আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের নামে পুঁথিগবেষণা ইনস্টিটিউট হোক
১ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:৩৯
পটিয়া সুচক্রদন্ডী গ্রামটি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড এ অবস্থিত। সমগ্র বাংলাদেশে পটিয়ার সুচক্রদন্ডি গ্রামটি বেশ সু-পরিচিত। শিক্ষা দিক্ষাও সাংস্কৃতিতে সমগ্র চট্টগ্রামে পটিয়ার বেশ নাম যশ আছে। তাই একদা চট্টগ্রাম সরকারী কমার্স কলেজের প্রয়াত অধ্যক্ষ প্রফেসর সাফায়েত আহমেদ সিদ্দিকী স্যার বলেছিলেন, Patiya is the Brain Box of Chattogram. পটিয়া চাঁনখালী নদীর ইন্দ্রপুল ব্রিজের উত্তর পাশ দিয়ে সুচক্রদন্ডির গ্রামের প্রবেশদ্বার। মুন্সেফবাজরের উত্তর পাশ দিয়েও যাওয়া যায়। পাশে এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে চাঁনখালী খাল। খালের পানিতে বাঁশের বেলা সারি সারি করে বিক্রির জন্য সাজানো। খালের পাড়ে নোঙর করা আছে লবণের সাম্পান। চাঁনখালী খালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লবণ শিল্প। পটিয়া লবন শিল্পের প্রবক্তা ছিলেন নানা ভাই মরহুম তোফায়েল আহমেদ সওদাগর। শৈশব ও বেড়ে উঠে সুচক্রদন্ডী গ্রামে। নানা বাড়িটি দিঘী ও চারিদিকে নারিকেল ও খেজুর গাছে ঘেরা। বাবুই পাখির বাসা দোলত নারিকেল গাছে। আশে পাশে কাদাযুক্ত লবনের মাঠ। চানখালীর পাশে ছিল পটিয়া কালের স্বাক্ষী ষষ্ঠি বৈদ্যার হাট, কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। সুচক্রদন্ডী শব্দটি সে সময় বৌদ্ধদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। বৌদ্ধযুগে যে সব গ্রামের নামকরণ হয়েছে তাতে দেখা যায় স্থানীয় সুখ্যাতির সাথে তারা দন্ডী শব্দটি যুক্ত করে দিত। এ থেকে অনুমান করা হয় যে আগেকারদিনে বৌদ্ধদের কোন ধর্মচক্র ছিল বলেই এ গ্রামের নাম সুচক্রদন্ডী হয়।
সুচক্রদন্ডীকে আবার দাইর ও বলা হতো যেমন সুচক্রদন্ডীকে সুইচ্যা দাইর বা উইচ্যা দাইর বলা হয়। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সড়ক হয়ে একটু ভিতরে গেলে চমৎকার গ্রামটি চোখে পড়বে। পাখি ডাকা, ছায়া ঘেরা পুকুর বিল ঝিল সবুজের হাতছানি সবই আছে। রাস্তার পাশে চোখে পড়বে পুরানো মন্দির, প্রাচীন কালের জমিদার বাড়ি, প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিছুদূর গেলে দেখা যাবে পুকুর পারে ছোট একটা বাড়ি। বাড়িটি আদিকালের ঐতিহ্য বহন করে আসছে । বাড়ির গায়ে লেখা সাহিত্য বিশারদ ভবন।
সাতিহ্যবিশারদের জন্মকথা ও তার পরিবারপরিজন
সাহিত্যবিশার ভবনে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে ঘরের দেয়ালে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও ড. আহমেদ শরিফের ছবি টাঙ্গানো। এই বাড়িতে আবদুল করিম ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে ১১ অক্টোবর, বাংলা ১২৩৩ সনে ২৫ আশ্বিন জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মুনশী নুরুদ্দীন, মাতা মিশ্রীজান। তার মাতা ও ছিলেন হুলাইন গ্রামের শিক্ষিত ও বনেদি পাঠান তরফদার দৌলত হামজা বংশের কন্যা। অপুত্রক মাতামহের নাম ছিল মুশাররফ আলি। বাবা মারা যাওয়ার তিন মাস পর আবদুল করিমের জন্ম হয়। ১৮৮৮ সালে ১৭ বছর বয়সে মাকেও হারান আবদুল করিম। ১৮৮২ সালে আবদুল করিমের দাদা-দাদী তাদের ছেলে আইনউদ্দীনের (আবদুল করিমের চাচা) বড় মেয়ের সঙ্গে আবদুল করিমের বিয়ে দেন। ছোট বেলা থেকে দাদা দাদী ও চাচা আইনউদ্দিনের স্নেহ যত্ন ও ভালোবাসায় লালিত হন। আবদুল করিম ১৯২১ সাল পর্যন্ত চাচার পরিবারেই ছিলেন।
আবদুল করিমের শিক্ষাও কর্মজীবন
নিজভূমে সাহিত্যবিশারদ আরবী ভাষা অধ্যয়ন করলে ও পরে সুচক্রদন্ডী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন, এক বছর সুচক্রদন্ডী স্কুলে বাংলা পড়েন। পরবর্তীতে ভর্তি হন পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফ এ পড়তে যান। সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামে তথা টেকনাফ অবধি এলাকায় তিনি প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এফ এ পরীক্ষার কিছুকাল আগে তিনি কঠিন অসুখে পড়েন। অসুস্থতার কারণে আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। স্কুল শিক্ষা তার এখানে শেষ।
পটিয়া মুসলিম শিক্ষার্থীর দুর্বলতার কারণে পটিয়া স্কুলে তখন আরবী-ফারসীর কোনো শিক্ষক ছিলেন না। তাই স্কুলে তিনি দ্বিতীয় ভাষারূপে সংস্কৃতি পড়েছিলেন। সবার স্নেহভাজন তাকাতে পিতামহ আইনুদ্দিন মিঞার জৈষ্ঠ্য তনয়ার সঙ্গে আবদুল করিমের বিয়ে দেন। কলেজ ত্যাগের পর তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তিনি যোগ দেন সীতাকুন্ড ইংরেজী স্কুলের অস্থায়ী প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে কার্যকাল ফুরিয়ে আসলে তিনি চট্টগ্রামে প্রথম সাবজজ আদালতে ‘এপ্রেনটিস’ হন। ১৮৯৭ সালে তিনি পটিয়া দ্বিতীয় মুন্সেফী আদালতে বদলী হন। ১৮৯৮ সালের জানুয়ারী মাসে অ্যাক্টিং ক্লার্করূপে কমিশনার অফিসে বদলি করিয়ে নেন। চাকুরী জীবনে নবীন চন্দ্রের প্রীতিই আবদুল করিমের বিপদ ডেকে আনে। নবীন চন্দ্রে একটি বিপক্ষ দল ছিল তাদের ষড়যন্ত্রের কারনে তাকে চাকুরি হারাতে হয়। সে সময় আনোয়ারা থানায় ইংরেজী স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ শুন্য হলে তিনি ঐ পদে নিযুক্ত হলেন। তিনি বলতেন, চাকরী জীবনের মধুর কাল তথা ‘স্বর্ণযুগ’ আমার এখানেই (বাহার, ১৯৬৯) সাত বছর কাজ করেন। ১৯০৬ সালে বিভাগীয় স্কুলে ইন্সপেক্টর অফিসে কেরানীর পদে নিযুক্ত হন। ২৮ বছর চাকরি করার পর সেখান থেকে ১৯৩৪ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারী তিনি অবসর নেন।
সাহিত্যবিশারদের কীর্তি
তার সাহিত্যিক জীবনে দুটি ধারা লক্ষ করা যায়─একটি হলো প্রাচীন পুঁথিপত্র সংগ্রহ ও তার তথ্য সন্ধান করা। তার মধ্যে কোন হিন্দু বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান মুসলিম ভেদাভেদ ছিল না। তিনি ছিলেন অসম্প্রদায়িক। হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম সবার বাড়ি গিয়ে গিয়ে তিনি পুঁথি সংগ্রহ করতেন। পুঁথি সংগ্রহের কাজটা কিন্তু সমগ্র দেশেই তিনি প্রথম শুরু করেন। সে সময় তিনি বেশ প্রবন্ধ লিখতেন। ত্রিশটিরও বেশী পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতো। সাহিত্য, সংহিতা, সুধা, পূর্ণিমা, নবনূর, অর্চনা, ভারত সুহৃদ, অবসর, প্রদীপ, বীরভূমি, কোহিনূর, প্রকৃতি, আরতি, আশা, ইসলাম প্রচারক, এডুকেশন গেজেটে তিনি নিয়মিত লিখতেন।
চট্টগ্রাম থেকে পূজারী ও সাধনা নামক দুটি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছিলেন। সাতিহ্যবিশারদ নবনূর পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। সাহিত্যানুশীলনের ক্ষেত্রে তার বিশেষ কীর্তি, প্রাচীন পুঁথিপত্র সংগ্রহ প্রাচীন কবিদল, বিশেষত মুসলিম কবিগণকে কোথায়, কী করছেন তার তথ্য সংগ্রহ ছিলো তার ব্রত। সমগ্র দেশে পুঁথি সংগ্রহের জন্য তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। স্যার আশুতোষ আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদকে ভীষন স্নেহ করতেন। তিনি তাকে কলকতায় মেট্রিকের বাংলার পরীক্ষক নিযুক্ত করেন। সৈয়দ এমদাদ আলী, ড. মোহাম্মদ শীদুল্লাহ তাকে বড় ভাইয়ের মতো জানতেন। সাহিত্য বিশরদের রচিত চট্টগ্রামের ইতিহাস ইসলামাবাদ, ১৩২৫ সালের মাসিক সওগাত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমি গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। সৈয়দ মর্তুজা আলী এটা সম্পাদনা করেছিলেন। প্রাবন্ধিক আবদুল হকের মত ও মন্তব্য উল্লেখ করা যায়, রাষ্টভাষা আন্দোলনের পেছনে সমাজে সর্বাত্মক এবং অনমনীয় সমর্থন অন্যতম উপাদান হিসেবে প্রেরণা দিয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-বাঙ্গালী মুসলমানের উত্তরাধিকার সত্ত্বার চেতনা। এই চেতনা যারা সমাজে সঞ্চারিত করেছেন তাদের মধ্যে সর্বগণ্য আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ এই অর্থে অজেয়। পুঁথি সংগ্রহ এবং এ সংরক্ষণ গবেষণায় বাঙ্গালী মুসলমানদের মাঝে তিনিই ছিলেন অগ্রগামী এবং মহত্তম কর্মী। এই চেতনার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বিশেষভাবে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এরই অবদান। তার আজীবন সাধনার ফলে আহৃত বিপুল তথ্যপুঞ্জ সবার মানসে ঐ চেতনার জন্ম দিয়েছে এবং আত্ম ঘোষণার এক অনমনীয় সঙ্কোচ সঞ্চারিত করেছে।
মানবপ্রেম ও স্বাধীনতাকামী আবদুল করিম
সাহিত্যবিশারদ আবদুল করিমের কৃতি ও কীর্তি অতুলনীয়। তিনি তার শ্রমনিষ্ঠ ও সাধনায় বিপুল পুঁথির সংগ্রহ ও বাংলা সাহিত্যেও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসে পুনর্গঠণে শুধুই ভূমিকা রাখেননি । তার মানবপ্রেম ও ছিল বেশ। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের নায়ক সূর্য সেনপন্থী ‘পটিয়ার ভাটিখাইনবাসী হরিপদ ভট্টাচার্য চট্টগ্রামের পুলিশ-সুপার খান বাহাদুর আহসানল্লাউাহকে নিজাম পল্টনে ফুটবল খেলার মাঠে হত্যা করেন [১৯৩১ সনের ৩০ আগস্টের বিকেলে] এবং পলায়নকালে মাঠেই ধৃত হন। এবং একটি মামলা ধায়ের করাও হয়। মামলায় একজন জুরার ছিলেন স্বদেশের স্বাধীনতাকামী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তিনি হরিপদকে নির্দোষ বলে মত দেন এবং একজন জুরারকে অনুনয় করে স্বমতে আনেন। ফলে সংখ্যাগুরুর মতে হরিপদ নির্দোষ সাব্যস্থ হন, তবু সংখ্যাগুরুর মত অগ্রাহ্য করে ষোল বছর বয়স্ক হরিপদকে ফাঁসির বদলে জেল দেয়া হল। এদিকে অন্যান্য মুসলিম জুরার এবং শহরের মুসলমানরা আবদুল করিমের প্রতি ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হলেন। কয়েক মাস তাকে ভয়ে ভয়ে পথ চলতে হয়, উল্লেখ্য যে আহসানউল্লাহ হত্যার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের তথা ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কমিশনারের গোপন প্ররোচনায় ও নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে মুসলিম গুপ্তারা হিন্দুর দোকান-পাট লুট করে। কিন্তু প্ররোচনা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধেনি।’
সাহিত্যবিশারদের অভিভাষণ
আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের অভিভাষণ ও বেশ চমকপ্রদ তিনি অনেক বড়মাপের সাধক ও জ্ঞানের সাগরও হয়েও তিনি নিজেকে সবসময় উপস্থাপন করতেন খুব সাধাসিধে মাটির মানুষ হিসেবে। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রদর্শনী ও চট্টগ্রাম সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন, স্নেহ প্রীতি চিরকালই অন্ধ। ইহা তাহাদের সেই অন্ধ স্নেহ প্রীতিরই নিদর্শন। না হয় এই সভায় সভাপতিত্ব করার কোন যোগ্যতাই আমার নাই। ইহা আমার মামুলী বিনয় প্রকাশ নয়। সত্যই আমি গুণী নই, পন্ডিত নই, উচ্চশিক্ষিত লোকও আমি নই। আমি পূর্ব্ব বাংলার একজন গ্রাম্যলোক, গেঁয়ো মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের ভাইরা আমাকে বাঙ্গাল বলিতে পারেন। আমার জীবনযাত্রায় কোন চালচলনে যেমন নাই কোন চাকচিক্য, তেমনি আমার ভাষা ও লেখায় এক কথায় আজীবন আমি যে সাহিত্যের সাধনা করিয়াছি তাহাতেও নাই কোন চাকচিক্য এবং নাই আধুনিক সাহিত্য পাঠকদের আকর্ষণীয় ঔজ্জল্য। আমি পূর্ব্ববঙ্গের মাটির মানুষ।
তিনি তার অভিভাষণে আরও বলেন, সাহিত্যও প্রধান উপকরণ মানুষ, মানুষের অন্তরে যিনি প্রবেশ করিতে পারেন, তিনিই সাহিত্যিক, তিনি স্রষ্টা। মানুষের অন্তরে প্রবেশের একমাত্র রাজপথ হইতেছে প্রেমের পথ, ভালবাসাও প্রীতির পথ। তাই সাহিত্যিকের প্রথম ও প্রধান ধর্ম হইতেছে মানুষের প্রতি দরদ ভালবাসা, প্রাণঢালা ভালবাসা। দেশের প্রতি জাতির প্রতি, মানুষের প্রতি চতুর্দিকে প্রকৃতি ও পরিবেষ্টনের প্রতি যাহার অন্তরে বিরাজ করে অফুরন্ত ভালবাসা ও প্রীতি, জোর করিয়া বলিতে পারি তাহার রচনা সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করিয়া ধন্য হইবে।
সাহিত্য বিশারদ আবদুল করিমের অগ্রন্থিত সাতটি রচনা
পদ্মাবতী সম্বদ্ধে যৎকিঞ্চিৎ, প্রাচীন বঙ্গ-সাহিত্য ও মুসলমান, বড়যোগীর পুঁথি, রোসাঙ্গ শহর কোথায়? ফকির কবি আলী রাজা ওরফে কানু ফকির, সুফী ও বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন মুসলমান কবি ও চট্টগ্রামে সঙ্গীত-চর্চা আবদুল করিমের রচনা সমূহ অগ্রন্থিত থেকে যায়।
কীর্তিমান সাহিত্যবিশারদের অর্জন
পুঁথি গবেষক ও সংগ্রাহক আবদুল করিমকে ১৯০৯ সালে সাহিত্য বিশারদ উপাধিতে ভূষিত করা হয় এবং নদীয়া সাহিত্য সভা ১৯২০ সালে সাহিত্য সাগর উপাধিতে সম্মানিত করে। সাহিত্যবিশারদ চট্টগ্রাম সাহিত্য সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন সালে ১৯১৮। রাউজানে কেন্দ্রীয় মুসলিম তরুণ সঙ্ঘ আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন ১৯২৯। চট্টগ্রামে সাহিত্য সম্মেলনে সংবর্ধনা লাভ করেন ১৯৩৩ সালে। পূরবী সাহিত্য সমিতির সংবর্ধনা পান ১৯৩৬ সালে। এছাড়াও সাহিত্য পরিষদে তাকে সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি তাকে পরিষদের বিশিষ্ট সদস্য (বিশিষ্ট সদস্য) হন ১৯০৩ সালে।
সাহিত্যবিশারদের শেষের ঠিকানা ও বর্তমান প্রজন্মের দাবি
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের প্রিয়তমা স্ত্রী বদিউন্নিসা ১৯৫৩ সালের ২৫ মার্চ না ফেরার দেশে চলে যান। ভাগ্যের কী নির্মম ট্র্যাজেডি বদিউন্নিসা মৃত্যুর ছয় মাস পর ১৯৫৩ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর এই মহান সাধক মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ চিরতরে প্রস্তান নেন। তার মৃত্যুর পর সমগ্র দেশের পত্রপত্রিকা এমনকি কলকাতার কাগজেও মৃত্যুর সংবাদ পরিবেশিত হয়। ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ শোক সভা করেন। সাহিত্যবিশারদের মৃত্যুতে ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক লিখেছেন, ‘সত্যই কি সব শেষ হয়ে গেল? মাস্টার আবদুল করিম মারা গেছেন, কেরানী আবদুল করিম দেহত্যাগ করেছেন, কিন্তু সাহিত্য বিশারদ মরেননি। তিনি মরতে পারেন না, কারণ চিত্ত, বিত্ত, জীবন এবং যৌবন এ সমস্থ চঞ্চল, কিন্তু কীর্তিমান ব্যক্তি চিরজীবি। কীর্তিমান সাহিত্য বিশারদ আজও জীবিত।
আমি সাহিত্য বিশারদকে দেখেনি কিন্তু তার বই পড়ে আত্মজীবনী জেনে আমার কাছে মনে হয় ছবির মতো সুচক্রদন্ডি গ্রামে তিনি আজও হেঁটে বেড়ান পুঁথি সংগ্রহের জন্য। বহু দুরদুরান্ত পথ হেটে বেড়ান এ বাড়ি ও বাড়ি পুঁথি সংগ্রহ করে বাড়ি এনে তা নিয়ে আবার গবেষনা করছেন তৈরী করছেন নতুন নতুন প্রবন্ধ। সুচক্রদন্ডী গ্রামের মসজিদের পাশে সাড়ে তিন হাত মাঠিতে চিরতরে শুয়ে আছেন দেশবরেণ্য পুঁথির যাদুকর আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। শুভ্র টাইলসের তৈরী সমাধিতে মার্বেল পাথর দিয়ে খুদাই করা এপিটাফ। সাহিত্যবিশারদ ভবনের দেয়ালে টাঙ্গানো ছবি স্মৃতির ঝাঁপিতে বন্ধী হয়ে আছেন যুগ যুগ ধরে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পুঁথি সাহিত্য গবেষণায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। তাহার এই সাধনায় যে শুধু বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে তা নয়, বরং বাংলা সাহিত্যে অনেক মুসলমান সাহিত্যিকদের দান নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছে। মৃত্যুর ৭০ বছর পেরিয়ে পটিয়ায় আজও হয়নি সাহিত্যবিশারদের নামে একাডেমি বা পুঁতিগবেষণা ইনস্টিটিউট। বর্তমান প্রজন্মের দাবি সুচক্রদন্ডী গ্রামে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ একাডেমি ও পুঁথি গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হোক। পুঁথির সাহিত্যের মাঝে অনন্তকাল বেঁচে থাকুক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। পরিশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ, আল্লাহ ওনাকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র:
১. আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ: আহমদ শরীফ’
২. বাংলা একাডেমি কর্তৃত প্রকাশিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অভিভাষণ সমগ্র ।
৩. কীর্তিমান সাধক পুরুষ সাহিত্যবিশারদ, ইতিহাসের খসড়া সম্পাদক মুহাম্মদ শামসুল হক ।
লেখক: সমন্বয়সহাকারী, ইতিহাসের খসড়া
সারাবাংলা/এজেডএস