যেদিনে হারিয়ে গিয়েছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা
২৯ আগস্ট ২০২৩ ১৫:৪৭ | আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০২৩ ১৫:৪৮
অভূতপূর্ব সব আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানিদের অকল্পনীয় আতঙ্কিত করে তুলেছিল ঢাকার আরবান গেরিলা দলের মুক্তিযোদ্ধারা, যাদের আমরা চিনি ক্র্যাক প্লাটুন হিসেবে।
বিশেষ গেরিলা দল হিসেবে জুনের ৩ তারিখে ঢাকায় ঢোকার পর জুনের ৯ তারিখে ঢাকার অপারেশন ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রথম অপারেশন চালানোর পর থেকে শুরু করে আগস্টের ২৯ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের জন্য যেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক আর বিভীষিকায় পরিণত হয়েছিল এই অসমসাহসী তরুণেরা। আগস্ট মাসের অপারেশনগুলোর পর, বিশেষ করে ২৫ তারিখ রাতে ধানমন্ডির ১৮, ২০ ও ২৮ নম্বর রোডে প্রবল আক্রমণের পর পাকিস্তানিরা যেন রীতিমত পাগলে পরিণত হয়েছিল। সম্ভাব্য সবধরনের সোর্স কাজ লাগালো তারা। ফলও পেলো খুব দ্রুত।
ফরিদ ছিল বদির খুব কাছের বন্ধু। তার বাবা প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিন ছিলেন ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল। প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিন ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের শ্বশুর। ফরিদ ঢাকার আরবান গেরিলাদের প্রচুর সাহায্য করেছিলেন। শেল্টার দিয়েছিলেন নানা সময়। অপারেশন শেষে গেরিলাদের তাৎক্ষণিক আশ্রয় দিতেন। তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার অবস্থান ইত্যাদির ফলে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করবেন কেউ দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেনি। কারণ তার বোন আইভী রহমান, ভগ্নীপতি জিল্লুর রহমানসহ পুরো পরিবার ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখে চলেছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের বাড়িটি গেরিলাদের হাইডআউট বানিয়ে শেল্টার দিচ্ছেন, ফরিদদের পুরো পরিবারকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকার কারণে ভোগতে হতে হচ্ছে প্রচণ্ডভাবে, সেখানে তিনি আচমকা বিশ্বাসঘাতকতা করে বসলেন। ইট ওয়াজ আনবিলিভেবল অ্যান্ড প্যাথেটিকেলি পেইনফুল! একাত্তরে এভাবেই আচমকা অনেকেই পাল্টে গিয়েছিল, ফরিদ পুরো পরিবারের গায়ে লাগিয়েছিল কলঙ্কের দাগ।
ক্র্যাক প্লাটুনের বেশ ক’জন গেরিলার কাছ থেকে জেনেছি যে, বদি ধরা পড়ার পর কিছুই বলেনি। ওকে প্রচণ্ড টর্চার করা হয়েছিল। কিন্তু নিয়ন সাইন কোম্পানির আবদুস সামাদ ধরা পড়ার পর স্ত্রী-সন্তানকে মেরে ফেলার ভয় দেখানোয় তিনি সব বলে দেন, ঢাকায় অপারেট করতে থাকা প্রত্যেক গেরিলার নাম, ঠিকানা, এমনকি আলতাফ মাহমুদের বাড়ি গিয়ে তাকে চিহ্নিতও করেন তিনি পাকিস্তানিদের সামনে। পাকিস্তানীদের কাছে নিশ্চিত গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে আবদুস সামাদ ওয়াজ ওয়ান অফ দ্য কিংস পিন, সামাদ বেশ কয়েকটা অপারেশনে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় রোল ছিল ম্যানেজিং থিংস। তিনি মোটামুটি প্রায় সব গেরিলাকে চিনতেন, তাদের অবস্থান জানতেন, পাকিস্তানিদের একজন আস্থাভাজন বিশ্বস্ত কন্ট্রাক্টর হিসেবে তার ভূমিকা আর গুরুত্ব আরবান গেরিলাদের কাছে ছিল অনেক বেশি। আর সবচেয়ে বড় কথা, ২৯শে আগস্টের আগেই সামাদের ব্যাপারে পাকিস্তানীদের কাছে নিশ্চিত তথ্য চলে আসে যে সে বিট্রেয়ার, সে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করছে। এমন নিশ্চিত তথ্য থাকা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্ত তথ্য জানা একজনকে ধরে নিয়ে যেতে অন্য কারোর সাহায্যের প্রয়োজন নেই। ২৯শে আগস্ট প্রথম বিট্রেয়ার ছিল ফরিদ, পরে সামাদকে ইন্টেরোগেট করার পরেই সে সবার কাভার ফাঁস করে দেয়।
১৯৭১ সালের ২৯শে আগস্ট সকালে বদি তার গোপন শেল্টার জালালউদ্দিন সাহেবের বাসায় তাস খেলছিল। খেলার একপর্যায়ে সকাল ১১টার দিকে ফরিদ উঠে গেল আড্ডা থেকে, চলে গেল বাড়ির বাইরে, একটু পর হঠাৎ করেই ফিরে এলো পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে। ফরিদের এই নির্লজ্জতম বিশ্বাসঘাতকতায় একেবারেই নিরস্ত্র অবস্থায় বিনা প্রতিরোধে ধরা পড়ে গেল ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম দুর্ধর্ষ গেরিলা বদিউল আলম বদি। শুরু হলো এক অচিন্তনীয় দুঃস্বপ্নের দিনরাত্রি…।
বদিকে প্রচণ্ড টর্চার করার পরেও সে কারো নাম বলেনি। একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি ট্রেনিং নিতে যাওয়া ও অস্ত্র আনার রুট সম্পর্কে। কিন্তু তাকে ধরিয়ে দেওয়া ফরিদের তথ্যে পাকিস্তানিরা বিকাল চারটা থেকে সাড়ে চারটার দিকে মগবাজার চীন দূতাবাসের পাশে ৪১৫, নিউ ইস্কাটন রোডের বাসা থেকে ঢাকার আরবান গেরিলা ওয়ারফেয়ারের অন্যতম সাহায্যকারী আবদুস সামাদকে ধরে ফেলে পাকিস্তানিরা। তার সঙ্গে ধরা পড়েন আবদুল হাফিজ। তিনি আলতাফ মাহমুদের সাথে গান গাইতেন, ক্র্যাক প্লাটুনের অনেকগুলো অপারেশনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। আবদুস সামাদ ছিল ঢাকা নিয়ন সাইনের মালিক, বেশ সুপরিচিত নিয়ন সাইনের ঠিকাদার, সে গেরিলাদের অনেককেই চিনতো, অনেকগুলো অপারেশনে সবকিছু গুছিয়ে দেওয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ১/৩, দিলু রোডে আলমদের বাড়ির প্রতিবেশী দেলোয়ার হোসেন আলমের বোন রেশমা ও আসমাকে দ্রুত এসে জানিয়ে যান যে, মগবাজারের চীন দূতাবাসের পাশের ভবনটি তিনি পাকিস্তানিদের ঘিরে ফেলতে দেখেছেন, তারা যেন সতর্ক হয়ে যায়।
২৯শে আগস্ট রাত ২টার সময় পাকিস্তানিরা গেরিলা মাসুদ সাদেক চুল্লুর বাসা ১, টেনেমেন্ট হাউজে রেইড করে পাকিস্তানিরা। চুল্লু তার বাসায় যে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ রাখা ছিল, সেগুলো ৩০ তারিখ সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার আগেই ২৯ তারিখ রাতে পাকিস্তানিদের রেইড হলো তার বাড়িতে। চুল্লু তার ঘরের কাপবোর্ডে স্যুট আর ঝোলানো কাপড়চোপড়ের ভেতরে রাইফেল আর ভারী অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রেখেছিলো। ভারী মেইন গেট ভেঙ্গে পাকিস্তানিরা ভেতরে ঢুকে চুল্লুর ঘরের দরজায় নক করলো, তার বড় ভাই এস এইচ কে সাদেক দরজা খোলার পর তাকে জিজ্ঞেস করলো, কে কে থাকে এই বাড়িতে? তার ভাই বুদ্ধি করে চুল্লুর নাম বললেন এ মাসুদ সাদেক। কিন্তু সেই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সব জেনেই এসেছিল। সে ডাকনাম জিজ্ঞেস করলো। বাধ্য হয়ে বড় ভাই ডাকনাম চুল্লু উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। তারা চুল্লুকে ধরে ফেললেও খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখায় অস্ত্র এবং গোলাবারুদগুলো খুঁজ পায়নি। শিকার পাওয়ার আনন্দে তারা এমনকি মেইন গেট দিয়েও বের হয়ে যায়নি, চুল্লুর ভাইকে বললো, চুল্লু ইতিমধ্যেই বহুবার দেয়াল টপকেছে, আমাদের সঙ্গে আরেকবার দেয়াল টপকে বেরোতে তার সমস্যা হবে না। এই বলে চুল্লুর হাত পিছমোড়া করে এবং চোখ দুটো কালো কাপড়ে বেঁধে রাইফেলের কুঁদো দিয়ে মারতে মারতে নিয়ে গাড়িতে তুললো।
ওদিকে আবদুস সামাদকে ধরার পরেই তার উপর টর্চার শুরু করে পাকিস্তানিরা, শেষপর্যন্ত স্ত্রী-সন্তানকে মেরে ফেলার ভয় দেখায়। ফলে একটা পর্যায়ে সে ঢাকায় অপারেট করা প্রায় সব গেরিলার নামই জানিয়ে দেয়। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একজন একজন করে গেরিলা ধরা পড়তে থাকে। তাকে নিয়েই পরদিন ৩০শে আগস্ট ভোরে আলতাফ মাহমুদের ৩৭০, রাজারাবাগের বাড়িটি ঘিরে ফেলে পাকিস্তানিরা। আলতাফ মাহমুদের বাড়িটি ছিল ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের সবচেয়ে বড় অস্ত্রাগারগুলোর একটি। তার ওপর মাত্রই এক সপ্তাহ আগে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এবং মেজর এটিএম হায়দারের বিশেষ নির্দেশে গেরিলাদের জন্য বড় ট্র্যাংকের দুই ট্র্যাংক ভর্তি অস্ত্র এবং গোলাবারুদ এনে তার বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলেন আলতাফ।
যখন পাকিস্তানি সেনারা চিৎকার করে বলতে লাগলো, মিউজিক ডিরেক্টর কৌন হ্যায়, আলতাফ মাহমুদ নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে শির উঁচু করে বেরিয়ে এলেন বীর, ভোরের পবিত্র আলোয় তাকে যেন অপার্থিব লাগছিল, বুকটা টান টান করে জবাব দিলেন, আমিই আলতাফ মাহমুদ, কি চাও তোমরা?
— হাতিয়ার কিধার হ্যায়?
আলতাফ বুঝে গেলেন ওরা সব জেনেই এসেছে। তার মাথায় একটাই ভাবনা ঘুরতে লাগলো, যেভাবেই হোক ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধাদের ও তার পরিবার-পরিজন সবাইকে বাঁচাতে হবে। বললেন, ‘এসো আমার সঙ্গে’। পাকিস্তানিরা তার হাতে কোদাল তুলে দিল, মাটি খুঁড়তে বললো। একটু দেরি হয়েছিল হয়তো, একজন রাইফেলের বাট দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখে মারলো, আরেকজন বেয়োনেট চার্জ করলো। একটা দাঁত ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল, কপালের চামড়া ফালাফালা হয়ে কেটে ঝুলতে লাগলো চোখের উপর…।
পাকিস্তানিরা তাকে দিয়েই সেই গর্ত খুঁড়িয়ে অস্ত্র বের করলো এবং তাকে তার আত্মীয় আবুল বারাক আলভী এবং চার শ্যালক নুহেল, খনু, লিনু এবং দিনুসহ মারতে মারতে বাইরে বের করে নিয়ে এলো। সেখানে সামাদ তাকে দেখিয়ে নিশ্চিত করে যে এটাই আলতাফ মাহমুদ।
আগের দিন বদি আর সামাদের ধরা পড়ার খবর পেয়ে ইশতিয়াক আজিজ উলফাত ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে যায়, বেবিট্যাক্সিতে চড়ে চলে যায় ৩০ নম্বর হাটখোলা, ফতেহ আলী চৌধুরী আর শাহাদাৎ চৌধুরীর বাসায়। গেটের সামনেই পেয়ে যায় ফতেহকে, জানায় রেইড আসন্ন। শাহাদাৎ চৌধুরী তখন মেলাঘরে, কিন্তু রিস্ক তারপরও ছিল। বাবা ডিসট্রিক্ট জজ আবদুল হক চৌধুরী। মা, তিনটা বোন মারিয়াম, ঝিমলি আর ডানা- প্রত্যেকেই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখা, সেগুলো পরিচর্যা করা, যত্ন নেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, আপনজনের মতো দেখভাল– সব কিছুই করতো এরা অদ্ভুত নিষ্ঠার সঙ্গে… তাই খবরটা পাওয়া মাত্র তিন বোনকে উলফাতের বেবিট্যাক্সিতে করেই আরেক বোনের বাসায় নিয়ে যায় ফতেহ। তারপর সেখান থেকে চলে যায় এলিফ্যান্ট রোড, জাহানারা ইমামের বাসা খুঁজতে। কিন্তু বহু খুঁজেও প্রিয় সহযোদ্ধা রুমীর বাসাটা খুঁজে পায় না ও। ভয়ংকর দুর্ভাবনায় বিফল মনোরথে ফিরে যায় ফতেহ। আর সেদিনই রাত ২ টায় ধানমণ্ডির কণিকা থেকে জামি, রুমী তাদের বাবা শরীফ ইমাম, মাসুম, হাফিজ এই পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা।
সেদিনের রাতের সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার লেখা একাত্তরের দিনগুলিতে বর্ণনা করেছেন এভাবে:
‘রুমী-জামীর ঘরের এক পাশে একটা ক্যাম্প খাট পেতে হাফিজের জন্য বিছানা পাতল রুমী-জামী মিলে। তারপর রুমী বলল, ‘আম্মা মাথাটা কেন জানি খুব দপদপ্ করছে। ভালো করে বিলি করে দাও তো। ‘
আমি রুমীর মাথার কাছে বসে ওর চুলে বিলি কাটতে লাগলাম, জামী, হাফিজ নিজের নিজের বিছানায় শুয়ে খুব নিচুস্বরে কথা বলতে লাগল। মাসুম পাশের ঘরে শোয়— সে উঠে এসে জামীর খাটে বসল। দু’ঘরের মাঝের দরজাটা নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিল। কথার শব্দ যেন বাবার কানে না যায়।
সাইড টেবিলে রেডিওটাও খোলা রয়েছে। একের পর এক বাংলা গান হচ্ছে। খুব সম্ভবত কলকাতা। হঠাৎ কানে এল ক্ষুদিরামের ফাঁসির সেই বিখ্যাত গানের কয়েকটা লাইন।
‘একবার বিদায় দেয় মা ঘুরে আসি।
ওমা হাসি হাসি পরব ফাসি
দেখবে জগৎবাসী। ‘
রুমী বলল, ‘কি আশ্চর্য আম্মা! আজকেই দুপুরে এই গানটা শুনেছি, রেডিওতেই। কোন স্টেশন থেকে জানি না। আবার এখনো রেডিওতে। একই দিনে দু’বার গানটা শুনলাম, না জানি কপালে কি আছে। ‘
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ নিচে গেটে ধমাধম শব্দ আর লোকের গলা শুনে চমকে জেগে উঠলাম। বাড়ির সামনের পুবদিকের জানালার কাছে উকি দিয়ে দেখি সর্বনাশ! সামনের রাস্তায় মিলিটারি পুলিশ। রাস্তার উজ্জ্বল বাতিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দৌড়ে রুমীদের ঘরে গিয়ে দেখি ওরা চারজনেই পাথরের মূর্তির মত ঘরের মাঝখানে দাড়িয়ে আছে। ওদের ঘরের পশ্চিমের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখলাম পেছনে বজলুর রহমান, সাত্তার ও কাসেম সাহেবদের বাড়িগুলোর সামনের রাস্তাতেও অনেক মিলিটারি পুলিশ। দক্ষিণের জানলা দিয়ে দেখলাম ডা: এ. কে. খান ও হেশাম সাহেবের বাড়ির সামনের জায়াগটাতেও পুলিশ। উত্তর দিকের জানালা দিয়ে দেখলাম আমার পুরো বাগান ভরে মিলিটারি পুলিশ দাড়িয়ে আছে। অর্থাৎ বাড়িটা একবারে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে।
আবার রুমীদের ঘরে গেলাম। রুমী দু’একবার অস্থিরভাবে পায়চারি করে বলল, কোনদিক দিয়েই পালাবার ফাঁক নেই। মনে হয় হাজারখানেক পুলিশ এসেছে। রাস্তার বাতিগুলোও এমন জোরালো, একেবারে দিনের মত করে রেখেছে। ‘
আমি উদ্ভ্রান্তের মত ঘরের চারদিকে তাকিয়ে ভাববার চেষ্টা করলাম, কোনোখান দিয়ে কোনোভাবে রুমীকে পার করে দেয়া যায় কিনা! না, কোন দিক দিয়েই কোন ফাঁক নেই। পুর বাড়িটার যতো জানালা সবকটাতে গ্রিল, পুরো বারান্দা কঠিন গ্রিলে আবদ্ধ। সিড়ি দিয়ে একতলায় নেমে পেছনের উঠানে নামবে, তারও উপায় নেই। পেছনের বাউন্ডারি ওয়াল খুব নিচু। পেছনের রাস্তার বাতি আর অসংখ্য পুলিশের চোখ এড়িয়ে উঠান দিয়েও পালানো সম্ভব নয়।
ওদিকে সামনের গেটে অসহিষ্ণু হাতের ধমাধম বাড়ি আর ক্রুদ্ধ কণ্ঠের হাঁকডাক ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমি আর শরীফ পরস্পরের দিকে তাকালাম। এই মুহূর্তে আমার মনের ভেতরে কোন অনুভূতি আমি টের পাচ্ছি না। ভয়-ভীতি-উদ্বেগ সব ফ্রিজ হয়ে আমি যেন পুতুলনাচের পুতুল হয়ে গেছি। কেউ দড়ি দিয়ে যেন আমাকে ঘোরাচ্ছে, ফেরাচ্ছে, চালাচ্ছে। শরীফের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘চল, সামনের বারান্দায় বেরিয়ে জিগ্যেস করি, কি চায়। ‘
দু’জনে পুবদিকের ছোট বারান্দায় বেরোলাম। শরীফ বলল, ‘কে ডাকেন? কি চান?’
নিচে থেকে কর্কশ গলায় উর্দুতে কেউ বলল, ‘নিচে এসে দরজা খুলুন। এত দেরি করছেন কেন?’
শরীফ আবার বলল, ‘ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে। এত রাতে কি দরকার?’
এবার অন্য একজন একটু মোলায়েমভাবে উর্দুতে বলল, ‘বিশেষ কিছু নয়। দরজা খুলুন। ‘
আমি আর শরীফ দু’জনে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলাম। দেয়ালে ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলাম বারোটা বেজে দশ মিনিট।
সদর দরজা খুললেই পোর্চ। রাতে সামনে-পেছনে কোলাপসিবল গেট টেনে নিলে ওটা গ্যারেজ হয়ে যায়। শরীফ দরজা খুলে কোলাপসিবল গেটের ভেতর থেকে লাগানো তালা খুলে গেট ফাঁক করল। একজন খুব অল্পবয়সী আর্মি অফিসার দাড়িয়ে আছে, তার পাশে ও পেছনে তাগড়া চেহারার অনেকেই। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘হোয়াট ক্যান উই ডু ফর ইউ?’
অফিসারটি হাত তুলে সালাম দেবার ভঙ্গি করে ইংরেজিতে বলল, ‘আমার নাম ক্যাপ্টেন কাইয়ুম। তোমাদের বাড়িটা একটু সার্চ করব। ‘
আমি বললাম, ‘কেন, কি জন্য?’
‘এমন কিছু না। এই রুটিন সার্চ আর কি। তোমাদের বাড়িতে মানুষ কয়জন? কে কে থাকে?’
আমি বললাম, ‘আমি, আমার স্বামী, শ্বশুর, দুই ছেলে, ভাস্তে। ‘
‘ছেলেদের নাম কি?
‘রুমী, জামী’
ওরা এগিয়ে এলো। আমি একটু পাশ কেটে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘দ্যাখো, আমার শ্বশুর বুড়ো, অন্ধ, হাই ব্লাড প্রেসারের রুগী। তোমাদের প্রতি অনুরোধ, তোমরা শব্দ না করে বাড়ি সার্চ কর। উনি যেন জেগে না যান। ‘
ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে দেখলে মনে হয় কলেজের ছাত্র। ফর্সা, পাতলা গড়ন, খুব মৃদুস্বরে ধীরে কথা বলে। তার সঙ্গের সুবেদারটি দোহারা, মধ্যবয়সী। উর্দু উচ্চারণ শুনে বোঝা যায় বিহারী।
ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সঙ্গে ওই সুবেদার আর তিন-চারজন সশস্ত্র এম.পি, ঘরের ভেতরে ঢুকল। এবং মুহূর্তে কয়েকজন একতলায়, কয়েকজন দোতলায় ছড়িয়ে পড়ল। অভ্যস্ত নিপুণতার সঙ্গে ওরা প্রত্যেকটি ঘরের আলমারি, দেরাজ চেক করে দেখল, পেছনের দরজা খুলে উঠানে উঁকি মারল, বাবার ঘরে পা টিপে টিপে হাঁটল, রুমীদের সবাইকে নাম জিগ্যেস করে নিচে নেমে যেতে বলল। আমি প্রায় সব সময়ই ওদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিলাম। জিগ্যেস করলাম, ‘কেন, ওদের নিচে যেতে বলছ কেন?’
ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বলল, ‘কিছু না, একটুখানি রুটিন ইন্টারোগেশান করব। ‘
শরীফের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনিও নিচে আসুন। ‘ ওদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও নিচে নেমে এসে দেখলাম রুমী, জামী, মাসুম আর হাফিজ পোর্চে দাড়িয়ে আছে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম পোর্চে এসে শরীফকে বলল, ‘এটা আপনার গাড়ি? চালাতে পারেন?’ শরীফ ঘাড় নাড়লে সে বলল, ‘আপনি গাড়ি চালিয়ে আমাদের সঙ্গে আসুন। ‘
আমি ভয় পেয়ে বলে উঠলাম, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
ক্যাপ্টেন কাইয়ুম শান্ত মৃদুস্বরে বলল, ‘এই তো একটু রমনা থানায়। রুটিন ইন্টারগেশান। আধঘন্টা পৌনে একঘন্টার মধ্যেই ওরা ফিরে আসবে। ‘
ক্যাপ্টেনের ইঙ্গিতে কয়েকজন পুলিশ গাড়ির পেছনে উঠে বসল। আমি ব্যাকুল হয়ে বলে উঠলাম, ‘আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে। ‘
শরীফ এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি, এবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ‘তুমি থাক। বাবা একলা। ‘
তবু আমি বলতে লাগলাম, ‘না, না, আমি যাব। ‘
বিহারি সুবেদারটি ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, ‘মাইজী, আপুনি থাকেন। এনারা এক ঘোন্টার মধ্যে ওয়াপস আসে যাবেন। ‘ শরীফ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বোধ হয় নীরবে কিছু বলবার চেষ্টা করছিল। আমি হঠাৎ যেন সম্বিত পেয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। তাকিয়ে দেখলাম কয়েকজন পুলিশ রুমী, জামী, মাসুমদের হটিয়ে রওনা হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম শরীফের পাশের সিটে উঠে বসল। শরীফ গাড়ি ব্যাক করে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ‘
একই সময়ে আরও রেইড হয় শাচৌ-ফতেহর হাটখোলার বাসায়, দুই গেরিলাকে না পেয়ে সেনারা বাড়ির জামাই বেলায়েত হোসেনকে ধরে নিয়ে যায়। বড় মগবাজারে আজাদের বাসায় রেইড চালায় পাকিস্তানিরা আলবদর সদস্য কামরুজ্জামানের তথ্যে। কামরুজ্জামান আলবদর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামীর নির্দেশে আজাদদের মহল্লায় অনেকদিন ধরেই খোঁজ রাখছিল। সবাইকে এক সারিতে দাঁড় করানোর পর সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশন চালাতে গিয়ে আঙ্গুলে গুলি লাগা আহত জুয়েলের ব্যান্ডেজ বাঁধা আঙ্গুলগুলো মুচড়ে দিয়ে পাকি ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করে, অস্ত্র কোথায়? এরমধ্যেই কাজী কামালউদ্দিন অস্ত্র ছিনিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর গুলি চালিয়ে হাতাহাতিতে জিতে জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর পাকিস্তানিরা উন্মাদের মত অত্যাচার চালায় আজাদ-জুয়েল-বাশার-সেকেন্দার হায়াতসহ উপস্থিত সবার ওপরে। তারপর তাদের গাড়িতে তোলা হয় টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আজাদের বাড়ির হাইডআউট থেকেও পাকিস্তানিরা প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ খুঁজে পায়।
আজাদ-জুয়েল-বাশার-হায়াৎদের ধরা পড়ার এই ঘটনাটা আনিসুল হক তার বই ‘মা’-তে তুলে এনেছেন এভাবে:
“সৈন্যরা এসেই বলে, ‘আজাদ কোন হ্যায় ৷’
কেউ স্বীকার করে না ৷
আজাদকে ওরা জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমারা নাম কিয়া ?’
আজাদ বলে, ‘মাগফার আহমেদ চৌধুরী হ্যায় ৷’
কম্যান্ডো ধরনের লোকটা বলে, ‘তুম আজাদ হ্যায় ৷’
‘মে আজাদ নেহি হ্যায় ৷’
‘শালা মাদারচোদ, তুম নাম কিউ নিদানা হ্যায় ৷’ সে আজাদের ঘাড়ে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি মারে ৷
ইতিমধ্যে অন্য ঘর থেকে টগর, চঞ্চল, মনোয়ারকেও এনে একপাশে লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে ৷ মোট আটজন বাঙালি বিভিন্ন বয়সের পুরুষ এখানে বলির পাঁঠার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, কাজী কামাল খেয়াল করে ৷ আজাদ, জুয়েল, বাশার, সেকেন্দার, মনোয়ার হোসেন, জায়েদ, টগর, চঞ্চল…।
হঠাৎই ক্যাপ্টেন বুখারি লক্ষ করে, একটা ছেলের হাতের আঙুলে ব্যান্ডেজ দেখা যায় ৷ সে জুয়েলের জখমি জায়গাটা চেপে ধর বলে, ‘বাস্টার্ড, হোয়ার আর দি আর্মস?’ ব্যথায় জুয়েল ‘ও মাগো’ বলে কুঁকিয়ে ওঠে ৷ কাজী কামালের মাথায় রক্ত উঠে যায়৷ সে নিজের ডান হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, আয়ুরেখা বড় আর স্পষ্ট ৷ তার মানে এখানে তার মরণ নাই ৷ সে হঠাৎই মেজরের হাতের স্টেনগানটার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু হাতে স্টেন ধরে ফেলে ৷ মুহূর্তের মধ্যে এ কাণ্ড ঘটে যায় ৷ স্টেনের দখল কে নেবে এই নিয়ে টানাটানি হতে থাকে ৷ ট্রিগারে কাজীর হাত ৷ গুলি বেরুতে থাকে ৷ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় গুলির শব্দে ৷ সেদিন একমাত্র কাজীই ভাগ্যের লড়াইয়ে জিতে গিয়েছিলো…।
বাঙ্গালী জাতির চিরশোকের মাসটার নাম আগস্ট। এই মাসের শেষটা হয়েছিল আরও বেদনাদায়ক, আরো করুণভাবে। কেমন লাগছিল তখন বদিউল আলমের? প্রিয় বন্ধু ফরিদ যখন ফিরে এলো পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে, কেমন লাগছিল ওর? ও কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিলো, একে একে ধরা পরে যাবে ওদের সবাই। খুব জানতে ইচ্ছা করে। এই দিনটা সহ্য করা কঠিন। চিন্তা-চেতনাকে অবশ করে দেয়, শোকে ঢাকা আগস্ট মাসটা এর চেয়ে ভয়ংকর যন্ত্রণায় শেষ হতে পারতো না! ২৯শে আগস্ট, ১৯৭১… বড় যন্ত্রণা আর প্রবল হাহাকারের গল্প…
তথ্য কৃতজ্ঞতা:
১। একাত্তরের দিনগুলি/ জাহানারা ইমাম
২। ব্রেইভ অফ হার্ট/ হাবিবুল আলম বীর প্রতীক
৩। সুরের বরপুত্র আলতাফ মাহমুদ/ দিনু বিল্লাহ
৪। মা/ আনিসুল হক
৫। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদের নানা সময়ে দেওয়া সাক্ষাৎকার
সারাবাংলা/এসবিডিই
ফিচার মুক্তিযুদ্ধ যেদিনে হারিয়ে গিয়েছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা রাতিন রহমান