ইন্টারকনে হামলার নায়ক মোহাম্মদ আবু বকর
৩০ আগস্ট ২০২৩ ১৫:০৭
একাত্তরে পুরো সময়টা জুড়ে যেমন রয়েছে বেদনাবিধুর যন্ত্রণার উপাখ্যান, তেমনি আছে দুঃসাহসিক বীরত্বগাঁথা। ঢাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য রাজধানী শহর এবং কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এখানে পাকিস্তানি সেনারা ছিল খুবই তৎপর, তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল নিশ্ছিদ্র। কিন্তু সেই গিজগিজে পাকিস্তানি সেনায় ভরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পটেই ‘হিট এন্ড রান’ কৌশলে উপুর্যপরি হামলা চালিয়েছিল আরবান গেরিলাদের দল। কি অচিন্তনীয় সাহস তারা দেখিয়েছিল, ঝুঁকি তারা নিয়েছিলেন, তা আজও অনেকের ভাবনার অতীত।
দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফের নির্দেশে গেরিলা ওয়ারফেয়ারের কিংবদন্তী মেজর এটিএম হায়দার ১৭ জন তরুণকে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। তার নির্দেশনা ছিলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিদেশী সাংবাদিক ও অতিথিরা থাকাকালীন ঢাকা শহরের পরিস্থিতি যে শান্ত নয় এবং এখানে যুদ্ধ চলছে তা বোঝানোর জন্য শহরের আশে-পাশে কিছু গ্রেনেড ও গুলি ছুড়তে হবে। কিন্তু দুঃসাহসী এই তরুণেরা ঢাকায় এসে ৯ জুন তারিখে সরাসরি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করে। সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের কথা জানতে পেরে বলেন, ‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল! বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে আর ওরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে। ’ তিনিই প্রথম এই দলটিকে ‘ক্র্যাক’ আখ্যা দেন; যা থেকে পরবর্তীতে মুক্তিসেনাদের এই প্লাটুনটি ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ নামে পরিচিত হয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে একাত্তরের জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস রীতিমত দিশেহারা করে তোলে এই ব্রেইভহার্টের দল। বাধ্য হয়েই কাপুরুষ পাকিস্তানিরা বেছে নেয় ষড়যন্ত্র আর কূটকৌশল, কাজে লাগায় তাদের পালিত নরপিশাচ জল্লাদ আলবদর ও রাজাকারদের, আগস্টের ২৯ থেকে ৩১ এই তিনদিন ধরে একের পর এক গেরিলাদের ‘হাইড আউট’ প্রকাশ হয়ে যায় ও ‘কিংস পিনেরা’ ধরা পড়ে। যে আরবান গেরিলারা ধরা পড়েন, তাদের ৭ জনকে আর কখনই খুঁজে পাওয়া যায়নি। জানা যায় অবর্ণনীয় অত্যাচার শেষে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করেছে আলবদর ও পাকিস্তানি সেনারা।
৯ই জুলাই, ১৯৭১ ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টালে ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্র্ষ গেরিলারা প্রথম অপারেশন চালিয়েছিল। বিখ্যাত সে অপারেশনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ১১ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় হোটেল ইন্টারকনে চালানো একটি মারাত্মক বিস্ফোরণের গল্প। যার নেপথ্যে মূল নায়ক ছিলো ১৮ বছর বয়সী একটি ছেলে, ক্র্যাকপ্লাটুনের সর্বকনিষ্ঠ গেরিলা, মোহাম্মদ আবু বকর। ঢাকা ইন্টারকনে তার সেই দুঃসাহসিক এ্যাকশনের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্থানি মিলিটারিদের। তথাকথিত পৃথিবীর সেরা আর্মির দাবিদার পাকিস্তারিদের দাম্ভিকতা পায়ের তলে পিষে সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থানে হামলা চালিয়ে স্বগৌরবে বের হয়ে এসেছিল বকর।
কেবল অপারেশনই নয়, পূর্ব পাকিস্তানের আইএসআইয়ের বাঙ্গালী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইসলামকে শত্রুর চোখ ফাকি দিয়ে পরিবারসহ পৌঁছে দিয়েছিল ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ে। পাক ইন্টিলিজেন্সের এই গুরুত্বপুর্ন কর্মকর্তাকে সঙ্গত কারনেই কঠোর নজরদারীতে রাখতো পাঞ্জাবিরা, আর তাকেই ‘মাসুদ রানা’ স্টাইলে রেসকিউ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে এসেছিল দুই অকুতোভয় ‘ক্র্যাক’ ফতেহ আলী চৌধুরী ও আবু বকর। এ রকম আরো অনেকগুলো অপারেশনে পাকিস্তানিদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ে বকর, বিশেষ করে ১১ই আগস্টের অপারেশনের পর পাক মিলিটারি পাগলা কুকুর হয়ে গিয়েছিল। সবশেষে এই দুঃসাহসী যুবককে ৩০ আগস্ট ভোরে গুলশান-২ এর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মিরা। নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের বদ্ধ কামরায় অন্য সহযোদ্ধাদের সাথে অমানুষিক নির্যাতন চলে এই গেরিলার উপর, সেদিনের পর বকরকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বকর আর আর ফিরে আসেনি, মিশে গেছে ৩০ লাখের রক্তের স্রোতে।
তথ্য কৃতজ্ঞতা:
১। ব্রেইভ অফ হার্ট: হাবিবুল আলম বীর প্রতীক
৩। সুরের বরপুত্র আলতাফ মাহমুদ: দিনু বিল্লাহ
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইন্টারকনে হামলার নায়ক মোহাম্মদ আবু বকর ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রাতিন রহমান