লোককবি সুফিসাধক আস্কর আলী পণ্ডিত
৩০ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৫৫
“ডালেতে লরি চরি বইও চাতকি ময়নারে গাইলে বইরাগীর গীত গাইও অঙ্গ তোর কালারে ময়না, অঙ্গ তোর কালা তোর মনে আর আমার মনে একই প্রেমের জ্বালা”, “না রাখি মাটিতে না রাখি পাটিতে, না রাখি পালঙ্কের উপরে, সিঁথির সিঁদুরে রাখিব বন্ধুরে ভিড়িয়ে রেশম ডোরে, কী জ্বালা দিয়ে গেলা মোরে নয়নের কাজল পরানের বন্ধুরে, না দেখিলে পরান পোড়ে, কি দুঃখ দিয়ে গেলা মোরে, নয়নের কাজল পরানের বন্ধুরে না দেখিলে পরান পোড়ে”। গানের কথাগুলো শোনলে যে কারও হৃদয় ছোঁয়ে যাবে।
ভাঙ্গা হৃদয়ের জন্য গানটি হবে মনের দাওয়াইয়ের মতো। গানগুলি লিখেছেন প্রয়াত লোককবি আস্কর আলী পণ্ডিত। আসকর আলী পণ্ডিতের মাজার যেতে হলে, পটিয়া সদর বাস স্টেশন থেকে সিএনজি যোগে অথবা রৌশন হাট গিয়ে সেখান থেকে রিকশা যোগে একটু ভিতরে গেলে চোখে পড়বে চমৎকার শোভনদণ্ডী গ্রাম। যার পূর্ব নাম ছিল অঁইন্দার। একটু ভিতরে গেলে পুকুরের পশ্চিম পাশে দেখা যাবে সুফি সাধক আস্কর আলী পণ্ডিতের মাজার।
আস্কর আলী পণ্ডিত ১৮৫৫ সালে (মতান্তরে ১৮৪৬) সালে পটিয়া শোভনদণ্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, আবার কেউ কেউ বলে তাঁর গ্রাম সাতকানিয়ার পুরাণগড়। পিতার নাম মোসারফ আলী। পিতামহের নাম ডোমন ফকির। তাঁর পুরুষদের বাড়ি ছিল সাতকানীয়ার বাজালিয়া গ্রামে। নয় বছর বয়সে আস্কর আলী পণ্ডিতের বাবা মারা যান। আস্কর আলী ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, পদকার, পুঁথিকার ও কণ্ঠশিল্পী। তিনি বেশ কিছু বইও রচনা করেছেন,বর্গাশাস্ত্র, নন্দবিহার, নন্দবিলাস, গীত বারমাস, সতী সঙ্গিনী, হাদিস বাণী ও নাটক কাজীর পাট। সুফিসাধক আস্কর আলীর পুঁথিগত বিদ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও যে তাঁর আধ্যত্বিক ও গায়েবি এলম ছিল সেটা বুঝা যায়। জ্ঞান চৌতিসা তিনি লিখেছেন- “ধনজন হীন বিদ্যা শিখিতে না পারি, কিঞ্চিত দিলেক প্রভু সমাদর করি”।
আস্কর আলী পণ্ডিতের ‘জ্ঞান চৌতিসা’ পুঁথি নামে একটা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার জীবদ্দশায় পুঁথিটি প্রকাশিত হয়নি তার মৃত্যুরপর পুথিঁটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। কবি বলেন- “পুন সেই পুস্তক রচিতে হৈল মতি, শ্রীযুক্ত আবদুল হাদি করিল আরতি”। জ্ঞান চৌতিসা মূলত প্রণয় কাহিনীকাব্য। আস্ক আলী পণ্ডিত শেষ বয়সের রচনা করেন ‘পঞ্চসতী প্যারজান’ কবি লিখেছেন- “দন্ত ছিল জুবা কালে ইক্ষু খাই শুতি, তখনে কহিছি রাস চৌতিসার পুঁথি। দন্ত গেল ঝরিয়া বয়স হইল শেষ, অম্ল রস পানে এবে পিত্ত হৈল বেশ”।
সুফিসাধাক আস্কর আলীর পণ্ডিতে পুর্বপুরষদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সুফিসাধক দরবেশ ছিলেন। তিনি পারিবারিক ও সামাজিক গৃহস্থী কাজ করতেন এছাড়া তিনি ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণ মুসলামান সারাক্ষণ ইবাদত বন্দেগিতে মুশগুল থাকতেন। সে সময়ে নাকি তিনি মক্কা শরিফে গিয়ে পবিত্র হজ সম্পন্ন করেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের গীতিকার আবদুল গফুর হালী আস্কর আলী পণ্ডিতের সুহবত পেয়েছেন। গফুর হালী আস্কর আলী পণ্ডিতের প্রতি খুব সম্মান দেখাতেন।
আস্কর আলী যেভাবে সুফিসাধক হয়ে উঠেন─ কথিত আছে তৎকালীন প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আস্কর আলী পন্ডিতের ঘরে ধারা হতো (ইসলামিক গানের আসর) হতো। রমজান মাসের এক বৃহস্পতিবারে রাতে চায়ের দোকানে বসে তার ভক্ত ও সাথীদের বললেন, তোমরা আগামী বৃহস্পতিবার আসবা না। ধারা বন্ধ থাকবে। তবে তোমরা শুক্রবারে সবাই এসো। সবাই কিছুটা বিস্মিত ও অবাক হলেন। হঠাৎ সুফি সাধক একথা কেন বললেন ? সবার মনে কৌতুহল। সেদিন রাতে সবাই চলে গেলেন। একজনকে বললেন আপনি যাবেন না। আপনার সাথে কিছু কথা আছে। আপনি কাউকে বলবেন না। আপনি আজ রাতে কবর স্থানে গিয়ে আমার জন্য একটা কবর খনন করবেন। ১৯২৭ ইং ১২৮৮ মঘি ২৭ ফাল্গুন বৃহস্পতিবার আস্কর পন্ডিত তারাবী নামায আদায়ের পর চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিলেন। আড্ডার মাঝে বন্ধু বান্ধবদের সাথে গানও গাইলেন। সবার কাছ থেকে হাসি মুখে বিদায় নিলেন। বাসায় গিয়ে পুত্র বধুকে বললেন, আমার জন্য পাটি আর চাদর ধুয়ে রাখতে বলেছিলাম রেখেছেন কি? ধুয়ে রাখলে সেগুলো নিয়ে এসো। পুত্র বধু পরিচ্ছন্ন পাটি আর চাদর নিয়ে এলো।
অতঃপর সুফি ও লোককবি আস্কর আলী পণ্ডিত বললেন, “এগুলো বিছিয়ে দাও পূর্ব পশ্চিম নয় উত্তর দক্ষিন করে বিছিয়ে দাও। বিছানা করার পর বললেন আমার মেয়েকে ডেকে এনো। মেয়েকে পাশের বাড়ি থেকে খবর দিয়ে ডেকে আনা হলো। মেয়েকে বাবার পাশে বসতে বললো । মেয়ে বসল আস্কর আলী তার মেয়েকে বললেন, আমার ডান পাশে খনন করে দেখ মাটির নিচে একটা গডি বা কলসি আছে। কলসি ভর্তি রৌপ্য মুদ্রা আছে । এ মুদ্রা মা তোমার জন্য তুমি তোমার নিজের জন্য এ মুদ্রা ব্যয় করো।
বাম পাশে খনন করে দেখ আরেকটি গডি ভর্তি রৌপ্য মুদ্রা আছে । এ মুদ্রা দিয়ে আমার জন্য একটা জেয়াফতের আয়োজন করো। এই কথা বলে তিনি চাদর মুরি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। দু-চার মিনিট পড় সবাই দেখল কোন সাড়া শব্দ নেই। মেয়ে জামাই চাদর তুলে দেখলেন। তার শশুড় বাপজান আর এ জগতে নেই। রাত্রিকালে গ্রামবাসীর ঢল নামল আস্কর আলী পণ্ডিতকে দেখতে। প্রয়াত পুথিঁ গবেষক ইসহাক চৌধুরী আসকর আলী সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, “যে মৃত্যুকে চিনতে পারেনি সে কি ফকির হলো। আস্কর আলী মৃতুকে চিনতে পেরেছিল বলে তিনি ফকির সুফি হয়েছেন”। ১৯২৬ সালের পবিত্র রমজান মাসের কোন এক রজনীতে ৪ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তান রেখে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যান।
তথ্য ঋণ- প্রয়াত পুঁথিগবেষক ইসহাক চৌধুরী, এবং আহমদ মমতাজ ও রাইহান নাসরিন সম্পদিত চট্টল মনীষা।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সমন্বয় সহকারী ইতিহাসের খসড়া
সারাবাংলা/এজেডএস