বৃক্ষ ও বইপ্রেমী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৩০ আগস্ট ২০২৩ ১৫:১৮
“বস্তুত বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতাঞ্জলি নয়, বলাকা নয়, সোনার তরী নয়। আর দাবায়ে রাখবার পারবা না”(শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ- কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা)।
পল্লীবাংলার সৃজনশীল সাহসী মানুষরা অবহেলা উৎসাহ ও অনুপ্রেরণাবিহীন পরিবেশে বেড়ে উঠে অনেকে হয়তো মুখ তুলেও তাকায় না। একটা সময় যখন দেখতে পায় সৃষ্টিশীল সাহসী বীরপুরুষটি যখন তার জিয়নকাঠির আলো ছড়িয়ে দেশ ছাড়িয়ে পুরো এশিয়ায় বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। যার মুনশিয়ানায় একটা স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের দিকপাল যাকে বলা হয় স্বাধীনতার ঘোষক। কে না চায় তাকে ভালোবাসতে কিংবা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে। একটা সময় তিনি সমগ্র দেশে সর্বজনশ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন। ছোটোবেলা থেকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছি। বই পড়ে জানলাম অনেক বড়মাপের রাজনীতির কবি কীর্তিমান টুঙ্গিপাড়ার দস্যিছেলে শেখ মুজিবুর রহমান। জন্ম-শতবর্ষে তাকে জানার কৌতূহল পেয়ে বসে। এই মহান গুণী মানুষটির জন্ম-শতবর্ষে কত গল্প, কবিতা-ছড়া-ইতিহাস-প্রবন্ধ রচিত হয়েছে ইয়ত্তা নেই। এই গুণী মানুষটা যে বৃক্ষ ও বইপ্রেমী ছিলেন তা জেনেছি বই পড়ে এবং ভ্রমণ করতে গিয়ে।
২০১৫ সালের কথা, অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়েছিলাম বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলায়। ফকিরহাট থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া খুব কাছে। মাসুম ভাইকে বললাম, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের কবর জেয়ারত করতে হবে এবং বঙ্গবন্ধুর আদি নিবাস,তার নিজ গ্রাম দেখার খুব ইচ্ছা। ফকিরহাট থেকে আমরা যাচ্ছিলাম টুঙ্গিপাড়ায়। বেশ প্রশস্ত রোড, দুপাশে ধানিজমি সবুজশ্যামলে ঘেরা, মাঝে মাঝে চিংড়ি ঘের।
একসময় গোপালগঞ্জ ছিল ফরিদপুর জেলার ছোট্ট একটা মহকুমা। গোপালগঞ্জ মহকুমাকে পরবর্তীতে জেলায় রূপান্তর করা হয়। গোপালগঞ্জ জেলার ছবির মতো ছোটো একটি থানা টুঙ্গিপাড়া। মধুমতী নদীর তীরে অবস্থিত। মধুমতী এখন ভরাট হয়ে অনেক দূরে সরে গেছে। এখন তার শাখা-উপশাখা নদী বাইগার বা বাগার নদীর পাড়ে টুঙ্গিপাড়া গ্রাম অবস্থিত।
জন্মকথা ও তার পরিবারপরিজন
বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি রাজনীতির মহাকবি শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাংলা ২০ চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দের মঙ্গলবার রাত ৮টায় টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি আমাদের প্রিয় শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিব শব্দের অর্থ সঠিক উত্তরদাতা। নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নানা শেখ আবদুল মজিদ। শেখ মুজিবুর রহমানের পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান, মাতা শেখ সায়রা খাতুন। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তান শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহেনা ও শেখ রাসেল। শেখ লুৎফর রহমান দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। তাদের পরিবারে অর্থের প্রাচুর্য না থাকালেও সচ্ছলতা ছিল।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
শেখ মুজিবুর রহমান সাত বছর বয়সে পাশের গ্রামের গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বর্ষা মৌসুমে ইশকুলে যাতায়াত করতে হতো নৌকা দিয়ে। একবার নৌকা ডুবে যাওয়ায় মুজিব পড়ে যান খালের পানিতে। এরপর তার মা মুজিবকে ইশকুলে যেতে দেননি। ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি কর দেন। একসময় শেখ লুৎফর রহমান বদলি হন মাদারীপুর আদালতে। পিতার চাকরির সুবাদে শেখ মুজিব ভর্তি হন ইসলামিয়া হাই ইশকুলে। ১৯৪৪ সালে শেখ মুজিবের চক্ষূরোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার জন্য তাকে কলকতায় নিয়ে যাওয়া হয়। চার বছর তার শিক্ষাজীবন থেকে হারিয়ে যায়। ১৯৩৭ সালে ভর্তি হন গোপালগঞ্জ মিশন ইশকুলে। ছোটোবেলা থেকে বঙ্গবন্ধু ছিলেন দস্যিটাইপের। তিনি ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতেন। তিনি ছিলেন দক্ষ ফুটবলার। গোপালগঞ্জের মিশন ইশকুলে ফুটবল টিমের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৪১ সালে ১০৮ ডিগ্রি জ¦র নিয়ে তিনি এসএসসি পরীক্ষা দেন পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে দ্বিতীয়বার তিনি দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে কলকতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সে সময় থেকে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও সাথে মুসলিম লীগ করতেন। মুসলিম ছাত্রলীগ করার সময়ে তিনি ইসলামিয়া কলেজের বেশ নামজাদা ছাত্র হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন। সে সময় তিনি কলকতার ইসলামিয়া কলেজের ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বেকার হোস্টেলে থাকতেন। বেকার হোস্টেলের একসময় প্রভোস্ট ছিলেন, পটিয়ার নাইখাইন গ্রামের গণিতবিশারদ ডক্টর আতাউল হাকিম। ডক্টর আতাউল হাকিম মারা যাওয়ার পর তাকে দেখতে কমলাপুরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুুজিবের ইসলামিয়া কলেজে সহপাঠী ছিলেন, চট্টগ্রামের মোঃ মাজহারুল কুদ্দুস। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালে শেখ মুজিব ১৮ বছর বয়সে বেগম ফজিলতুন্নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পরও তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান।
বঙ্গবন্ধুর নামটি কীভাবে এলো?
চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা থানার কৃতী সন্তান প্রয়াত রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক ঢাকা কলেজে অধ্যয়নকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ছিলেন মুশতাক দাদার সহপাঠী। ১৯৬৮ সালের দিকে ৩ নভেম্বর মুশতাক ও শেখ কামাল ‘প্রতিধ্বনী’ নামে একটি বুলেটিন প্রকাশ করেন। ঢাকা কলেজের প্যাডে ‘সারথী’ ছদ্মনামে ‘আজব দেশ’ প্রবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে সর্বপ্রথম “বঙ্গবন্ধু” শব্দটি লিখে মুশতাক দাদা ইতিহাসের পাতায় কালের সাক্ষী হয়ে গেলেন। এর তিন মাস উনিশ দিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে রেসকোর্সের গণসংবর্ধনায় ডাকসু ভিপি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।
শেখ মুজিবের কীর্তি
আমার কাছে মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামনের সবচেয়ে বড়ো কীর্তি ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া ১৮ মিনিটের জাদুকরী ভাষণ বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু হয়ে ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। হৃদয় স্পর্শ করা সেই ভাষণটি বাঙালি জাতির হৃদয়ে তুমুল ঝড় তুলে সত্যিকারের যে দেশপ্রেম সেটি তিনি এদেশের মানুষের হৃদয়ে জাগিয়ে তুলেছেন। এই একটি ভাষণেই পুরো দেশের মানুষ যেন সবাই মা মাটি মাতৃভূমির টানে এক হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ভাষণটিকে ২০১৭ সালে ইউনেস্কো বিশে^র গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষণের কিছু চৌম্ববকাংশ “ আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা চট্টগ্রাম, খুলনা, রজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম…১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে দশ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে ৭ জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কন্তিু যদি এ দশেরে মানুষকে খতম করার চষ্টো করা হয়, বাঙালরিা বুঝ–েশুনে কাজ করবনে। প্রত্যকে গ্রাম,ে প্রত্যকে মহল্লায় আওয়ামী লীগরে নতেৃত্বে সংগ্রাম পরষিদ গড়ে তোল এবং তোমাদরে যা কছিু আছে তাই নযি়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দযি়ছে,ি রক্ত আরো দবে। এ দশেরে মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবাররে সংগ্রাম আমাদরে মুক্তরি সংগ্রাম, এবাররে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ”।
বঙ্গবন্ধুর বৃক্ষপ্রেম
বঙ্গবন্ধু যে বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন সেটি প্রথম দেখেছিলাম নাটোরের উত্তরা গণভবনে দিঘাপতিয়ার রাজভবনে ভ্রমণে গিয়ে। গণভবনে প্রবেশ করতে মূল ফটকের মাঝখানে চমৎকার একটা ঘড়ি। ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে দীঘাপতিয়ার রাজা ঘড়িটি এনেছিলেন বলে নাটোরে এটি ইতালিয়ান ঘড়ি নামে পরিচিত। ঘড়িটির নিরবচ্ছিন্ন ঘণ্টার ধ্বনি সকালের নীরবতাকে একসময় চূর্ণবিচূর্ণ করে নাটোরবাসীকে সময় জানিয়ে দেয়। ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে দয়ারামকে রাজা রামজীবন কিছু জমি দান করেন বাসস্থান নির্মাণ করে বসবাসের নিমিত্তে। মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ খুশি হয়ে তাকে রায়নারায়ণ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই সাথে নওখিলা পরগনা লাভ করেন। এই নওখিলা হলো দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রথম জমিদারি। ১৮৯৭ সালে ১২ জুন ভূমিকম্পে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি, দেবালয়, সুদৃশ্য বাগান, ক্লাব, লাইব্রেরি, ডাকঘর, চিকিৎসালয়সহ মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেলে নতুনভাবে ১৮৯৯ সালে রাজা প্রমদানাথ রায় নান্দনিকভাবে উত্তরা গণভবন পুনরায় নির্মাণ করেন। ১৯৬৬ সালে এই রাজপ্রাসাদটি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। পাকিস্তান সরকার দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন গভর্নর হাউজ। তৎকালীন গভর্নর আব্দুল মোনায়েম খান ১৯৬৭ সালে ২৪ জুলাই এটি উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামান গভর্নর হাউজকে “উত্তরা গণভবন” নামকরণ করেন। সেই থেকে এটি উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরা গণভবন পরিদর্শনে আসলে গণভবনের বাগানে নিজ হাতে একটি হৈমন্তী গাছের চারা রোপণ করেন। বাগানের সবচেয়ে নান্দনিক ৫১ বছরের পুরানো হৈমন্তী গাছটি জীবন্ত মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। হৈমন্তী গাছ বা কুর্চি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ঐড়ষধৎৎযবহধ ঢ়ঁনবংপবহং চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভেনিজুয়েলায় এটি পাওয়া যায়। হোমিওপ্যাথ চিকিৎসায় টিংচার হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। হৈমন্তী ফুলের বেশ সুঘ্রাণ রয়েছে। গাছটি যত্ন না নেওয়ায় কীটপতঙ্গ ও ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমণে এর কাÐ ও ডালপালা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বর্তমানে গাছটি সতেজ হয়ে কালের সাক্ষী বহন করছে। হৈমন্তী গাছের নিচে বসে বেশ প্রশান্তি অনুভব করলাম, গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দু-একটা ছবিও তুলে নিলাম। গণভবন এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ১ জুলাই নারকেল গাছের চারাও রোপণ করেন। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ সালে ৬ জুন লিখেছেন, “লাউ লাগাইয়াছিলাম। গাছ হয়েছে। ঝিংগা গাছও বেড়ে উঠেছে। ফুলের বাগানটিকে নতুন করে সাজাইয়া গোছাইয়া করতে শুরু করেছি।”
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেওয়া হয়। গাছ লাগিয়ে ঘোড়দৌড় ময়দানকে পরিণত করে একটি সবুজ শ্যামল সুদৃশ্য উদ্যানে। যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত। সে সময় এক কর্মকর্তা বলেছিলেন জনগণ গাছের ফল চুরি করে খেয়ে ফেলবে। বঙ্গবন্ধু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, “জনগণের জমি জনগণের গাছ। ওরাই যদি ফল খায়, আপনার আমার আপত্তি কোথায়?” বৃক্ষপ্রেমী বঙ্গবন্ধুর আজও কালের সাক্ষী বহন করছে শৈশব স্মৃতিবিজড়িত হিজল আর আমগাছ। খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশের পথে বিশাল উচু নারিকেল গাছ মূর্তীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭২ সালে ৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু খুলনা মহিলা কলেজে আসলে তিনি নিজ হাতে নারিকেল গাছটি রোপন করেন। গাছটিতে আজও ডাব নারকেল ধরে। বৃক্ষের পাতাগুলো আজও বাতাসে ওড়ে, গাছগুলো বৃষ্টিতে ভিজে, মিষ্টিরোদের সুধা পান করে, জোছনার আলোতে ঝিলমিল করে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে। পত্রপল্লব বাতাসে দুলে গাছের পাতা নেড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গাছগুলো ধন্যবাদ জানায়, দোয়ার বৃষ্টি বর্ষণ করে। বৃক্ষরোপণের জন্য সদকায়ে জারিয়া হিসেবে তার কবরে সওয়াব পৌঁছে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর যে একটা চিরসবুজ সুন্দর মন ছিল সেটা তার বৃক্ষপ্রেম দেখলে বুঝা যায়।
বইপ্রেমী বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু তার জীবনের ১৪ বছর বা প্রায় ৪ হাজার ৬৭৫ দিন কারাগারে ছিলেন। প্রকৃতির প্রতি যেমন তার প্রেম ছিল ঠিক তেমনি বইপ্রেমীও ছিলেন। ছিলেন একজন ভালো পাঠকও। বই পড়তে পছন্দ করতেন। তার পছন্দ তালিকায় ছিল, রবীন্দ্র, শরৎচন্দ্র, নজরুল রচনাবলী, র্জজ বার্নার্ড শ, আলবেরুনির ভারততত্ত্ব, মির্জা গালিব, শেকসপিয়র, মাওসেতুং-র বই। ১৯৫০ সালে ২১ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেল থেকে বঙ্গবন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে চিঠি লিখেছিলেন সেই চিঠিতে আছে “গত অক্টোবর কেন্দ্রীয় জেলখানার গেটে যখন আমাদের দেখা হয়েছিল, আপনি কথা দিয়েছিলেন, আমাকে কিছু বই পাঠিয়ে দেবেন। তবে এখনও কোনো বই পাইনি। ভুলে যাবেন না এখানে আমি একা আর বই আমার একমাত্র সঙ্গী।” আহা বঙ্গবন্ধুর বইয়ের প্রতি কত প্রেম ভালোবাসা এ থেকে বুঝা যায় তিনি সত্যিকারের একজন ভালো পাঠকও ছিলেন। শুধু তাই নয় ১৪ বছর তিনি কারাগারে বসে তিনটি বই রচনা করেছেন। প্রথম বই ছিল “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”(২০১২) , দ্বিতীয় বই “কারাগারের রোজনামচা”(২০১৭), তৃতীয় বই ছিল “আমার দেখা নয়া চীন”(২০২০)। ১৯৬৬ সালের ৮ মে যখন তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। একদিন জেলগেটে বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছা তাকে দেখতে আসেন এবং বলেন “বসে তো আছো লেখ তোমার জীবন কাহিনী” বঙ্গবন্ধু বললেন, “লিখতে যে পারি না। আর এমন কী করেছি, যা লেখা যায়। আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকুই বলতে পারি নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।” বই লেখার জন্য তার সহধর্মিণী বেশি অণুপ্রাণিত করেছিলেন। বই লেখার জন্য তাকে খাতা কলমও কিনে দিয়েছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা, শৈশব, কৈশোর এবং দুরন্তপনা, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, কলকতার দাঙ্গা, দেশভাগসহ ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোর কথা উঠে এসেছে।
“কারাগারের রোজনামচা” বইটি সত্যিই অসাধারণ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহেনা বইটির নামকরণ করেন। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ এবং তার ঐতিহাসিক ভাষণ ৬ দফার গুরুত্বসহ তার পরিকল্পনা, নিজস্ব ভাবনাসহ জেলখানার কাহিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন, পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপ্রেমী। বঙ্গবন্ধু কত প্রাঞ্জল সহজসরল ভাষায় লিখেছেন, “আমার ঘরের কাছের আমগাছটিতে রোজ ১০টা ১১টার সময় দুটো হলদে পাখি আসে। আমি ওদের খেলা দেখি। ওদের আমি ভালবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুটো হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুটি পাখির পরিবর্তে আর আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুটির চেয়ে একটু ছোট মনে হয়।”
কাকের উৎপাত বঙ্গবন্ধুর ভালো লাগত না। বিরক্ত হতেন। একদিন বাগানি কাদের মিয়াকে কাকের বাসা ভেঙে দিতে বলেন। বাসা ভাঙার পরও কাক জড়ো হয়ে চিৎকার করত। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “কিছু সঙ্গী জোগাড় করে ওরা কাদেরকে গাছে আক্রমণ করত। দুই-একদিন শত শত কাক যোগাড় করে প্রতিবাদ করত। ওদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে আমি মনে মনে প্রশংসা করলাম। বাঙালিদের চেয়ে ওদের একতা বেশি।” কিছুদিন পর কাকরা বঙ্গবন্ধুকে দেখলে বেশ বিরক্ত করত, কাক ভাবত বঙ্গবন্ধু তাদের ঘর ভাঙবে। পরবর্তীতে কাক বঙ্গবন্ধুকে বিরক্ত করত না প্রতিবাদও করত না আর নিন্দা প্রস্তাবও পাশ করে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তৃতীয় বই ছিল “আমার দেখা নয়া চীন” এই বইটি প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে । এটিও জেলে থাকার সময় রচনা করেছেন। চারটিখানি কথা না, বঙ্গবন্ধুর কত ধৈর্য কত কত সহিষ্ণু কত শান্ত থাকলে তিন তিনটি বই রচনা করেন। ১৯৫২ সালের চীনের পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়া ও প্রশান্তমহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। সে সময় নয়াচীন দেখার বেশ অভিজ্ঞতার কথাও বইটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন। চীন ভ্রমণ কাহিনিও তুলে ধরেন এবং চীনের মানুষেও সংস্কৃতি, সমাজ, দর্শনও এসেছে বইটিতে। “চীনের মানুষরা ইংরেজি ভাষা জানলেও তারা খুব একটা বলতো না তাদের নিজস্ব চাইনিজ ভাষায় কথা বলতেন। চীনে অনেক লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, অনেকেই ইংরেজি জানেন, কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলবেন না। দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলবেন। আমরা নানকিং বিশ^বিদ্যালয় দেখতে যাই। সেই বিশ^বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ইংরেজি জানেন, কিন্তু আমাদের অভ্যর্থনা করলেন চীনা ভাষায়। দোভাষী আমাদের বুঝাইয়া দিল। দেখলাম তিনি মাঝে মাঝে এবং আস্তে তাকে ঠিক করে নিচ্ছেন, যেখানে ইংরেজি ভুল হচ্ছে। একেই বলে জাতীয়তাবোধ। একেই বলে দেশের ও মাতৃভাষার উপর দরদ।”
যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়
ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি” আমাদের হিমালয় পর্বত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারে ১৫ আগস্ট নেমে এসেছিল কালো অমানিশা। বাঙালি জাতির জীবনে এর চেয়ে বিষাদ বেদনাবিধুর ও কলঙ্কিত অধ্যায়ের মতো বিশে^ দ্বিতীয় আর কোনো দেশে ঘটেছিল কি না আমার জানা নেই। সেদিন কিছু দুষ্কৃতকারী বিপথগামীদের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ তার স্ত্রী ফজিলতুন্নেছাসহ বঙ্গবন্ধুর তিন ছেলেসহ তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার পরিবারের সদস্য, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি কৃষক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের সদস্য। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুর মাসুম শিশু শেখ রাসেলসহ শেখ মণির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীও সেদিন খুনিদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। মাত্র এক ঘণ্টার অপারেশনে সর্বমোট ২৬ জন সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ঘাতকরা। সত্যি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এধরনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ একটা দেশের রাজকীয় পরিবারের সকল সদস্যকে এভাবে হত্যা করার ঘটনা আর দ্বিতীয়টি আছে কি না সন্দেহ। ১৫ আগস্ট আবার এসেছে। বঙ্গবন্ধুর লাগানো হৈমন্তী গাছ, নারিকেল গাছগুলো আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হলুদ পাখি কাক চড়–ই সকলে আসে বৃক্ষের ডালে ডালে। বঙ্গবন্ধুর অতি যত্নে লেখা বইগুলো আজও বঙ্গবন্ধুপ্রেমীরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে। রাজনীতির কবি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা –
“টুঙ্গিপাড়ার দস্যি ছেলে শেখ মুজিবুর রহমান
কালের সাক্ষী মধুমতী, গাইছে আজও তারই নাম।
দুরন্ত সেই খোকার স্বপ্ন, গড়বে স্বাধীন সোনার দেশ,
৭-ই মার্চ-র বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠল এই স্বদেশ।
মুজিব মানে কিষান-শ্রমিক সবার মুখে হাসি
মুজিব মানে শস্যখেতে রাখাল বাজায় বাঁশি।
মুজিব মানে তাই মুক্তি, স্বপ্ন সোনার বাংলা
সেই স্বপ্ন ভেঙে দিলো আততায়ীর হামলা
এক নামেতে চিনল যাকে পদ্মা মেঘনা-যমুনা
টুঙ্গিপাড়া হলো যে তাঁর চিরনিদ্রার ঠিকানা
তবু মুজিব মানেই সাহস, শক্তি অনিঃশেষ
মুজিব মানে মা-মাটি আর মাতৃভূমি বাংলাদেশ।”
লেখক: প্রাবন্ধিক, সমন্বয় সহকারী ইতিহাসের খসড়া
সারাবাংলা/এজেডএস