Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মা দিবস ও আমার মা


১২ মে ২০১৮ ১৫:৫৮

জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী।।

‘মা দিবস’ সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম মাত্র কয়েক বছর আগে। তখন চাকুরিজীবন শুরু হয়েছিল, তাই কিছুটা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মা দিবস’ কে মনে করতাম, আম্মার জন্য কিছু একটা উপহার কেনা আর সঙ্গে খাবার কিনে বাসায় ফেরার মতো কিছু আয়োজন। তখন পর্যন্ত কেবল আমার বোনের বিয়ে হয়েছিল বলে ও আমাদের থেকে দূরে থাকত। কিন্তু যখন আমার ভাইটা বিয়ে করল তারপর থেকে আম্মুর সঙ্গে আমিই একা। কাজেই আমার সঙ্গে আমার মায়ের রাগারাগি হওয়ার এক কোটি কারণ প্রতিদিন ঘটে। আম্মুর যত কারণে মেজাজ খারাপ হয়, তার সব আমার ওপর দিয়ে যায়। আমার আম্মা অবশ্য রাগারাগি যে খুব বেশি করে এমন না। কারণ আম্মা বাসার কাজের মেয়েকে জীবনেও বকবে না, আমার বোনকে তো জীবনে কোনদিন একটা ধমক দিয়েছে এই স্মৃতি নেই বলতে গেলে। আর আমার ভাইতো আম্মুর একমাত্র ছেলে, তার কথা আর না-ই বলি।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু আমি হচ্ছি আম্মুর একমাত্র বড় মেয়ে। বেচারা আমি! এই পৃথিবীর হেন কোন কারণ নেই যার জন্য আমার মা আমাকে একটা ধমক দেয়না। কিছুদিন আগে মাঝে মাঝে আমি খুবই সন্দেহ করতাম যে আম্মু কি আসলেই আমার আম্মু নাকি আমাকে কুড়িয়ে টুড়িয়ে পেয়েছিল কোথাও থেকে? কিন্তু কিছু অকাট্য প্রমান আছে যে আমি আসলে আমার আম্মারই মেয়ে। কাজেই আমার কাছে প্রতিদিন “মা দিবস”, মা দিবসের অনুভূতি আমার কাছে আলাদা করে একটু কম।

ছোটবেলায় আমি খুবই বোকা আর প্রচন্ড শুকনো শরীরের একটা মানুষ ছিলাম। আমি নাকি হাঁটতে গেলে প্রায়ই হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতাম তাই আম্মু আমাকে ডাকত “ট্যাংরা” নামে। আমার বোন ছিল জন্মের সময় থেকেই ভয়ঙ্কর জ্ঞানী আর মিষ্টি দেখতে। আম্মু ওকে ডাকত “খরগোস” বলে। আমি নিজেও অনেক খুশি হতাম আম্মু যখন আমার বোন সিলভীকে ‘খরগোস’ নামে ডাকত। কিন্তু আমাকে ট্যাংরা বলে ডাকলে ঠিক বিরক্ত হতাম না বরং প্রচন্ড হীনমন্যতায় ভুগতাম যে আমি কেন হোঁচট খাই? হোঁচট না খেলে তো আম্মু আমাকে এমন নাম দিতনা। কিন্তু এখন এই বড় হয়ে যাবার পরেও আমি হোঁচট খাই।

বিজ্ঞাপন

আম্মুর সঙ্গে যখন কোন কাজে বের হই তখন যত রকমের শপিং সব আমাকে বইতে হবে। তার মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর হল আম্মু মহল্লার ভেতর থেকে যখন বাজার করবে তখন সব্জির ৫/৬ কেজি, ফলের ১/২ কেজি এইসব কিনবে আর বেচারা আমি তার কুলির দায়িত্ব পালন করব। সবচেয়ে অসহ্য হল লাউ আর তরমুজ ধরার পর হাত আর ফাঁকা থাকে না, তখন বাকিসব কীভাবে ধরা সম্ভব? জানিনা কীভাবে সব ধরি, তবুও এইগুলো আমাকে বয়ে নিয়ে আনতে হবেই। যতই খাবার ঘরে থাক আর যতই আমি সুপার শপ থেকে বাজার করিনা কেন, আম্মার সঙ্গে বের হলে এইটা হল আমার নিয়তি!

https://www.facebook.com/Sarabangla.net/videos/615840558776356/

এই নিয়তির লিখনে আরো কিছু কাজ আছে। তার হাজার হাজার ঘটনার মধ্যে একটা ঘটনা প্রায়ই মনে পড়ে। আম্মু প্রতিদিন বিকালে আফতাবনগরে হাঁটতে যায়। এই হাঁটার পেছনে অনেক লম্বা ব্যাখ্যা আছে। আম্মু হাঁটতে যেতে চায় বিকালে, আমি চাই সকালে। এক পর্যায়ে আমার হাঁটতে যাওয়াই বন্ধ বা অনিয়নিত কিন্তু আম্মু নিয়মিত হাঁটে। গত বছরের শীতকালে একদিন হাঁটার পর বাসায় ফিরলে আম্মু খুবই মন খারাপ করে ছিল, কারণ যে পথ দিয়ে আম্মু হাঁটে সেই পথের পাশে একজন বৃদ্ধা বসে থাকতো। ঐ সময়ে অতিরিক্ত শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছিল। আম্মু ঐ বৃদ্ধার জন্যে কয়েকটা শীতের কাপড়, সোয়েটার, গায়ের চাদর, একটা কাঁথা এগুলো নিয়ে ঐদিন দিয়ে এসেছে। তখন আম্মু দেখেছে যে একটা কুকুর ঐ বৃদ্ধার গায়ের সঙ্গে মিশে বসে থাকে, মনে হয়েছে যেন কুকুর তার গায়ের উত্তাপটুকু দিয়ে বৃদ্ধাকে বাঁচিয়ে রাখছিল। এই দৃশ্য দেখে আম্মু বাসায় এসে কিছুতেই বৃদ্ধার কথা মাথা থেকে তাড়াতে পারছিল না। এমনকি রাতে খাবার খেতেও পারছিল না। এক পর্যায়ে  আমি অনেক সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, চল কালকে ওনার জন্য একটু খাবার নিও চলো আমিও যাব। জিজ্ঞাসা করব রাতে কোথায় থাকে? একটু বেশি খাবারও মাঝে মাঝে দিও ওনাকে।

আম্মু এই কথায় মহা খুশি হয়ে গেল। পরদিন আম্মু ইলিশ মাছ রান্না করে ঐ বৃদ্ধার জন্যে একটা বক্সে করে খাবার নিয়েছে। সাথে আরো কি কি নিয়েছে জানিনা। পানির বোতল, আরো একটা বক্স সব মিলিয়ে ভালই ওজনের একটা ব্যাগ। আমাকে ওইদিন আম্মুর সঙ্গে হাঁটতে যেতে হবে আর সেই ব্যাগ বইতে হবে। বয়ে নিয়ে গেলাম বুড়ির উদ্দেশ্যে কিন্তু ওইদিন বুড়ি তার নির্দিষ্ট যায়গায় নেই।  আমি আম্মুকে শান্ত করতে বললাম চল আরো সামনে যাই, অন্য কোথাও বসেছে হয়ত আজকে। কিন্তু না, পুরো আফতাবনগর হেঁটেও ওইদিন বুড়িকে পাওয়া গেল না। সেই খাবারের ব্যাগ কাউকে দিয়ে দেওয়ার জন্য সারা পথে অন্য কোন ভিক্ষুককে খুঁজলাম। না, তাও পেলাম না। পরে বাসায় ফিরেতো মহা বিপদ যে আমার মায়ের ধারনা বুড়ি মারা গিয়েছে। আম্মু তাকে খাবার রান্না করে খাওয়াতে পারেনি এই আত্মগ্লানিতে বলা চলে নির্বাক হয়ে থাকলো পুরো সন্ধ্যায় আর রাতে। রাতে খাবার টেবিলে আমি সেই বক্স খুলে খাবার নিজের প্লেটে নিতে গেলে আম্মু বলল, ছোট বক্সটার খাবারটা ফেলে দাও, ওইটায় আমি মাছের কাঁটা দিয়ে ভাত মাখিয়ে বুড়ির কুকুরের জন্যে খাবার নিয়েছিলাম। ঐ কুকুরের উত্তাপেই বুড়িটা বেঁচে ছিল, কুকুরটার নিজেরওতো খাবার দরকার।

আমি সেই মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করলাম, আম্মুর ইচ্ছে পুরনের সুযোগ দিও, আম্মুর হাতের খাবার না খাইয়ে তুমি বুড়িটাকে নিয়ে যেওনা। যেখানেই আছে যেন ভাল থাকে বুড়িটা।

এই সার্ভিস দিয়েছি বলে কিন্তু আমার আম্মার ধমক আমার উপর থেকে কমে গিয়েছিল, এমন মনে করার কোন কারণ নেই। এমনকি মাঝে মাঝে আমার জন্যে খাবারই আম্মু রাখেনা। নিজে রোজা রাখবে আমাকে নির্দেশ দেবে নিজে রান্না করে খাও। অথবা এমনও ঘটবে যে আমি কোন কারণে রাগারাগি করেছি বলে না খেয়ে আছি, তখন যদি আমি মরেও যাই ২/৩ দিনের ভেতরে আমার কোন খবরও আম্মু নেবেনা। আমিতো তখন ভেবেও পাইনা যে আমার আম্মু রান্নাঘরের ব্যালকনিতে কাকের জন্যে খাবার দিয়ে রাখে, রাস্তার কুকুরের জন্যে খাবার বয়ে নিয়ে যায় কিন্তু আমার অবস্থান তাহলে কোথায়?

আমার সারা জীবনের একটা অভ্যেস হল – আমি সারাদিন কার সঙ্গে কি কথা বলেছি তা আমার আম্মার কাছে আরেক দফা রিপিট করি বাসায় ফিরে। ছোটবেলায় এই কথার মাত্রা মাঝে মাঝে এত বেশি বেড়ে যেত যে আম্মু রেগে অতীষ্ট হয়ে আমাকে বলত- উফ, আমি আর শুনব না। থাম এইবার।

আমার কথার যন্ত্রনা থেকে বাঁচার জন্যে আমার আম্মার সবশেষ উপায় হল আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে শোনা। এখনও এই অভ্যেস আমার বদলায়নি। আম্মু যতই বিরক্ত হোক, আমার এই অভ্যেস কোনদিন বদলায়নি। আমার এই অভ্যেসের  কারণে যে মানুষগুলো আমার বেশি পছন্দের তাদের সবার পরিচয় পারিবারিক বা সামাজিকভাবে যেভাবেই আছে না কেন, আমার আম্মা আমার মুখের থেকে শুনে  আরেক দফায় তাদেরকে চেনেন। আমার আম্মাও তাদেরকে আমার মত করেই পছন্দ করেন। আবার ঠিক উল্টোটা যখন ঘটে- আমাকে কেউ কষ্ট দেয়, তখন আম্মু আমাকে রাগ করলেও ঠিকঠিক বুঝিয়ে বলে ঐ মানুষটা কি অন্যায় আমার সঙ্গে করেছে। কাজেই সেই বিষয় একদম ভুলে যেতে আম্মু সাহস দেয়।

আমার ৪২ বছর বয়সেও আমি প্রতিদিন এখনো বকা, ধমক আর দোষারোপ সবই শুনি। এইসব ক্ষেত্রে আমার বোন আর ভাই অলৌকিক উপায়ে সৌভাগ্যবান।

মা দিবসের অনুভূতি আমার কাছে বিশেষ দিন না, প্রতিদিনই আমার কাছে ‘মা দিবস’। কারণ আমার মায়ের কাছে আছি কেবল আমি একা। ধমক, ঝাড়ি, দোষারোপ সব কিছুর পরেও যা আমার আমি অর্জন করি তা হল আম্মুদের সঙ্গে আল্লাহর যেন কীভাবে সরাসরি যোগাযোগ আছে। আম্মু যখন যে কাজের বিষয়ে সাহস দিয়ে বলে যে, “চিন্তা করনা তুমি পারবা”। তখন আল্লাহ সত্যিই আমাকে তা পারিয়ে দেয়। এই জন্যই আমি মাঝে মাঝে বলি, খবরদার কোন আশংকা করবা না, তুমি যা বলবা তা-ই তো আল্লাহ সত্যি করে দেবে।

আজকে ‘মা দিবসে’ আমি তোমার জন্য কামনা করছি- ভাল থাক আম্মু, সবচেয়ে বেশি ভাল থাক সব সময়ে। তোমার জন্যে আমার দোয়া সত্যি হবে কিনা তাতো আমি জানিনা, আমি শুধু জানি তুমি একটা শিশুর মতই সরল একজন মানুষ কিন্তু সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তির থেকেও বেশি জ্ঞানী তুমি। ভাল থাক সব সময়ে!

 

সারাবাংলা/এসএস

 

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর