গেরিলাদের কবলে লাট ভবনের পেট্রোল পাম্প
৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৩৯
একাত্তরে ঢাকার অন্যতম নিরাপদ জায়গা ছিল বড়লাটের ভবন বা গর্ভনর হাউজ, যা প্রাদেশিক গভর্নরের দপ্তর ও বাসস্থান ছিল। যেটি বর্তমানে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বঙ্গভবন হিসেবে পরিচিত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় ঢাকা গভর্নর হাউজের পাশেই ঘটেছিল এক দুর্দান্ত ঘটনা। ঢাকার দুঃসাহসী আরবান গেরিলার দল এই গভর্নর হাউজের পাশেই এক পেট্রোল পাম্পে ঘটিয়েছিল দুর্ধষ অপারেশন।
টয়েনবী সার্কুলার রোডে লাট ভবন অর্থাৎ গভর্নর হাউজের পাশে ছিল দাউদ পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। আগস্টের এক রাতে সেখানে পেট্রোল নিতে এলো একটা ভক্সওয়াগন গাড়ি। পাম্পের ছোকড়া কর্মচারীটি এগিয়ে এসেছিল তাকে পেট্রোল দেবার জন্য, আচমকা সে যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠে চিৎকার করতে শুরু করল এই বলে, ‘আরেব্বাপ রে বাপ! ফ্যান্টোমাস অ্যা গেয়া, ভাগো ভাগো’!’
ততক্ষণে ভক্সওয়াগন থেকে নেমে পড়েছে দুজন লোক। তাদের পরনে লুঙ্গি, একেবারেই সাধারণ বেশভূষা। কিন্তু মুখটা কালো মুখোশে আবৃত। চোখ দুটোর কাছে শুধু দুটো ফোঁকর, সেখানে যেন চোখগুলো জ্বলছে ভাটার মতন। দুজনের হাতেই স্টেনগান। গাড়িতে আছে আরো তিনজন আরোহী, তাদেরও মুখ কালো কাপড়ের মুখোশে ঢাকা।
পেট্রোল পাম্পের ছেলেটার আর্তচিৎকার শুনে আরেকটা ছেলে ‘কেয়া হুয়া রে’ এগিয়ে এসেছিল, কালো মুখোশে ঢাকা স্টেনগানধারীদের দেখে সেও চিৎকার করে উঠলো, ‘ফ্যান্টোমাস অ্যা গেয়া, পাঁচটো ফ্যান্টোমাস’!
মুখোশধারীদের পাল্টা চাপা গর্জন, ‘চিল্লাও মাত, হাত উপার তোলো। হ্যান্ডস আপ’!
কিন্তু বয়েই গেছে বেচারাদের এই সাক্ষাৎ যমদূতদের আদেশ মানতে। কথা শুরু হবার আগেই আগের ছেলেটা দৌড়ে পাম্পের পাশের দেয়াল টপকে ওধারের বাড়িতে চলে গেছে। পরের ছেলেটাও খুবই বাধ্যগতের জন্য তাকে অনুসরণ করল, এক ছুটে পগারপাড়। এক মুখোশধারী ওদের পিছু পিছু ছুটে গেল দেয়াল টপকে।
গাড়ি থেকে এবার নেমে এলো আরেকজন মুখোশধারী। তার নাম নীলু, গেরিলাদের মধ্যে অন্যতম। সোজা চলে গেল পাম্পের অফিস রুমে। সেখানে যে লোকটা ছিল সেও পালিয়ে গেছে। টেবিলের উপর একটা ট্রানজিস্টারে বাজছে গজল গুরু মেহেদী হাসানের গান। নীলু অফিস ঘরে পাহারায় রইল। গাড়ি থেকে নেমে এলো আরেকজন কালো মুখোশধারী।
তার নাম মোফাজ্জ্বল হোসেন চৌধুরী মায়া। তার হাতে একটা বিস্ফোরক চার্জ, পাম্পের কাছেই সে বসে পড়ল। একটা পাম্পে লাগানো হলো ১০ পাউন্ড পি-কের একটা চার্জ। অপর পাম্পে লাগানো হলো একটা ৫ পাউন্ড পি-কের আরেকটা চার্জ। আর এই দুটোর সংযোগসাধন করলো প্রাইমা কর্ড বা কর্ড-এক্স।
এদিকে বাকি কালো মুখোশধারী গাড়ির ইঞ্জিন চালু রেখে স্টিয়ারিং-এ বসে রইলো। তার এক হাতে রিভলবার। তার নাম আবদুস সামাদ। এরইমধ্যে হঠাৎ পেট্রোল পাম্পে তেল নিতে এলো একটা স্কুটার। কিন্তু মুখোশধারীদের কান্ডকারখানা দেখে স্কুটার ফেলেই পালিয়ে গেল সাথে সাথে। কিন্তু একটা বাস হুট করে ঢুকে পড়লো পাম্পের প্রাঙ্গণে। ঢুকেই যেন কালো মুখোশে ঢাকা সাক্ষাৎ যমদূত দেখলো বাসের ড্রাইভার। দোয়া পড়তে শুরু করে দিল সে।
কন্ডাক্টর বাস থেকে বেরিয়ে তারপরে দেখলো মুখোশধারীদের। পাথর হয়ে গেল সে জায়গায় দাঁড়িয়েই, নট নড়নচড়ন। কর্ড এক্স ইগনাইট করল মায়া। প্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠলো লাট ভবন অর্থাৎ গভর্নর হাউজ। সম্ভবত কেঁপে উঠেছিল পাকিস্তানীদের পা চাটা কুকুর গভর্নর মালেকের বুকও!
বিস্ফোরণের পর ধীরে-সুস্থে কালো মুখোশধারীরা এসে গাড়িতে চড়লো। শুধু দু’জন ছাড়া। তাদের চিৎকার করে ডাকা হলো। কিন্তু কোন সাড়া নেই। তারা মূলত এতোক্ষণ পাম্পের বাইরের রাস্তায় পাহারা দিচ্ছিল যেন কোন পাকিস্তানী কনভয় চলে না আসে। তাদের সাথে কথা ছিল, যদি আচমকা কোন সমস্যা হয়, তবে পেট্রোল পাম্প ওড়াতে আসা গেরিলারা রিট্রিট করবে পেছন থেকে। পেছনের রেল লাইন ধরে তারা জয়কালী মন্দিরের কাছে রেল ক্রসিং-এ অপেক্ষা করবে।
যেহেতু তাদের পাম্পের পেছনে পাওয়া গেল না, ভক্সওয়াগন ছুটে গেল রেল ক্রসিং-এর কাছে, দেখা গেল দুই গেরিলা সেখান থেকে ছুটে আসছে হাতে স্টেনগান নিয়ে। গাড়িতে ওঠার পরেই দেখা দিল আরেক বিপত্তি। থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে এলো কয়েকটা রাজাকার। তাদের দেখা মাত্র গাড়ি থেকে বৃষ্টির মতন স্টেনগানের ফায়ারিং শুরু হলো। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল একজন রাজাকার, বাকিরা গুলি খেয়ে কোনক্রমে পালালো সেখান থেকে। ব্যস, রাস্তা ফকফকে পরিষ্কার!
যে দুজন কালো মুখোশধারী স্টেনগান হাতে বাইরে পাহারায় ছিল, তাদের একজন হচ্ছে গাজী দস্তগীর (গফুর) এবং টুলটুল। গাড়িটির মালিক ছিলেন তৎকালীন বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার জনাব ইসলাম সাহেব।
তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ ১। স্বাধীনতা সংগ্রাম–ঢাকায় গেরিলা অপারেশন/হেদায়েত হোসেন মোরশেদ
২। ব্রেভ অফ হার্টস/হাবিবুল আলম বীর প্রতীক
সারাবাংলা/এজেডএস