সমন্বয়ে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি এবং আসামের মর্যাদা পুনরায় হ্রাস করে একজন চীফ-কমিশনারের অধীন করা।
আরও ঘোষণা করা হয়, তখন থেকে ভাইসরয় ক্রমান্বয়ে শুধু রাজকীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় দেখাশোনা করবেন এবং প্রাদেশিক শাসনকার্য গভর্নর-ইন-কাউন্সিল ও নির্বাচিত সংস্থা কর্তৃক স্বশাসিতভাবে পরিচালিত হবে। এর ফলে ভারতীয়রা সীমিত পরিসরে দেশশাসনের ক্ষমতা পায়। মন্ত্রীর পদ সৃষ্টি হয়। এসব ঘোষণার পর ভারতে ব্রিটিশবিরোধী ক্ষোভ সাময়িক স্তিমিত হয়।
তাঁবুর শহর
এ রাজ্য অভিষেক উপলক্ষে দিল্লিতে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দরবারটি বসেছিল। দরবারের স্থান ছিল উত্তর-পশ্চিম দিল্লিতে। ২৫ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে তাঁবুর শহর তৈরি করা হয়েছিল। শহরের কেন্দ্রে ৮৫ একর জুড়ে ছিল রাজার প্যাভিলিয়ন।
অফিসারদের এবং ভারতীয় রাজকুমারদের শিবিরগুলো ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি (অগ্রাধিকারের ক্রম) অনুসারে সাজানো হয়ে ছিল। অস্থায়ী শহরের জন্য বসানো হয়েছিল নতুন রেললাইন। ৬৪ কিলোমিটার নতুন রাস্তা এবং ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ জলের লাইন নির্মাণ করা হয়েছিল।
রাজকীয় দম্পতি জবরজং রাজ্যাভিষেকের পোশাক পরে দরবারে পৌঁছেছিলেন। রাজা ভারতের যে রাজকীয় মুকুটটি পরেছিলেন তাতে আটটি খিলানে ৬১৭০টি নিপুণভাবে কাটা হীরা ছিল। হীরাগুলো আবার নীলকান্তমণি, পান্না এবং রুবি পাথর দ্বারা আবৃত ছিল। মুকুটে আর ছিল একটি মখমলের কাপড় আর ছোট একটি টুপি। সব মিলিয়ে মুকুটের ওজন ছিল ৩৪ আউন্স (৯৬৫ গ্রাম)।
ভারতে ব্রিটিশদের সবচেয়ে বড় অপমান
এখানে ব্রিটিশ রথী মহারথীরা ছাড়াও ৫৬৫ টি দেশীয় রাজ্যের (যা মোট ভারতের ৪০% ভূমি জুড়ে ছিল) রাজা, নায়েব ও বড় বড় জমিদাররা হাজির ছিলেন। সেখানে প্রথা ছিল রাজারা এসে ইংল্যান্ডের রাজাকে তিনবার কুর্নিশ জানিয়ে এমনভাবে দরবার ত্যাগ করবেন যাতে তাদের পিঠ দেখা না যায়। হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি ছিল আয়তনে ইংল্যান্ডের চেয়ে বড়।
হায়দ্রাবাদের নিজাম প্রথমে মঞ্চে এলেন। তিনি তিনবার কুর্নিশ করে দামী উপহার রাজার সামনে রেখে সম্মান দেখিয়ে চলে গেলেন। এরপর এলেন মাইসুরের রাজা। অপরাপর রাজারাও এভাবেই সম্মান দেখালেন। শুধু একজন রাজা একবার কুর্নিশ করে পিঠ দেখিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তার দেহে কোনও রাজকীয় পোশাক ও অলংকার ছিল না। তিনি যে কুর্নিশ করেছেন নেহাৎ অনিচ্ছায় তা স্পষ্ট বোঝা গেল। তিনি হলেন বারোদার রাজা সায়াজিরাও গাইকওয়াদ।
এ নিয়ে ইংল্যান্ডের সংবাদপত্র পর্যন্ত প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। বারোদার রাজাকে প্রদেয় সকল সুযোগসুবিধা তুলে নেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। শেষমেশ রাজা একটা লোক দেখানো দুঃখপ্রকাশ করে সিংহাসন রক্ষা করেন। ব্রিটিশরাও সায়াজিরাওর প্রতি দুর্বল ছিল। কারণ তার রাজ্য পরিচালনা ছিল পুরো ভারতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তার প্রশাসন ব্রিটিশদের চেয়ে ভাল ছিল।
বারোদার রাজা ব্রিটেশদের কি ক্ষতি করেছিলেন ব্রিটিশরা পরে বুঝেছিল। ঋষি অরবিন্দ, আম্বেদকার বারোদা রাজার কর্মচারী ছিলেন। আম্বেদকার বারোদা রাজার টাকায় বিদেশ পড়তে যান। এই আম্বেদকার পরে ভারতের সংবিধান রচনায় মুখ্য ভূমিকা রাখেন। ভারতে সশস্ত্র সংগ্রামের অন্যতম পথিকৃৎ বাঘা যতীন বারোদা রাজার সেনাবাহিনী থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
রাজার মৃগয়া
অনুষ্ঠানের পরে রাজা জর্জ নেপালে যান শিকারের জন্য। যদিও এর কিছুদিন আগে (১১ ডিসেম্বর ১৯১১) রাজা ত্রিভুবন বীর বিক্রম আকস্মিকভাবে মারা যান। নেপালের রাজপরিবার শিকারের জন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করায় রাজা জর্জের আগমনকে তারা স্বাগত জানায়।
রাজা জর্জ সেখানে ১০ দিন ধরে শিকার করে ১৮টি গন্ডার, ১৯টি বাঘ, ৪টি ভাল্লুক, বেশ কয়েকটি সজারু এবং চিতাবাঘ হত্যা করেছিলেন। জঙ্গলের পাশে গরু বেঁধে টোপ দেওয়া হত।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী রাজা জর্জকে একটি জীবন্ত গন্ডার উপহার দেন। রাজা সেটি লন্ডন চিড়িয়াখানায় নিয়ে যান। সে শিকারের চিত্রগুলো রয়্যাল কমনওয়েলথ সোসাইটি (ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজ) এবং অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত তিনটি অ্যালবামে পাওয়া যায়।
শিকারে প্রাপ্ত সকল সামগ্রী কীভাবে বিতরণ করা হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে চারটি বাঘের চামড়া যুক্তরাজ্যের ৪টি জাতীয় জাদুঘর- লন্ডন, এডিনবার্গ, কার্ডিফ এবং ডাবলিন এবং চারটি চামড়া প্রাদেশিক জাদুঘর- এক্সেটার, নরউইচ, লিসেস্টার এবং ব্রিস্টলকে দেওয়া হয়েছিল।
রাজকীয় শিকারে অংশ নেওয়া ব্রিটিশ কূটনীতিক এবং প্রকৃতিবিদ ব্রায়ান হাউটন হজসন ৫৬০টিরও বেশি প্রজাতির পাখি (৯৫০০ টি নমুনাসহ), ৯০০টি স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ৮০টি সরীসৃপের বর্ণনা নথিভুক্ত করেছিলেন।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইতিহাস-ঐতিহ্য ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ জয়দীপ দে দিল্লির দরবারে ব্রিটিশরাজ ফিচার