আলো ছড়ানোর আগেই যে জীবনে নেমে এসেছিল অন্ধকার
১৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:৩৩
১৯৭৫ সালে শেখ রাসেল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। জীবন যার শুরুই হয়নি তখনো, অথচ তাকেও তার ছোট্ট জীবনটি উৎসর্গ করতে হলো দেশের জন্য। দেশভক্ত পিতার রক্তের সঙ্গে মিশে গেল শিশুপুত্রের রক্ত। এমন মৃত্যু অপ্রত্যাশিত, এমন মৃত্যু যেন আর কারও না হয়। আজকাল বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে আমরা অনেকেই বিচলিত, কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে আমরা সেভাবে বিচলিত বোধ করিনি। এমন কী শিশুহত্যার প্রতিবাদেও আমাদের বিবেক নড়ে ওঠেনি। সেদিন যথাসময়ে আমরা প্রতিবাদী হলে, অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করলে হয়তো রাজনীতিটা এতটা সংঘাত-সহিংসতায় ভরে উঠত না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন নোবেলজয়ী দার্শনিক বার্ন্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত। ছোট ছেলের নাম রেখেছিলেন তার নামানুসারেই। হয়তো স্বপ্ন ছিল তার ছোট ছেলেটাও বান্ট্রান্ড রাসেলের মতোই একদিন খ্যাতির শিখরে উঠবে। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সবকিছু তছনছ হয়ে যায়।
রাসেলের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর মধ্যরাতে। রাতে জন্ম, দিনের আলোর প্রত্যাশায় কি? কিন্তু আলো ছড়ানোর আগেই তার জীবন-প্রদীপ নিভিয়ে দিল একদল বিষাক্ত মানুষ। রাসেল বড় হয়ে উঠছিল মানবিক সব গুণ নিয়ে। স্কুল এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি হওয়ার সময়টাতেই সব শেষ হয়ে গেল। এমন নিষ্ঠুর ও বেদনার ঘটনা ইতিহাসে খুব বেশি নেই।
রাসেলের বড় চার ভাই-বোনের নাম যথাক্রমে শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রেহানা। পিতা শেখ মুজিব ছিলেন রাজনীতির মানুষ। জেল-জুলুম ছিল তার নিত্যসঙ্গী। তাই পিতৃস্নেহ বলতে যা বোঝায় তা পাঁচ সন্তানের কেউ-ই সে অর্থে পায়নি। মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একাই মূলত সন্তানদের লালন-পালন করেছেন একই সঙ্গে মাতৃ এবং পিতৃস্নেহে। সবচেয়ে ছোটজন রাসেলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে ছোট বলে রাসেল ছিল বড় ভাই-বোনদের চোখের মণি। ভাই-বোনদের আদরযত্ন ভালোবাসা সবই রাসেলের জন্য ছিল অবারিত।
রাসেল যেদিন জন্ম গ্রহণ করে, সেদিনও তার বাবা বাড়িতে ছিলেন না। একটি রাজনৈতিক সভায় যোগ দিতে তিনি চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। সেটা ছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়। সামরিক ডিকটেটর আইয়ুব খানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন ফাতেমা জিন্নাহ। তিনি পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছোট বোন। সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী জনসভায় যোগ দিতেই শেখ মুজিব চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। রাতেই পুত্রসন্তানের জনক হওয়ার খবর তার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় শেখ হাসিনার ঘরেই জন্ম হয়েছিল রাসেলের। বড় বোন শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘ও ছিল বড় আদরের। সবার ছোট বলে ওর আদরের কোনো সীমা নেই। ও যদি কোনো কারণে একটু ব্যথা পায়, সে ব্যথা যেন আমাদের সবারই লাগে। আমরা সব ভাই-বোন সব সময় ওকে চোখে চোখে রাখি। ওর গায়ে এতটুকু আঁচড় যেন না লাগে। কী সুন্দর তুলতুলে একটি শিশু। দেখলেই মনে হয় গালটা টিপে আদর করি’ ।
রাসেলের জন্মের মাত্র দেড় বছরের মাথায় ১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে কারাগারে নেওয়া হয়। কারাগার হয় তার বাড়িঘর। ফলে রাসেল হয় পিতার ছায়ামায়া বঞ্চিত। শেখ হাসিনা লিখছেন: ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে আর আসতে চাইতো না। খুবই কান্নাকাটি করতো। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা আমাদের বাসায় ফেরত যাবো। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফেরত আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা যে কী হতো, আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকতো’।
শেখ মুজিবুর রহমান তার কারাগারের রোচনামচায় লিখেছেন: ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা (রাসেল) এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর আমি ওকে দেবো! ওকে ভোলাতে চেষ্টা করতাম। ও তো বোঝে না, আমি কারাবন্দী। ওকে বলতাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটাকে, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়ে বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে’ । কী দুঃসহ অবস্থা! কী কষ্টকর অভিজ্ঞতা। এরমধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে পিতা-পুত্রকে।
১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দি করে রাখা হয়। তখন পরিবারের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগও কমে আসে। রাসেল বেড়ে উঠতে থাকে এক ভিন্ন পরিবেশে । বাবা তার জীবনে এক দূরের মানুষ। ফলে তার প্রিয় সঙ্গী হয়ে ওঠেন বড় বোন শেখ হাসিনা। রাসেল ডাকতো হাসুপা বলে। হাসুপার হাত ধরেই সে হাঁটা শিখেছে। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল।
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তিনি মুক্ত মানুষ হিসেবে ঘরে ফেরেন। রাসেলের জন্য সেটা এক বড় সুসময়। সারাক্ষণ বাবার কাছাকাছি থাকার ইচ্ছাপূরণ হয় তার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে আবার বিচ্ছেদ। আবার দুঃসহ বেদনার কাল। পিতা বন্দি পাকিস্তানি কারাগারে। বেগম মুজিবও ঢাকায় বন্দি সন্তানদের নিয়ে। দারুণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার জীবন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন। বলা যায়, এই পর্যায়ে শুরু হয় রাসেলের নতুন জীবন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষ ব্যক্তি। দেশে-বিদেশে তার জনপ্রিয়তাও গগনস্পর্শী। শত ব্যস্ততার মধ্যেও রাসেলের সান্নিধ্য তার কাছে ছিল প্রেরণাময়। রাসেলও পিতার ভালোবাসার সবটুকু আদায় করে নিতে ভুলত না। কিন্তু এই সুখ তাদের স্থায়ী হলো না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে একদল বেপরোয়া সৈন্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে চরম বর্বরতায়। আর্মি অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখতো যে শিশু রাসেল তার বুকে বুলেট ছুঁড়ে দিতে হাত কাঁপেনি আর্মিরই কেনো এক পাষণ্ড সদস্যের।
ছোট্ট রাসেল বাঁচার জন্য আকুতি জানিয়েছিল। অনুরোধ করছিল তাকে না মারার। কিন্তু রক্তখেকো দানবেরা তার আবদার, অনুনয় কানে তোলেনি। চোখের সামনে বাবা-মা-ভাই-ভাবিদের রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়তে দেখেছে শিশু রাসেল। এক পর্যায়ে তার বক্ষভেদ করেছে তপ্ত বুলেট। ফোটার আগেই আগেই ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে একটি পবিত্র ফুল।
কী দোষ করেছিল রাসেল? সে তো রাজনীতি করতো না। ক্ষমতার দম্ভ দেখানো বা কারও ক্ষতি বা অনিষ্ট করার বয়সও তার হয়নি। অথচ নিষ্পাপ এই শিশুটিকে হত্যা করে চরম প্রতিহিংসাপরায়ণতার নতুন নজির স্থাপন করেছে ঘাতকেরা। শুধু তাই নয়, শিশু হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ যারা করলো তাদের বিচারের পথও রুদ্ধ করা হয়েছিল দায়মুক্তি অধ্যাদেশের মাধ্যমে।
কথায় আছে, পাপ ছাড়ে না বাপকেও। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে যারা বিচারের আওতামুক্ত থাকবে বলে দম্ভ করেছিল, তাদের বিচারের আওতায় এনেছেন শেখ হাসিনা, রাসেলের প্রিয় ‘হাসুপা’ । বঙ্গবন্ধু হত্যার মাসখানেক আগে স্বামীর কর্মস্থল জার্মানি গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সঙ্গে নিয়েছিলেন ছোট বোন রেহানাকেও। তাই এই দুই বোন আজও বেঁচে আছেন। জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্যই হয়তো তাদের এই বেঁচে থাকা। ইতিহাসের বুঝি এ এক অনন্য বিচার! শেখ রাসেলকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু তখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় রাসেলের আর যাওয়া হয়নি। আহা, রাসেল যদি সেদিন যেতে পারতো!
কী হতে পারতো, আর কী হয়নি তা নিয়ে এখন আক্ষেপ অর্থহীন। জন্মদিনে রাসেলের প্রতি আমাদের অনেক ভালোবাসা। তার মতো আর কোনো শিশুকে যেন এভাবে অকালে ঝরে পড়তে না হয় বৃন্তচ্যুত হতে না হয়, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলেই হবে রাসেলকে মনে রাখার শ্রেষ্ঠ উপায়। শেষ করছি শেখ রাসেলকে নিয়ে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিশুরক্ত’ কবিতাটি উদ্ধৃত করে।
“রাসেল, অবোধ শিশু, তোর জন্য
আমিও কেঁদেছি
খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা
একদিন তুলেছিল আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি
তারাই দুদিন বাদে থুতু দেয়, আগুন ছড়ায়
বয়স্করা এমনই উন্মাদ।
তুই তো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি!
তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো
শিশুরক্ত পানে তার গ্লানি নেই?
সর্বনাশী আমার ধিক্কার নে!
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই। ”
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
আলো ছড়ানোর আগেই যে জীবনে নেমে এসেছিল অন্ধকার ফিচার বিভুরঞ্জন সরকার মুক্তিযুদ্ধ