Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্রিকেটার আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল

রাতিন রহমান
৩০ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৩৮

দুর্ধর্ষ মারকুটে ব্যাটসম্যান ছিল ছেলেটা, ব্যাট হাতে মাঠে নামার পর বোলারদের নাকের জল, চোখের জল এক হয়ে যেতো। আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ওপেনিংয়ে নামত, ৪৫ ওভারের ম্যাচ। টর্নেডো বইয়ে দিত একেবারে, ধুমধাড়াক্কা মারের চোটে বিপক্ষ দল চোখে অন্ধকার দেখত, বলের লাইন-লেন্থ কোথায় উড়ে যেতো! স্লগ সুইপটা অসাধারন খেলত, বল জিনিসটা যে পেটানোর জন্য, এইটার সবচেয়ে বড় উদাহরন ছিল ওর ব্যাটিং। করাচির লিগের এক ম্যাচে একদিন ওর তুমুল মার দেখতে দেখতে এক পাঞ্জাবি কোচ সবিস্ময়ে বলে উঠলো, এই ছেলে এইখানে কেন? ওর তো ন্যাশনাল টিমের হয়ে ওপেনিং করার কথা!

বিজ্ঞাপন

কথাটা খুব সত্য ছিল, কিন্তু অবাস্তব সত্য। ছেলেটা বাঙ্গালী, আর পাকিস্তান নামক পোকায় কাটা রাষ্ট্রটায় বাঙ্গালীর অবস্থান ছিল কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট, গোলামেরও চেয়েও অধম। ছেলেটার স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া, ছেলেটা ন্যাশনাল টিমের হয়ে ওপেনিং করার স্বপ্ন দেখত। স্বাধীন বাংলাদেশ দলের ওপেনিং করবার স্বপ্ন…।

১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ জেলা ক্রীড়া ভবনের সামনে সদাহাস্যজ্জ্বোল মুশতাক ভাইয়ের দু’হাত উপরে তোলা মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখার পর ছেলেটার স্বপ্নটা একটা ধাক্কা খেলো। দেখলো আজাদ বয়েজ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মুশতাক আহমেদের নিষ্প্রাণ ঝাঁজরা দেহটা পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। হাতদুটো উপরে তোলা। অজাতশত্রু মুশতাক ভাইয়ের কোনও ঘোরতর সমালোচকও এই অপবাদ দিতে পারবে না, তিনি কাউকে কোনোদিন একটা গালি দিয়েছেন। ক্রিকেট ছিল তার ধ্যান, একমাত্র সাধনা। বিনা অপরাধে এইভাবে মরতে হবে, মৃত্যুর আগমুহূর্তেও হয়তো এটা তার কল্পনাতে ছিল না। মুশতাক ভাইয়ের সেই দৃষ্টি ছেলেটার মাথায় গেঁথে গেল, ব্যাট ফেলে তুলে নিল স্টেনগান, পাকি শুয়োরগুলারে মারতে হবে, দেশটারে স্বাধীন করতে হবে…!

প্রথমে বাঁধা হয়ে এসেছিল স্নেহময়ী মা। ছোটবেলা থেকে যক্ষের ধনের মত আগলে রাখা মায়ের চোখকে ফাকি দিয়ে মে মাসের ৩১ তারিখ বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় ছেলেটা। প্রতিপক্ষের বোলারদের এতটুকু চড়াও হতে না দেওয়ার মানসিকতা যার, অ্যাটাক ইজ দা বেস্ট ডিফেন্স ছিল যার মুলমন্ত্র, সে কিভাবে দেশের এই দুঃসময়ে নিজেকে ঘরে আটকে রাখবে? তাই দেশমাতা সম্ভ্রম রক্ষায় বেরিয়ে গিয়েছিল ও, যাবার কদিন আগে মাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিল, ‘আমি যখন থাকবো না, এই ছবিটাতে তুমি আমাকে দেখতে পাবে।’

বিজ্ঞাপন

দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফের নির্দেশে গেরিলা ওয়ারফেয়ারের কিংবদন্তী মেজর এটিএম হায়দার ১৭ জন তরুনকে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে ঢাকায় অপারেশনে পাঠান। এরাই পরবর্তীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অকল্পনীয় ত্রাস ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ এ পরিণত হয়। ছেলেটা এই ১৭ জনেরই একজন ছিল। সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনের রেকি করতে গিয়ে রামপুরা বিলে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিবর্ষণে ডানহাতের তিনটা আঙ্গুল ভেঙ্গে গর্ত হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার। হাতটাকে পচনের হাত থেকে বাঁচাতে আঙ্গুলগুলা কেটে ফেলতে হবে, হঠাৎ ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে আর্তি জানাল ছেলেটা, ‘দেশ স্বাধীন হইলে আমি ন্যাশনাল টিমের হইয়া ওপেনিংয়ে নামুম, ক্যাপ্টেন হমু। আঙ্গুল তিনটা রাইখেন স্যার, প্লিজ…!’

২৯’শে আগস্ট ছেলেটা মগবাজারে আজাদের বাসা আহতাবস্থায় আজাদ, বাদলসহ আরও কয়েকজনের সাথে ধরা পড়ে। ধরা পড়ার সময় ব্যান্ডেজে মোড়া ভাঙ্গা আঙ্গুল তিনটা খাবলে ধরে যখন মোচড় দিচ্ছিল পাকিস্তানি আর্মির ক্যাপ্টেন, তখনও স্বপ্নটা ছেলেটাকে ঘিরে ছিল। টর্চার সেলে আঙ্গুলগুলোর উপর হাতুড়ির বাড়ি পড়তো প্রতিদিন নিয়ম করে, প্লায়ার্স দিয়ে মুচড়ে ধরে জিজ্ঞেস করতো, ‘মুক্তিকা রুট কিধার হ্যায়, হাতিয়ার কাহা সে আ রাহা?’ অচিন্তনীয় যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকা ছেলেটাকে তখনও ওপেনিংয়ে নামার স্বপ্নটা ছেড়ে যায়নি। স্বপ্ন বোধহয় বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিল ছেলেটাকে…।

ক্রিকেটমাঠে জীবনের শেষ ইনিংসে ছেলেটা অপরাজিত ছিল, অপরাজিত ছিল তিনটা আঙ্গুল ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও। ভাঙ্গা আঙ্গুল তিনটা বুটের নিচে পিষে ফেলার সময় অমানুষিক যন্ত্রণা হচ্ছিল, কিন্তু ছেলেটা হেরে যায়নি। ‘কাহা সে ট্রেনিং লেকে আতা তুম লোগনে? কিধার সে আর্মস আতা?’ প্রশ্নগুলো সহস্রবার করেছে পাকি হায়েনারা, উত্তর না পেয়ে আঙ্গুলের পর বেয়নেট দিয়ে একটু একটু করে ফালা ফালা করেছে ছেলেটার শরীরটা, ছেলেটা হেরে যায়নি। চিৎকার করেছে, যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, মা মা বলে ডেকেছে আকুতিভরে, তবুও একটা কথাও বলেনি সে। তার সহযোদ্ধাদের পরিচয়, অস্ত্রের চালান কিংবা ট্রেনিংয়ের রুট, কিছুই বলেনি। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনেও অপরাজিত ছিল ছেলেটা, মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে! হেরে যাওয়াটা যে তার অভিধানে ছিল না…।

ছেলেটা খুন করেছে হায়েনারা। স্বাধীন বাংলাদেশ দলের হয়ে ওপেনিং করার স্বপ্ন দেখা ছেলেটা আর কখনওই ফিরে আসেনি। ছেলেটার নাম ছিল জুয়েল, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল! নতুন প্রজন্মের একাংশের কাছে ‘উনিশশো কটকটি সালের ইতিহাস’ হয়ে যাওয়া যার ক্ষতবিক্ষত লাশের উপর তবুও দাড়িয়ে আছে একটা স্বাধীন দেশ, যার বুকের টকটকে রক্তস্রোত জমাট বেঁধে আছে একটা দেশের পতাকায়, সবুজ জমিনের ঠিক মাঝখানে। গর্বে; অসম্ভব গর্বে…!

তথ্য কৃতজ্ঞতা:
১। ব্রেইভ অফ হার্ট: হাবিবুল আলম বীর প্রতীক

সারাবাংলা/এসবিডিই

ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রাতিন রহমান শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্রিকেটার আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

শরৎ বাংলাদেশের কোমল স্নিগ্ধ এক ঋতু
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৪

সম্পর্কিত খবর