Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলন

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
১৯ মে ২০২৩ ১৬:৫৯

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা মায়ের সন্তানরা মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকার রাজপথ বুকের রক্তে রাঙিয়েছিল। আমাদের ভাষা সংগ্রামে অন্যান্য অঞ্চলের বাঙালিরা উজ্জীবিত হয়েছিল। তারই মূর্ত প্রকাশ ছিলো ভারতের আসাম রাজ্যে বাংলা ভাষা আন্দোলন। বাংলাকে প্রাদেশিক দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদার দাবিতে বুকের রক্ত দিয়েছিল তারাও।

‘আসাম শুধু অসমিয়াদের’ এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশ ভাগের পর শুরু হয় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলিকে অসমিয়াকরণের প্রয়াস। স্কুলগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে অসমিয়া প্রবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যথায় অনুদান বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে সেখানে ২৫০টি বাংলা মাধ্যমের স্কুলের মধ্যে ২৪৭টিই বন্ধ হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বিধানসভায় অনসমিয়াদের বেলায় বাংলা, ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপনের বিধান ছিল। ওই বছর নতুন আইন পাশ করে তা কেড়ে নেয়া হয়। তবে তখনও অধ্যক্ষের অনুমতিক্রমে মাতৃভাষায় বক্তব্য পেশের সুযোগ ছিল। কিন্তু ১৯৫৪ সালে বিধানসভায় একমাত্র অসমিয়াকে রাজ্যের ভাষা হিসাব গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হলে তাতে আসাম রাজ্যের সর্বত্র অ-অসমিয়া ভাষীদের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অবশ্য বেসরকারিভাবে উত্থাপিত ওই প্রস্তাব তখন বিবেচনা না করে স্থগিত রাখা হয়। কিন্তু বাংলাভাষীদের মধ্যে জনসংখ্যানুপাতে বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষার সম্মান দেওয়ার দাবি ওঠে।

বাংলা ভাষা আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে ১৯৬০-এর এপ্রিলে। ২১ ও ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির এক সভায় অসমিয়াকে আসামের একমাত্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং সরকারি দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ২১ জুন ১৯৬০ শিলচরে ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’-এর উদ্যোগে এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে বাঙালিদের উপর হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনকে সংহত রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে ২ ও ৩ জুলাই ১৯৬০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’। এই সম্মেলনে আসাম রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পঁচিশ হাজার নরনারী সমবেত হয়। বিভিন্ন জাতি, উপজাতি ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্মেলন পরিণত হয় মহাসম্মেলনে। সভায় আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে একমাত্র অসমিয়ার প্রবর্তন স্থগিত রেখে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়। এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পরই শুরু হয় দাঙ্গা হাঙ্গামা। নির্বিচারে বহু বাঙালির বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

১০ অক্টোবর আসাম বিধান পরিষদে আসাম সরকারি রাজ্যভাষা বিল উত্থাপন করা হয়। ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত এ বিল নিয়ে আলোচনা চলে। ২৪ অক্টোবর সব সংশোধনী প্রস্তাব, অনুরোধ-নিবেদন উপেক্ষা করে রাজ্যভাষা বিল চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। এভাবে আসামের বিভিন্ন অসমিয়া উপজাতি গোষ্ঠী ও দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী লক্ষ লক্ষ বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দাবি উপেক্ষিত ও অস্বীকৃত হয়। এর প্রতিবাদে অনেক সংসদ সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। মাতৃভাষার অধিকার বঞ্চিত লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষোভে, দুঃখে, উত্তেজনায় ফেটে পড়ে।

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ক্রমেই সংহত রূপ নিতে থাকে। ১৯৬০-এর ১৮-২০ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় উপত্যকা তথা বরাক উপত্যকার বাঙালি নাথ যুগী সম্প্রদায়ের ৩৬তম বার্ষিক অধিবেশন। ওই অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার মতো সরকারি মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানানো হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় জেলা জনসম্মেলন। সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা করার দাবি তোলা হয়। অন্যথায় সমগ্র জেলায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

১৪ এপ্রিল ১৯৬১ নববর্ষের দিনে কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পালিত হয় ‘সংকল্প দিবস’। সংকল্প করা হয় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। এই সংকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম হিসাবে ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয় পদযাত্রা। দুই সপ্তাহ ধরে পদযাত্রীরা ২২৫ মাইল পথ অতিক্রম করেন। গ্রামে গ্রামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রচার চালান। ২ মে তারা করিমগঞ্জে এসে পৌঁছলে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

১৯ মে ভাষা আন্দোলনের অংশ হিসাবে কাছাড় জেলার সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। আগের রাতে করিমগঞ্জে সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয়ে চলে পুলিশি হামলা। আন্দোলন ঠেকাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয় অনেক নেতা-কর্মীকে।

খবর দাবানলের মতো রাতেই ছড়িয়ে পড়ে। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জনতা নামে রাজপথে। শিলচর রেলস্টেশনে জড়ো হয়েছিল হাজারও মানুষ। তারা শুরু করেছিল সত্যাগ্রহ। আসামের আধা-সামরিক বাহিনী বিনা উস্কানিতে গুলি ছোড়ে। তাতে শহীদ হয় ১১ জন। তারা হলেন- শচীন্দ্র পাল, কানাই নিয়োগী, কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চন্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর ও সত্যেন্দ্র দেব। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানের ঘটনাটি বাঙালির ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উপেক্ষিত অধ্যায়। কিন্তু ঢাকা বা আসামের ভাষা শহীদদের মহান আত্মত্যাগের কথা ভোলার নয়। বাংলা ভাষার সঙ্গে এসব সংগ্রামীদের রক্ত মিশে আছে।

লেখক: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন

সারাবাংলা/এজেডএস

আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলনের রক্তস্নাত অধ্যায় এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

কানপুরে প্রথম দিনে বৃষ্টির দাপট
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৩৫

সম্পর্কিত খবর