বটিয়াঘাটার বাদামতলা গণহত্যা
১৯ মে ২০২৩ ১৭:০৭
১৯৭১ সালে ১৯ মে তারিখে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার ফুলতলা, দেবীতলা ও বাদামতলা গ্রামে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল। স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ গণহত্যা ঘটিয়েছিল। প্রায় তিন থেকে চার ঘন্টার এ গণহত্যায় প্রায় দুই শতাধিক মানুষ মারা যায়। মৃতদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল বটিয়াঘাটা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের হিন্দু জনগোষ্ঠীর সদস্য এবং এ অঞ্চল দিয়ে শরণার্থী হয়ে আসা বাগেরহাট ও মোংলা অঞ্চলের অনেক মানুষ।
১৯৭১ সালের ১৯ মে বুধবার সকাল আনুমানিক সাত/আটটার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গানবোট ফুলতলা গ্রামের পাশে আসে। গানবেট থেকে রাজাকারদের অনুসরণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য ফুলতলা বাজারের দিকে প্রবেশ করে। সেদিন রাজাকারদের মধ্যে উপস্থিত ছিল রাজাকার কমান্ডার হাবিবুর রহমান জোয়াদার এবং তার বাহিনীর সদস্য খোরশেদ, জাফর, কামালসহ বেশ কয়েকজন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগমের সংবাদে ফুলতলা গ্রামবাসীরা পাশ্বর্বর্তী গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। তবে এ গ্রামের রাজেন্দ্রনাথ মন্ডল নামে একজন বৃদ্ধ এবং রামলাল নামক একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি গ্রামে থেকে যায়। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে প্রবেশ করে ওই দুই ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে এবং গ্রামটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
পাকিস্তান সেনারা ফুলতলা বাজার থেকে গুলি চালিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে দেবীতলা গ্রামের সম্মুখে উপস্থিত হয়। তবে দেবীতলা গ্রামে প্রবেশের পূর্বে ফাঁকা বিল ছিল এবং বিলের পরেই খাল ছিল। এই খাল পার হওয়ার জন্য পাকিস্তান সেনারা পার্বতী নামের একজন লোককে গুলি করে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে তার নৌকাযোগে খাল পার হয়েছিল। খাল পার হয়েই নৌকার মাঝি পাবর্তী জীবন ভিক্ষা চাইলেও নির্দয় সেনারা খালের পাড়েই তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা দেবীতলা গ্রামে প্রবেশ করে। ফুলতলা গ্রামের ন্যায় দেবীতলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রবেশ করলে এলাকাবাসী প্রাণরক্ষার্থে গ্রামের পশ্চিম দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তান সেনারা প্রথমেই উপন্দ্রেনাথ বিশ্বাসের বাড়িতে ঢুকে এবং ৮৩ বছর বয়স্ক উপন্দ্রেনাথ বিশ্বাসকে গুলি করে। এরপর দেবীতলা গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার এদেশীয় দোসরদের গণহত্যা ও নির্যাতনের কারণে ফুলতলা, দেবীতলা, বসুরাবাদ প্রভৃতি গ্রামের মানুষ বাদামতলা বাজারে সমবেত হয়েছিল। এদিকে বসুরাবাদ থেকেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী শান্তি কমিটির সদ্যদের সহযোগিতায় বাদামতলা বাজারে প্রবেশ করে। পাকিস্তান সেনাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে লোকজন সামনের দিকে ছুটতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাদামতলা বাজারের কিছুটা উত্তর দিকে ঘেরাও করে বহু মানুষকে আটক করে। এদেরকে পাহারা দেওয়ার জন্য একজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য এবং তিন-চারজন রাজাকার নিযুক্ত করা হয়েছিল। এরপর পাকিস্তান সেনারা বাদামতলা গ্রামের নিরীহ লোকজন এবং পাশ্ববর্তী খালের নৌকার যাত্রীদের বাদামতলা বাজার সংলগ্ন বসুরাবাদ বিলের নলিয়ার ভিটা নামক স্থানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। এরপর ওই মানুষগুলোকে গুলি করে হত্যা করে। এতে কমপক্ষে দুইশত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। সারিবদ্ধ অবস্থায় প্রায় চারশত লোক দাড়িয়ে ছিল বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে অনেকে দৌড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়া আগে থেকেই বিপুল সংখ্যক শরণার্থী (অধিকাংশই রূপসা, ফকিরহাট, বাগেরহাট, রামপাল এলাকার) ভারতে যাওয়ার জন্য বাদামতলায় অপেক্ষা করছিল। আবার অনেকে যাত্রা বিরতি করতেও অপেক্ষা করছিল। সেনাদের গুলিতে তাদের মধ্যে অনেকে শহিদ হয়। ফলে গণহত্যায় স্থানীয় ছাড়াও অন্য এলাকার অনেকে নিহত হয়েছিল।প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে এবং বিভিন্ন বইপত্রে এ গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা ২০০’র অধিক। স্থানীয়দের পাশাপাশি গণহত্যার দিন বিপুল সংখ্যক শরণার্থী বাদামতলা বাজারে এসেছিল। ফলে শরণার্থীদের মধ্যে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। মাঠপর্যায়ে সরজমিন অনুসন্ধান পদ্ধতি ও বিভিন্ন বইপত্র অনুসারে এই গণহত্যার ২৯ জনের তথ্য পাওয়া যায়।
১৯ মে তারিখে বাদামতলা গণহত্যার পর ২০ মে তারিখে চুকনগর গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল। আর এ চুকনগর গণহত্যায় যারা শহিদ হন তাদের অধিকাংশই বটিয়াঘাটা অঞ্চলের মানুষ। বাদামতলা গণহত্যায় আক্রমণের শিকার হয়ে অনেকে চুকনগরে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পরেরদিন অর্থাৎ ২০ মে তারিখ চুকনগরেই তাদের অনেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে মারা যান। আবার চুকনগর গণহত্যা থেকে যারা বেঁচে যান তাদের মধ্যে অনেকেই পরেরদিন অর্থাৎ ২১ মে ঝাউডাঙ্গা গণহত্যায় শহিদ হন। সুতরাং বাদামতলা গণহত্যার রেষ চুকনগর এবং ঝাউডাঙ্গা গণহত্যায়ও পড়েছিল।
লেখক: শিক্ষার্থী,নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস