মাগফার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আজাদ, অকুতোভয় এক বীরযোদ্ধা
৩০ আগস্ট ২০২৩ ১৫:০৩
“চাচি, আল্লাহর কাছে শোকর করেন। আমি আছি বইলাই আজাদরে ছাইড়া দেওয়ার একটা সুযোগ আইছে। উনারে ক্যাপ্টেন সাব পাঠাইছে। কি কয় মন দিয়া শুনেন। ’
সাদা শার্ট-কালো প্যান্ট পরা আর্মিছাটের কাটা চুলের মানুষটা সাফিয়া বেগমের দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তার গলার স্বরটা ততোধিক ঠাণ্ডা শোনায়,
–আজাদের সাথে দেখা করতে চান?
–জি।
–ছেলেকে ছাড়ায়ে আনতে চান?
–জি!
–আজকে রাতে আজাদকে রমনা থানায় নিয়ে আসবে। দেখা করায়া দিব ওর সাথে। বুঝলেন?
–জি।
–তার সাথে দেখা করবেন। দেখা করে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়। অস্ত্র কোথায় রেখেছে, তা বলে দেয়।
–জি?
–সে যদি সব বলে দেয়, তাকে রাজসাক্ষী বানানো হবে। ছেলেরে যদি ফিরে পাইতে চান, তারে সব বলতে বলবেন।
আজাদের মা লোকটার পাথুরে মুখের দিকে তাকান। তার চোখে নিঃস্পন্দ শুন্য দৃষ্টি। গরাদের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা আজাদকে তার মা চিনতে পারেন না। প্রচণ্ড মারের চোটে চোখ-মুখ ফুলে গেছে, ঠোঁট কেটে ঝুলছে, ভুরুর কাছটা কেটে গভীর গর্ত হয়ে গেছে।
–মা, কি করব? এরা তো খুব মারে। স্বীকার করতে বলে সব। সবার নাম বলতে বলে।
–বাবা, তুমি কারোর নাম বলোনি তো?
–না মা, বলি নাই। কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরও মারে, যদি বলে দেই…!
–বাবারে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারো নাম বলো না।
–আচ্ছা মা। ভাত খেতে ইচ্ছে করে। দুইদিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।
–আচ্ছা, কালকে যখন আসব, তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসবো।
সাফিয়া বেগমের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক, ছেলের গায়ে একটা ফুলের টোকা লাগতে দেননি কোনোদিন। সেই ছেলেকে ওরা এভাবে মেরেছে। এভাবে…!
মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা আর বেগুনভাজি টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে পরদিন সারারাত রমনা থানায় দাড়িয়ে থাকেন সাফিয়া বেগম, কিন্তু আজাদকে আর দেখতে পাননি। তেজগাঁও থানা, এমপি হোস্টেল, ক্যান্টনমেন্ট- সব জায়গায় খুঁজলেন, হাতে তখন টিফিন ক্যারিয়ার ধরা, কিন্তু আজাদকে আর খুঁজে পেলেন না।
ক্র্যাক প্লাটুনের বাকি সদস্যদের মত আজাদকে আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৯৮৫ সালের ৩০শে আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাফিয়া বেগম আর কখনও বিছানায় শোননি। শক্ত মেঝেতে মাথার নিচে একটা ইট দিয়ে ঘুমিয়েছেন। কারন নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরী সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে তার ছেলেকে তিনি মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন, কাঁটাছেঁড়া শরীরে কোনও রকমে পড়ে থাকা। আর একটাবারের জন্যও কোনোদিন ভাত মুখে তোলেননি সাফিয়া বেগম। বেঁচে থাকার জন্য রুটি খেয়েছেন, পানি দিয়ে ভিজিয়ে পাউরুটিও খেয়েছেন কখনও কখনও। কিন্তু ভাত না। তার আজাদ যে ভাত খেতে চেয়েও ভাত খেতে পায়নি…!
তথ্য কৃতজ্ঞতা:
১। ব্রেইভ অফ হার্ট: হাবিবুল আলম বীর প্রতীক
সারাবাংলা/এসবিডিই
ফিচার মাগফার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আজাদ মুক্তিযুদ্ধ রাতিন রহমান