যেভাবে কোরবানির প্রথা শুরু হলো
২৮ জুন ২০২৩ ১২:০২
কোরবানির রীতি ইবাদত হিসেবে যদিও আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে প্রচলিত; কিন্তু পরবর্তীতে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের এক ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবার শুরু হয়। আমরা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই এ জাতির প্রতিষ্ঠাতা ও মুসলিম জাতির পিতা হচ্ছেন ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। তিনি যেমন আল্লাহর নির্দেশে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ছেলে ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে কোরবানি করতে প্রস্তুত ছিলেন, ঈদুল আজহার দিন মুসলমানরাও তেমনি পশু কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের অত্যধিক প্রিয় জান-মাল আল্লাহর পথে কোরবানি করার সাক্ষ্য দেয়।
মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সেই মহত্ত ও মকবুল কোরবানিকে শাশ্বত রূপদানের জন্যই আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিনে মুসলমানদের ঈদুল আজহা উপহার দিয়ে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন ধরনের কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষা করেছেন। তিনি প্রত্যেকটি পরীক্ষায়ই পূর্ণ সফল প্রমাণিত হয়েছেন।
প্রথম তো তাওহিদ হেফাজতের প্রয়োজনে চিরদিনের জন্য প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে হিজরত করেন। লুত আলাইহিস সালাম (যিনি এর আগে তার ওপর ঈমান এনেছিলেন)-কে সঙ্গে নিয়ে নিজ জন্মভূমি ইরাক থেকে হিজরত করে ফিলিস্তিনের কেনানে চলে যান। ৮৬ বছর বয়সে সেখানে থাকাকালে সন্তান-সন্তুতির জন্য হাত তুললেন— ‘হে আল্লাহ! আমায় সৎপুত্র দান করুন। আল্লাহতায়ালা তার প্রার্থনায় সাড়া দিলেন— দইবরাহিমকে এক ধৈর্যশীল পুত্রের (ইসমাঈলের) সুসংবাদ দিলাম।’
শেষমেষ ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বেশকিছু পরীক্ষার কঠিন মঞ্জিল একের পর এক পার করতে না করতেই স্বপ্নের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হন। যা বিগত পরীক্ষাগুলোর চেয়েও অধিক কঠিন, হৃদয়বিদারক ও আল্লাহপ্রেমের ছিলো। কোনো কোনো বর্ণনামতে—এ স্বপ্ন তিনি পরপর তিন রাত দেখেন। প্রিয় পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে কোরবানি করতে আদিষ্ট হন। আর তখন এমন সময় ছিলো, যখন অনেক প্রার্থনা করে পাওয়া সন্তানকে লালন পালন করার পর ছেলে বাবার সঙ্গে চলাফেরা করতে পারে এবং তাকে সাহায্য করার যোগ্য।
তাফসিরবিদগণ লিখেছেন—এ সময় ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বয়স ছিলো ১৩ বছর। কেউ কেউ বলেছেন—তিনি তখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিলেন। তবে তাফসিরে রুহুল বয়ানে ৯ বছরের কথা উল্লেখ রয়েছে।
এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত, নবী-রাসুলগণের স্বপ্নও ওহির অন্তর্ভুক্ত। তাই এ স্বপ্নের অর্থ ছিলো—আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের প্রতি একমাত্র পুত্রকে জবাই করার নির্দেশ।
এ হুকুমটি স্বপ্নের মাধ্যমে দেওয়ার কারণ হলো, ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আনুগত্যের বিষয়টি পূর্ণমাত্রায় প্রমাণিত করা। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম মহান প্রতিপালকের নির্দেশ পালনে যাবতীয় প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু এ পরীক্ষাটি যেহেতু ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার পুত্রও সংশ্লিষ্ট, তাই তিনি ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে বললেন—
‘প্রিয় আমার! স্বপ্নে দেখি, তোমায় জবাই করছি। তুমি চিন্তা-ভাবনা করে দেখো এবং এ ব্যাপারে তোমার অভিমত কী, বলো।’ (সুরা সাফফাত : ১০২)
যেমন বাবা, তেমন ছেলে। পুত্রও ছিলেন যেনো ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ছাঁচে গড়া। কেননা, তিনিও তো তখন ভাবী নবী। তাই তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণে মাথা নত করে জবাব দিলেন—
‘আব্বাজান! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমায় ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন। (সুরা সাফফাত : ১০২)’
পুত্রের সঙ্গে পরামর্শের পেছনে রহস্য ছিলো—প্রথমত পুত্রের দৃঢ়তা, হিম্মত এবং আল্লাহর আনুগত্যের আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার পরীক্ষাস্বরূপ। দ্বিতীয়ত সে আনুগত্য স্বীকার করলে সওয়াব ও প্রতিদানের অধিকারী হবে। কেননা, সওয়াবের জন্য নিয়ত ও আগ্রহ জরুরি। তৃতীয়ত জবাইয়ের সময় মানুষ হিসেবে এবং স্বভাবজাত পিতৃস্নেহের কারণে কোনো ভুল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে অনেকটা মুক্ত থাকার প্রবল আশা সৃষ্টি হবে।
পরামর্শ শেষে পিতা-পুত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে কোরবানির নির্দেশ পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ কাজ সমাধার জন্য তারা মিনা প্রান্তরে রওনা হন। ইতিহাস ও তাফসিরভিত্তিক কোনো কোনো বর্ণনা থেকে জানা যায়—শয়তান কোরবানির মহান এ কাজে বিভিন্নভাবে বাঁধা সৃষ্টি করে। সে প্রথমে মা হাজেরা আলাইহাস সালাম ও পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে কৌশলে বুঝিয়ে এ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা শয়তানের প্ররোচনায় কোনো পাত্তা দেন না।
বিতাড়িত শয়তান তাদেরকে ধোঁকা দেওয়া থেকে নিরাশ হয়ে মিনা যাওয়ার পথে জামরায়ে আকাবা, জামরায়ে উসতা এবং জামরায়ে উলা—এ তিন স্থানে তিনবার ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ইবরাহিম আলাইহিস সালাম প্রতিবারই তাকে সাতটি করে পাথরকণা নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে দেন। আজ পর্যন্ত এ প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতিস্বরূপ মিনায় ওই তিনটি স্থানে পাথরকণা নিক্ষেপ করার বিধান হাজিদের জন্য ওয়াজিব হিসেবে পালিত।
অবশেষে পিতা-পুত্র উভয়ে যখন এ মহান কোরবানির ইবাদত পালনের উদ্দেশে কোরবানিস্থলে পৌঁছুলেন এবং ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কোরবানি করার জন্য ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে শোয়ালেন, তখন পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালাম পিতা ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে বললেন—‘আব্বাজান! আমার হাত-পা খুব শক্ত করে বেঁধে নিন, যেনো আমি নড়াচড়া করতে না পারি। আর আপনার পরিধেয় বস্ত্রাদি সামলে নিন, যেনো আমার রক্তের ছিটা আপনার কাপড়ে না মাখে। নইলে এতে আমার সওয়াব কমে যেতে পারে। তা ছাড়া রক্ত দেখলে আমার মা অধিক ব্যাকুল হবেন হয়তো। আপনার ছুরিটি ধার দিয়ে নিন এবং আমার গলায় দ্রুত চালাবেন, যেনো আমার প্রাণ সহজে বেরিয়ে যায়। কারণ, মৃত্যু বড় কঠিন ব্যাপার। আপনি আমার আম্মাজানের কাছে আমার শেষ বিদায়ের সালামটুকু দয়া করে পৌঁছে দেবেন। যদি আমার জামা তার কাছে নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন।’
একমাত্র আদরের সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে! সহজেই অনুমেয়। কিন্তু ইবরাহিম আলাইহিস সালাম দৃঢ়তায় অটল পাহাড় হয়ে জবাব দিলেন—‘বাছাধন আমার! আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য তুমি আমার চমৎকার সহায়ক হয়েছ।’ এরপর তিনি পুত্রকে আদর করে চুমু খেলেন। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকে বেঁধে নিলেন। তারপর তাকে সোজা করে শুইয়ে গলায় ছুরি চালালেন।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! বারবার ছুরি চালানো সত্ত্বেও গলা কাটছে না। কেননা, আল্লাহতায়ালা নিজ কুদরতে পিতলের একটা টুকরো মাঝখানে বাঁধা হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন। তখন পুত্র নিজেই আবদার করে বললেন—‘আব্বাজান! আমায় উপুড় করে শুইয়ে নিন। কারণ, আমার মুখাবয়ব দেখে আপনার মাঝে হয়তো পিতৃস্নেহ জেগে উঠছে। তাই গলা কাটা যাচ্ছে না। তা ছাড়া ছুরি দেখলে আমি ঘাবড়ে যাই।’
সন্তানের কথামতো ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাকে উপুড় করে শুইয়ে আবার সজোরে ছুরি চালালেন। কিন্তু তখনও গলা কাটলো না। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। তার এ প্রাণান্তর চেষ্টা দেখে রাব্বুল আলামিন ভীষণ খুশি হলেন। ইসমাঈল আলাইহিস সালামের জবাই ছাড়াই তার কোরবানি কবুল করে নিলেন। এ ব্যাপারে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ওপর অহি অবতীর্ণ হলো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন— ‘অবশেষে যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদের সমর্পণ করলো এবং ইবরাহিম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলো, তখন তাকে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছো। আমি সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদান দিয়ে থাকি। আসলে এ এক সুস্পষ্ট কঠিন পরীক্ষা। আর আমি একটি দুম্বা ফিদিয়াস্বরূপ কোরবানি করে তাকে (ইসমাঈলকে) উদ্ধার করেছি। (সুরা সাফফাত ১০৩-১০৭)’
এরপর আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিলেন—‘এখন পুত্রকে ছেড়ে দাও এবং তোমার পাশে যে দুম্বাটি দাঁড়ানো, পুত্রের পরিবর্তে সেটাকে জবাই করো।’ তখন ইবরাহিম আলাইহিস সালাম পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখেন, একটি হৃষ্টপুষ্ট দুম্বা দাঁড়ানো। আল্লাহর শোকর আদায় করে তিনি সেই দুম্বাটি জবাই করলেন।
এটাই সেই কোরবানি, যা আল্লাহর দরবারে এতোই প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিলো, আল্লাহতায়ালা পরবর্তী সব উম্মতের মাঝে তা অবিস্মরণীয়রূপে বিরাজমান রাখার ব্যবস্থা করে দিলেন। যার ফলে মিল্লাতে ইবরাহিমে তথা ইসলাম ধর্মে এক মহান ওয়াজিব ইবাদত ও প্রতীক হিসেবে এ কোরবানি আজও পালিত এবং কেয়ামত পর্যন্ত পালিত হবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহতায়ালা বলেন— ‘আমি ভবিষ্যত উম্মতের মাঝে ইবরাহিমের এ সুন্নত স্মরণীয় করে রাখলাম। (সুরা সাফফাত : ১০৮)’
লেখক: চেয়ারম্যান, ইসলাম প্রতিদিন
সারাবাংলা/এসবিডিই
ধর্ম ও জীবন ফিচার মিরাজ রহমান যেভাবে কোরবানির প্রথা শুরু হলো