Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুক্তিযুদ্ধে চৌগাছা রণাঙ্গন ও একজন বীরবিক্রম নাজমুল হুদা

শিশির ওয়াহিদ
৭ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:০১

অকুতোভয় কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা (বীরবিক্রম), যাঁর কাছে চিরঋণী যশোরের মানুষ।

যশোরের চৌগাছা উপজেলার বর্ণী বিওপি (রামকৃষ্ণপুর বাজার সংলগ্ন)। ১৯৭১ সালে সেখানে ছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত একটি ঘাঁটি। ছিলো প্রায় ৭৫ জন পাকিস্তানি সেনা। ওই ঘাঁটির কারণে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে সহজে অপারেশন করতে পারছিলেন না। একাত্তরের আগস্টের প্রথম দিকে খন্দকার নাজমুল হুদা সিদ্ধান্ত নিলেন সেখানে আক্রমণ পরিচালনার।

বিজ্ঞাপন

বর্ণী বিওপির অবস্থান কৌশলগত দিক দিয়ে ছিলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের বাগদা এলাকা থেকে রামকৃষ্ণপুর-পুড়াপাড়া হয়ে একটি রাস্তা চৌগাছা পর্যন্ত চলে গেছে, যা দিয়ে কোম্পানি আকারের চেয়েও বড়াে ধরনের সেনা দলের অগ্রাভিযান পরিচালনা করা সম্ভব।

বর্ণী বিওপি বাগদা-পুড়াপাড়া-চৌগাছা অক্ষের উপর অবস্থিত সুরক্ষিত অবস্থান এবং কৌশলগত দিক থেকে এ এলাকার বিওপি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল ।

খন্দকার নাজমুল হুদা প্রকৃতপক্ষেই ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা। ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তিনি। বর্ণী বিওপি এলাকা বয়রা সাব-সেক্টরের আওতাধীন ছিল। আনুমানিক ৯০জন মুক্তিযােদ্ধা ৩টি ভাগে বিভক্ত হয়ে ৩টি অবস্থান থেকে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

সুখপুকুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবন-পুড়াপাড়া রাস্তা বরাবর ২ প্ল্যাটুন মুক্তিযােদ্ধা ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে ছিলো। রাজাপুর এলাকায় আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ছিল ১ সেকশন মুক্তিযােদ্ধা এবং রামকৃষ্ণপুর গ্রামে সৈয়দ গােলাম কবিরের নেতৃত্বে ছিল ১ সেকশন মুক্তিযোদ্ধা।

একাত্তরের ৫ আগস্ট ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা প্রায় দুই কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে বর্ণী বিওপিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের উপর আক্রমণ চালান। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা তাদের ১৫ জনের লাশ ফেলে রেখেই পালিয়ে যায় সেদিনের যুদ্ধে। যুদ্ধজয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র, গোলা নিজেদের ঘাঁটিতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কর্নেল নাজমুল হুদা তা তদারক করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ আরেক দল পাকিস্তানি সেনা পেছন থেকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় তাঁদের ওপর আক্রমণ করে। সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ৪ জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। কিন্তু ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা মৃত্যুর হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পান। ল্যান্স নায়েক নূর মােহাম্মদ শেখ (বীরশ্রেষ্ঠ) ও হাবিলদার আবুল হােসেনের সাহায্যে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা পুড়াপাড়া খাল পার হয়ে অন্যদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে ফিরে আসেন।

বিজ্ঞাপন

শুধু বর্ণী নয়, চৌগাছা, মাশিলা, গরিবপুর, রঘুনাথপুর, যাদবপুর (শার্শা), বেলতা-কাশিপুর, গঙ্গানন্দপুর, প্রভৃতি যুদ্ধে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এবং তিনি প্রত্যক্ষ যুদ্ধেও অংশ নিতেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ৩ ডিসেম্বর চৌগাছা মুক্ত হয়। দেশের প্রথম মুক্ত অঞ্চল হিসেবে চৌগাছাকে স্বাধীনতার প্রবেশদ্বার বলা হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০২৩ এ বলিউডের ‘পিপ্পা’ সিনেমাটি ঐ গরিবপুরের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে, গরিবপুরের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার নাজমুল হুদা।

একাত্তরের উত্তাল মার্চে নাজমুল হুদা কুষ্টিয়ায় অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে তিনি মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে অসমসাহসিকতার জন্য তিনি ‘বীরবিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত হন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা বুঝে ফেলেন যে মোশতাক-জিয়া গং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চক্রের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে সেনাবাহিনী এবং দেশকে পাকিস্তানি ধারার একটি দেশে পরিণত করতেই ১৫ আগষ্ট সৃষ্টি করেছে। তাই দেশের সেই ক্রান্তিকালে কর্নেল নাজমুল হুদা চুপ করে বসে থাকতে পারেননি। খুনি মোশতাক-জিয়া-ফারুক-রশীদের সরকার উৎখাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের (বীরউত্তম) সঙ্গে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে যোগ দেন। কিন্তু এর ৩ দিনের মাথায় পাল্টা আরেক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে নাজমুল হুদা আর এটিএম হায়দার সহ ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে প্রাণ হারাতে হয় খালেদ মোশাররফকে।

আর হত্যার পর তাদের নিয়ে চলতে থাকে নানা অপপ্রচার। একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের শপথের দিন মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ পড়ানো খালেদ মোশাররফ ছিলেন ২নং সেক্টর কমান্ডার আর কে-ফোর্সের অধিনায়ক। রণাঙ্গনের সাহসিকতার জন্য কর্নেল হুদা আর হায়দারও পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় খেতাব। কিন্তু ৭ নভেম্বর নির্মমভাবে প্রাণ হারানোর পর এসব মুক্তিযোদ্ধাকেই তখনকার রাষ্ট্রযন্ত্র চিত্রিত করে অন্য দেশের চর হিসেবে। পরিবারের সদস্যদেরও দিন পার করতে হয় নানা প্রতিকূলতায়।

খুনি জিয়া সাড়ে ৫ বছর ক্ষমতায় থেকে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার তো দূরের কথা বিভাগীয় তদন্তও করতে দেয়নি।

তথ্যসূত্র: ১. মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান- সপ্তম খন্ড, ২. সংগ্রামের নোটবুক, ৩. রণাঙ্গনে যশোর গ্রন্থ, ৪. উইকিপিডিয়া।

লেখক: শিক্ষার্থী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এসবিডিই

মুক্তিযুদ্ধে চৌগাছা রণাঙ্গন ও একজন বীরবিক্রম নাজমুল হুদা শিশির ওয়াহিদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর