গেরিলাদের চতুরতায় পাকিস্তানীদের সেইমসাইড ফায়ারিং
৬ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৫৬
একাত্তরের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ইসলামী সেক্রেটারীয়েটের সেক্রেটারী জেনারেল ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকায় ঘটে এক দুর্ধষ ঘটনা। সারারাত তুমুল গোলাগুলি হলো, প্রচুর ক্যাজুয়ালিটিও হলো দুই পক্ষেই, কিন্তু এ পক্ষেও পাকিস্তানী সেনা, ওপক্ষেও পাকিস্তানী সেনা! দুইপক্ষ মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০ জন!
ঘটনাটা ঘটেছিল ঢাকার সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী এলাকায়। একাত্তরের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ক্র্যাক প্লাটুনের চারজন গেরিলা পুলু, হানিফ, মোজাম্মেল ও বারেক মিলে পাকিস্তানী সেনাদের জন্য একটা অ্যাম্বুশের ফাঁদ পেতেছিল। দিলীপ জর্দার কৌটার মতন দেখতে তিনটা মিনি মাইন এবং একটা থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও একটা স্টেনগান নিয়ে এই অপারেশনে গিয়েছিল তারা।
ঘটনার শুরু এক নির্দোষ কৌতুহল থেকে। ধলপুরে তখন পুলুদের ঘাঁটি। স্টেনগান, লাইট মেশিনগান, রাইফেল, রিভলবার, এস এল আর , হ্যান্ডগ্রেনেড ইত্যাদি বিভিন্ন অস্ত্র এতদিন ব্যবহার করেছে তারা, কিন্তু জর্দার ডিব্বার মতন দেখতে মিনি মাইন বিস্ফোরকটা আর ব্যবহার করা হয়নি। তাদের ট্রেনিং-এর সময় বলা হয়েছিল এই জিনিসটা নাকি খুবই কড়া। ‘সোফার কুশনের নীচে কোনভাবে যদি ঐ ডিব্বার মত বিস্ফোরকটা লুকিয়ে রাখতে পারো, আর বড় সাহেব যদি এসে সেই সোফায় বসেন তখন দেখবে বসতে না বসতেই বড় সাহেব এক লাফে তিনতলায় উঠে গেছেন।’
যেহেতু এই মিনি মাইনগুলো মূলত গাড়ি ওল্টাতে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু গেরিলাদেরভ সামনে এই সুযোগও আসছিল না সেভাবে। মূলত কৌতূহল থেকেই হানিফ আর পুলু বললো, ‘নাহ, এগুলো এইভাবে এমনি ফেলে রাখার কোন মানে হয় না। জিনিসটার তেজ আসলে কত সেটা পরীক্ষা করা দরকার!’ জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহের এক রাতে তারা সায়েদাবাদ পুলের ওপাশে যাত্রাবাড়ী অভিমুখী রাস্তার উপর সেই মিনি মাইন তিনটা রেখে দিল। রাত তখন বারোটা।
মাইন পেতে রেখেই বিচ্ছুর দল এক ছুটে পাশের এক বাড়িতে গিয়ে বসে থাকলো তেলেসমাতি সচক্ষে দেখার জন্য। যাত্রাবাড়ির ঐ রাস্তায় মাইন বসানোর আরো কিছু উদ্দেশ্য ছিল। ঐ রাস্তা দিয়ে হরদম মিলিটারী কনভয় যাতায়াত করছিল। এবং রাত দশটার পর মিলিটারি কনভয় ব্যাতীত ঐ রাস্তা একেবারেই জনশূন্য হয়ে পড়ে। এছাড়াও সায়েদাবাদ পুল ও যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার মধ্যবর্তী এক জায়গায় রয়েছে হানাদার সেনাদের একটা ক্যাম্প ও চেকপোস্ট। গেরিলাদের লক্ষ্য হচ্ছে জর্দার ডিব্বার বাজনা ঐ দুরবর্তী পাকিস্তানী হানাদারদেরও শোনানো যাবে।
কিন্তু গেরিলারা খুব সম্ভবত তারা নিজেরাও কল্পনা করতে পারেনি যে এরপরে আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে।
রাত পৌনে একটা বেজে গেল কিন্তু কোন গাড়ীরই পাত্তা নেই। সোয়া একটা, দেড়টা, পৌনে দুইটা, দুইটা… রাত ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাবাহী কোন যানবাহনের পাত্তাই নেই। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে গেরিলারা যখনই আজকের মতন উঠে যাবে ভাবছে, তখনই আচমকা দেখা গেল যাত্রাবাড়ির দিক থেকে আসছে দুই জোড়া হেডলাইট। সামনে গাড়ি থেকে পেছনের গাড়ির দুুরত্ব সবমিলিয়ে ৫০-৬০ গজের বেশি। প্রচন্ড উত্তেজিত গেরিলাদলের সামনে খানিক পরেই প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ!
সামনের গাড়িটি ছিল পাকিস্তানী খানসেনা ভর্তি এক মিলিটারী লরি। ছিটকে গিয়ে উল্টে পড়ল পাশের নীচু জলাভূমিতে। গতির ভারসাম্য হারিয়ে পেছনের গাড়িটিও সোজা একইপথের যাত্রী হলো। পরের লরীটিও ছিল খানসেনা ভর্তি। রীতিমত যেন নরক নেমে এলো দুই লরীর খানসেনাদের উপর। ডোবার নোংরা পানিতে ভিজে জবজবে হয়ে যখন পাকিস্তানী সেনারা রাস্তায় ওঠার কসরত করছে, এমন সময়ই তাদের উপর নেমে এলো আরেক আজাব!
যাত্রাবাড়ী মিলিটারী চেকপোস্ট থেকে ঝাঁক বেঁধে ছুটে এলো এলএমজির টানা বুলেটবৃষ্টি! চেকপোস্টের পাকিস্তানী সেনারা ভেবেছে হামলাকারী ‘মুকুতলোগ’রা তাদের লক্ষ্য করেই হামলা করেছে, সুতরাং তারাও বীরের মতন ছুটিয়ে দিল তাদের রাইফেলের ঘোড়া! এদিকে লরী উলটে গড়াগড়ি খাওয়া পাকিস্তানী সেনারা ততক্ষণে জান বাঁচাতেই পজিশন নিয়েছে রাস্তার এদিকে, তারাও ধারণা করল মুক্তিবাহিনীর বিচ্ছুরা মাইন ফাটিয়ে তাদের এলোমেলো করে এখন গুলি ছুড়ছে শেষ করে দেবার জন্য, সুতরাং তারাও গুলি করতে শুরু করল যাত্রাবাড়ীর চেকপোস্টের যেদিক থেকে গুলি আসছে সেটা লক্ষ্য করে! ফলে দুপক্ষের মধ্যে শুরু হলো সেইমসাইড ফায়ারিং!
দুইপক্ষের এই সেইমসাইড চললো বেশ অনেকক্ষণ ধরে। একপর্যায়ে যখন থামলো, তখন গেরিলারা শুরু করল তাদের কাজ। এই সুযোগে যতগুলো জেনোসাইডার পিশাচকে নরকে পাঠানো যায় আর কি! গেরিলারা তাদের স্টেনগান নিয়ে এক ছুটে চলে এলো সেই বাড়ির ছাদে, আকাশের দিকে লক্ষ্য করে ছুড়লো একরাশ গুলি। ব্যস! সেই শব্দ পাওয়া মাত্র আবার শুরু হলো খানসেনাদের নিজেরাই নিজেদের শেষ করার সেইমসাইড! এবার আরো বড় আকারে! অর্থাৎ যাত্রাবাড়ি পুলের পাকিস্তানী সেনারা মনে করতে লাগলো সায়েদাবাদ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করছে, সায়েদাবাদ পুলের পাকিস্তানী সেনারা মনে করতে লাগলো মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করছে যাত্রাবাড়ি থেকে।
ফলে দুইপক্ষের মধ্যে এই সেইম সাইড গোলাগুলি চলতে লাগলো ঘন্টার পর ঘন্টা। এই সার্কাস উপভোগ শেষে রাত চারটার দিকে গেরিলারা চলে এলো সেই স্থান থেকে। ভোর পর্যন্ত গুলি চললো দুইপক্ষের মধ্যেই। ভোরের দিকে হাটখোলার দিক থেকে এবং ডেমরার দিক থেকে এলো ভারী ভারী যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের আর্টিলারী বাহিনী। পরে বোঝা গেল সারারাত এরা একে অন্যের দিকে গুলি ছুঁড়েছে, খুবই হাস্যকর কিন্তু রক্তক্ষয়ী এক সেইম সাইড!
রাগে ক্ষোভে দুঃখে ভোর থেকে বিকাল পর্যন্ত হাটখোলা মোড় থেকে যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তা পর্যন্ত কারফিউ দিয়ে তাণ্ডব চালালো পাকিস্তানী সেনারা। রাস্তার পাশের বাড়ি থেকে বাড়ি তল্লাশী করলো, ঘরবাড়ি তছনছ করল, যে যা পারলো লুটপাট চালালো। মুক্তি খুঁজতে লাগলো তারা, অথচ সত্যিকারের মুক্তিরা ততক্ষণে এই এলাকার ত্রিসীমানা থেকে গায়েব!
তথ্যসূত্রঃ
১। স্বাধীনতার সংগ্রাম ঢাকায় গেরিলা অপারেশন/ হেদায়েত হোসেন মোরশেদ
২। ব্রেভ অফ হার্ট/ হাবিবুল আলম বীর প্রতীক
সারাবাংলা/এসবিডিই
গেরিলাদের চতুরতায় পাকিস্তানীদের সেইমসাইড ফায়ারিং রহমান রা'আদ