মুক্তিযুদ্ধে যার স্টেথোস্কোপ হয়ে উঠেছিল অস্ত্র
১৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:৫১
একাত্তরের পুরো সময়টা জুড়ে অস্ত্র হাতে সম্মুখসমরে যুদ্ধ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা, কিন্তু এমনও অনেক যোদ্ধা ছিলেন যাদের যুদ্ধটা ছিল অন্য ফ্রন্টে, অন্যভাবে। বঙ্গবন্ধুর ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’ নির্দেশনার অসামান্য বাস্তবায়ন ঘটেছিল, ছাত্র-কৃষক থেকে শুরু করে পেশাজীবী নানা মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিজেদের সম্বল নিয়েই। এরমধ্যে অন্যতম প্রণিধানযোগ্য বাঙালি ডাক্তাররা। যে বাঙালি ডাক্তাররা মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে গোপনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করে গেছেন নিরন্তর, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডা. আজহারুল ইসলাম। অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পর থেকেই এই মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিঃশব্দ দেবদূত।
আজহারুল হকের পৈত্রিক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থানার রাধানগর গ্রামে। ১৯৪০ সালের ২ মার্চ ঢাকায় তার জন্ম। বাবা মো. জহুরুল হক তখন ছিলেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলার। তার মা ফাতেমা খাতুন। তার ডাক নাম ছিল খোকন। স্ত্রী সালমা হক তাকে ডাকতেন ‘ডাক্তার’ বলে। মেধাবী আজহারুল ইসলাম পড়াশোনার পাশাপাশি খুব ভালো ফুটবল খেলতেন, অনেকগুলো কাপ ও শিল্ড জিতেছিলেন তার স্কুল ও কলেজের দলের হয়ে। এর বাইরে গান গাইতে পারতেন, লেখালেখি করতেন টুকটাক। ১৯৬৩ সালে সিলেট মেডিকেল স্কুল থেকে এলএমএফ ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করা আজহারুল এক বছর ইন্টার্নশিপ শেষে ১৯৬৯ সালের ২৬ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহকারী সার্জন পদে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেন সৈয়দ সালমা হককে, একাত্তরে আজহারুলের বয়স ছিল ৩১ বছর।
১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তার গর্ভবতী স্ত্রী ভর্তি হন ঢামেকে, শ্বাশুড়িসহ আরও দুজন আত্মীয় রোগী হিসেবে ভর্তি ছিলেন, সুতরাং আজহারুল তাদের দেখাশোনা করছিলেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি সেনাদের ঘৃণ্যতম গণহত্যা অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পরে প্রচণ্ড গোলাগুলি আর মর্টার শেলিং-এর বিকট শব্দের ধাক্কায় সাময়িকভাবে হতভম্ব হয়ে গেলেও তাৎক্ষনিক নিজ কর্তব্য পালনে নেমে পড়েন আজহারুল। সালমা পরে জেনেছিলেন, সারা রাত জুড়ে অসংখ্য বুলেটবিদ্ধ, বোমার আঘাতপ্রাপ্ত মুমূর্ষু আহত রোগীতে ভরে যায় হাসপাতাল, কোনো ওয়ার্ড এমনকি করিডোর বা বারান্দা খালি ছিল না। হাসপাতালে তখন উপস্থিত ডাক্তারের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য, আজহারসহ সামান্য যে কয়জন ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই মিলে আহতদের অস্ত্রোপচার করে বুলেট বের করে অপারেশন ও চিকিৎসা চালিয়ে যান পরদিন পর্যন্ত।
একাত্তরের পুরো সময়টা জুড়েই আজহারুল ভয়াবহ সব ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা করে গেছেন অকুতোভয়ে। তার স্ত্রী সালমা হক এক লেখায় আজহারুলের দুঃসাহসের বিবরণ দিয়েছিলেন এভাবে—
“আজিমপুর কলোনির ১ নাম্বার বিল্ডিং-এর বি ফ্ল্যাটে ফুড ডিপার্টমেন্টের এক ভদ্রলোকের ছেলে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের দশম শ্রেণীর ছাত্রকে ২৬শে মার্চ সকাল ১০টার দিকে পাক-আর্মিরা কলোনিতে ঢুকে ওই ১ নাম্বার বিল্ডিং-এর ছাদের কালো পতাকাটি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। ছেলেটি যখন ওই কালো পতাকাটি নামানোর জন্য ছাদে ওঠে ঠিক সেই সময় নীচ থেকে আর্মিরা গুলি করে। গুলি ছেলেটির পায়ে লাগে। আহত ছেলেটির গুলি বের করার জন্য অভিভাবকরা হন্যে হয়ে ডাক্তার খুঁজে শেষে ২৭শে মার্চ বুলেটবিদ্ধ ছেলেটির বাবা ডাক্তার পাওয়ার আশায় ঢাকা মেডিকেলে যান এবং উপস্থিত কয়েকজন ডাক্তারকে ঘটনাটি বলে ছেলেটির জীবন বাঁচানোর জন্য কাতর প্রার্থনা করেন। এই কথা শোনা মাত্র ডা. আজহার সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে ছেলেটির বাবার সঙ্গে গোপনে আজিমপুরে ওই বাসাতে গিয়ে বুলেটটি অল্পক্ষণের মধ্যেই বের করতে সক্ষম হন। এরপর থেকে প্রতিদিন আজহার ছেলেটির ড্রেসিং বদলানোর জন্য খুব গোপনে ওই বাসায় যেতেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেটি পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। এখন ছেলেটি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে শুনেছি। তার নাম এখন আর মনে নেই।”
মুক্তিযুদ্ধের আগে আজহারুল হক কাজী আলাউদ্দিন রোডের শামীম ব্রাদার্স নামে একটি ফার্মেসিতে বসতেন। যুদ্ধ শুরুর পর তিনি হাতিরপুলে সাইদা ফার্মেসিতে বসা শুরু করলেন। কেন, সেটা জানা গেল অনেক পরে। এমন ভয়াবহ যুদ্ধপরিস্থিতিতে প্রতিদিন গভীর রাতে বাসায় ফেরার কারণ স্ত্রী সালমা জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রতিদিনই— দূরের কলে গিয়েছিলেন, রোগীর ভিড় ছিল, ক্রিটিকাল রোগী ছিল— ইত্যাদি নিত্যনতুন অজুহাত দিলেও সত্য কথাটি কখনোই বলতেন না। স্ত্রী ফার্মেসিতে বসতে মানা করলে বরং হাসতে হাসতে বলতেন, ‘আমি ডাক্তার মানুষ, আমার যা ডিউটি, তা তো আমাকে করতেই হবে, রোগীরা কি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে?’ যুদ্ধের ভেতর এতো রোগী কোথা থেকে আসে, সালমা একদিন জিজ্ঞেস করতেই বলেছিলেন, ‘আরে বোঝ না কেন, ডাক্তার কই, বেশিরভাগই তো এখন এখানে নেই, ডাক্তারের অভাব, তাই এত ভিড় মনে হচ্ছে।’
কিন্তু ডাক্তার আজহারুল শুধু স্বাভাবিক রোগীদের চিকিৎসা করছিলেন না, তিনি চালাচ্ছিলেন আরও দুঃসাহসিক এক কর্মযজ্ঞ। সাইদা ফার্মেসিতে তো চিকিৎসা করতেনই, একইসঙ্গে তিনি দূরবর্তী নানা জায়গায় বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে গোপনে গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন, সহায়তা করতেন যতদূর পারেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা এবং তাদের সহায়তা করার বিষয়টি একসময় আলবদর জল্লাদ বাহিনীর সদস্যদের গোচরীভূত হলে তার হাতিরপুলের চেম্বারের ঠিকানায় পত্রযোগে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের কোনো এক সময় তাকে পুলিশ সদর দফতরে ডেকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে তার কার্যক্রমের জন্য কঠোরভাবে শাসানোও হয়।
উপায়ন্তর না দেখে নিজের পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে আজহারুল তখন থেকে সাইদা ফার্মেসিতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করা বন্ধ করে দেন। কিন্তু কোনো হুমকি ধমকি দিয়ে তাকে থামানো ছিল অসম্ভব। ফার্মেসি কিংবা প্রকাশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা বন্ধ করে তিনি হাতিরপুল ও এর পার্শ্ববর্তী বস্তি এলাকায় একেবারেই গোপনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কখনো বা তিনি গভীর রাতে অবাঙালি (বিহারি) অধ্যুষিত এলাকা মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে গিয়েও গোপনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। এই প্রতিটি ‘কল’ই ছিল তার জন্য মৃত্যু পরোয়ানা স্বরূপ। কারণ প্রাণ হাতে করে তখনকার জল্লাদখানা মিরপুর মোহাম্মদপুরে এই যাওয়া আসার মধ্যে যদি কোনোভাবে একবার তিনি বিহারি বা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে যেতেন, তার মূল উদ্দেশ্য প্রকাশ হয়ে পড়ত, তাহলে তার লাশও খুঁজে পাওয়া যেত না। এতো বিশাল ঝুঁকি নিয়েও আজহারুল একবারের জন্যও দমে যাননি, থামেননি। পুরো একাত্তর জুড়ে এভাবে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া সারা ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা আর সেবা করতে, সাহায্য করতে। কোনো ভয়ভীতি বা হুমকিই আজহারুল হককে তার কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
প্রতি রাতেই বাসায় ফিরে স্ত্রীকে সাহস দিতেন, ভরসা দিতেন, যুদ্ধের খবর শোনাতেন, আরবান মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলার খবর এবং পাকিস্তানি সেনাদের হতাহতের ঘটনা শোনাতেন। অসম্ভব আশাবাদী মানুষ ছিলেন আজহারুল, বলতেন, ‘আর কয়টা দিন সবুর করো, দ্যাখো না কী হয়, শিগগিরই দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে।’ অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পাশে স্বামীর যথাযথ দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন তিনি এই ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও। কাপড়-চোপড় ডেটল দিয়ে ধুয়ে পৃথক একটা সুটকেস রেডি রেখেছিলেন, দোকান থেকে বাচ্চার জন্য নতুন কাপড়ও কিছু কিনে এনেছিলেন। কিন্তু নিয়তির অমোঘ বিধানে সন্তানের চেহারাটা আর তার দেখার ভাগ্য হয়নি।
আগুন নিয়ে খেলছিলেন আজহারুল, জেনেবুঝেই প্রবল ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য ও চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ায় আলবদর জল্লাদদের শত্রু বুদ্ধিজীবী নিধনের তালিকায় তার নাম ছিল উপরের দিকে। প্রিয়তমাকে কখনো বলতেন না তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন পাছে যদি তিনি মানসিক দুশ্চিন্তায় ভোগেন, কিন্তু স্ত্রী পরে জেনেছিলেন আসল সত্যটা। সালমা লেখেন—
“ডাক্তার শহিদ হবার পর সাইদা ফার্মেসির তখনকার মালিকদের কাছে জানতে পারলাম কেন তিনি অধিক রাতে বাসায় ফিরতেন। তারাই আমাকে জানালেন ডাক্তার আহত, বুলেটবিদ্ধ ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ডেরায় গিয়ে চিকিৎসা করতেন, বুলেট বের করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একবার চোখ ওঠা রোগ হয়েছিল, তখন নাকি ডাক্তার ওদের জন্য ভীষণ কষ্ট করে ওষুধ জোগাড় করে নিজ হাতে পৌঁছে দিতেন। হাতিরপুল এলাকাটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আখড়া, তাই যত ঔষধ, চিকিৎসা সব আজহার করতেন।”
তার পরিণতি সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই জানতেন আজহারুল, জানতেন আজ বা কাল যেকোনো দিন ধরা পড়তেই হবে। সেই দিনটি এলো অবশেষে। ১৪ নভেম্বর দিবাগত রাতেই কারফিউ জারি করে পাকিস্তানি সেনারা, সকাল থেকেই আল-বদর বাহিনীর সশস্ত্র কর্মীরা ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, হাতিরপুল ও সেন্ট্রাল রোড ঘেরাও করে রাখে। কারফিউয়ের মধ্যে হাসপাতালে যাওয়ার কোনো উপায় না দেখে আজহারুল হক হাকিম হাউজের মালিক খান বাহাদুর আব্দুল হাকিমের বাসায় গিয়ে হাসপাতালে টেলিফোন করেন অ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার জন্য। বাড়ির প্রধান ফটকে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য যখন তিনি অপেক্ষা করছিলেন ঠিক তখনই একই ভবনের বাসিন্দা তাঁর সহকর্মী ডা. এ.বি.এম হুমায়ুন কবির আজহারুল হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করছেন জেনে রেডি হয়ে নীচে নেমে আসে। ডা. হুমায়ুন কবিরের সেদিন ইন্টার্নশিপের প্রথম দিন ছিল। তারা দুজনে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু তারা ভাবতেও পারেননি কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। সেই মুহূর্তটার বর্ণনা দিয়েছেন আজহারুলের স্ত্রী সালমা।
”আমি ও আমার ভাই সৈয়দ রফিকুস সালেহীন মনে করেছি অ্যাম্বুলেন্স এসেছে ও আজহার, হুমায়ুন কবির নিশ্চয়ই হসপিটালে চলে গেছেন। আমরা এই বিষয়টিই আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ দেখি আমাদের বারান্দায় ৫ জন লোক ঢুকছে, এর মধ্যে ৪ জনের গাঢ় জলপাই রঙের পোশাক, মাথায় ক্যাপ ও হাতে বেয়োনেট লাগানো রাইফেল। সিভিল ড্রেসে একজন লোক, চোখে কালো গগলস, তার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, এই ব্যক্তিই আসসালামালাইকুম দিল, আমি ও আমার ভাই তাড়াতাড়ি রুম থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, ওরা আমাদের বুক বরাবর রাইফেল তাক করে জিজ্ঞাসা করল, ‘ডা. হুমায়ুন কবিরকে চেনেন?’ আমি তাকে বাঁচানোর জন্য বললাম, ‘না, চিনি না।’ তখন ওরা আমার ভাইকেও জিজ্ঞাসা করল, চেনেন কিনা, তিনিও ‘না’ বললেন। এরপর ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার হাসবেন্ডের নাম কী? তিনি কী করেন?’ আমি তার নাম ও পেশা বললাম। মেডিকেলে চাকরি করে শুনে কত নাম্বার রুমে বসেন, কোন ডিপার্টমেন্টে আছেন ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলো, আমি সব ঠিক ঠিক জবাব দিলাম। শেষে তারা জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন উনি কোথায়?’ বললাম, ‘হসপিটালে।’ এই কথা শুনে একজন রাইফেলধারী অন্য একজন রাইফেলধারীর চোখা-চোখি করল এবং একটু মৃদু হাসল। এরপর ওরা ঘরে ঢুকে চেয়ারের গদি কয়েকটা উল্টিয়ে দেখে চলে গেল, যাবার সময় বললো, ‘ডোন্ট মাইন্ড।”
সেদিন আজহারুলদের জন্য অ্যাম্বুলেন্সটা শেষ পর্যন্ত ফ্রি স্ট্রীট স্কুলে আসতে পারেনি। আলবদর কর্মীরা সেই অ্যাম্বুলেন্স স্ট্রীটে ঢোকার পথেই আটকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। এবং তারা যাকে খুঁজছিল সেই আজহারুলকে তারা পেয়ে যায় তার বাসার সামনেই, সাথে আরেকজন বাঙ্গালী ডাক্তার হুমায়ূন কবির। বদর বাহিনীর কয়েকজন সশস্ত্র কর্মী বাসার ফটকের সামনে ইউনিফর্ম পরিহিত দুজন চিকিৎসককে দেখে তাদের দিকে এগিয়ে আসে এবং জেরা করতে থাকে। তাদের কথাবার্তায় যখন বুঝতে পারে যে ইনিই আজহারুল, তখন একজন বদরকর্মী আচমকা আজহারুলের ডান হাতে রাইফেল দিয়ে সজোরে আঘাত করে। আচমকা এই আঘাতে দুজনেই হতভম্ব হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন এসে সামনে, পিছনে রাইফেল তাক করে ওদের দু’জনকে তেঁতুল গাছের তলা থেকে হাতিরপুল পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি জিপ গাড়িতে তোলে। সেই গাড়ি নাকি হাতিরপুল এলাকার আজিজ ওয়ার্কশপের মালিক খান নামে পরিচিত বিহারি লোকটি ছিল, সেই লোকই নাকি সে সময় দালালি করত। ধারণা করা হয় যে সেই বিহারিই মূলত আজহারুলের বাসা চিনিয়ে দিয়েছিল।
১৬ নভেম্বর চোখ ও হাত পা বাঁধা অবস্থায় আজহারুল হক ও হুমায়ুন কবিরের মৃতদেহ মতিঝিলে নটরডেম কলেজের নিকটস্থ কালভার্টের পূর্বপ্রান্তে পানিতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। হাত-পা, চোখ বাঁধা, শুধু অন্তর্বাস পরনে নিথর মৃতদেহ পরীক্ষা করতে জানা গেল, কঠোর নির্যাতনের পর শ্বাসরোধ করে তাদের হত্যা করা হয়েছে। জল্লাদেরা কোনো গুলি খরচ করে নয়, এমনকি বেয়নেট দিয়েও নয়, শুধু পিটিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল। আজহারুলের জীবন এখানেই থেমে গেল, তার সব স্বপ্ন, সাধ শেষ হয়ে গেল এখানেই, অনাগত সন্তানকে বুকে চেপে আদর করার সুযোগ তিনি পেলেন না, চলে গেলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক মাস আগে। তার স্ত্রী এমনকি তখন মন খুলে কাঁদার সুযোগও পাননি। ওয়াপদা কলোনি ভাইয়ের বাসার পাশেই ছিল শাহবাগ রোড, ওই রাস্তা দিয়ে সারাক্ষণ অনবরত মিলিটারি জিপ আসা-যাওয়া করত। সালমার ভাই তাকে শব্দ করে কাঁদতে শুনলেই বলতেন, ‘এখানে ডেডবডি আনা হয়েছিল তা অনেকেই জানে, আবার কান্নাকাটি শুনলে ওরা এসে আমাদের সবাইকে উঠিয়ে নিয়ে মেরে ফেলতে পারে।’
সালমা স্বামী হারাবার প্রচণ্ড শোকে চিৎকার করে কাঁদবার সুযোগ পান ১৬ই ডিসেম্বর। তার নিজের লেখায় উল্লেখ করেছেন সেই সময়টি।
“যখন প্রথম আমি নিজ কানে দূর থেকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনতে পেলাম তখন আমার মনঃপ্রাণ তোলপাড় করে কান্নার ঢল নেমে এলো, সবচেয়ে বেশি প্রাণ খুলে ওই সময় কাঁদলাম। তখনই আমি বেশি করে বুঝতে পারলাম ডাক্তার নেই। আমার হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছিল এই ভেবে—মাত্র একটি মাসের জন্য ডাক্তারকে হারালাম, মাত্র কয়েকটি দিনের ব্যবধানে দেশ স্বাধীন হলো, অথচ ডাক্তার দেখতে পেলো না। ১৮ই ডিসেম্বর ইস্কাটন গার্ডেন থেকে আবার ভাইয়ের পরীবাগের বাসায় ফিরছিলাম, রাস্তায় দেখলাম, শুধু ইন্ডিয়ান আর্মির গাড়ি আর শুধু প্রাইভেট কার, পিক-আপ পেছনে গাদা-গাদী করে মালপত্র নিয়ে গাড়িগুলো এদিক থেকে ওদিকে ছুটে চলেছে। আমি তখন অনুভব করলাম, এখন তো ফেরার পালা, সবাই এখন যার যার ঘরে, সংসারে ফিরে যাচ্ছে, কিন্তু আমি যাচ্ছি কোথায়?”
শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজনহারা প্রিয়জনদের এই প্রচণ্ড শোক, প্রবল ব্যথা মেশানো হাহাকারের উত্তর কখনই পাওয়া যায়নি। আমরা কি ডাক্তার আজহারুল, ডাক্তার হুমায়ুন কবিরদের মনে রেখেছি? তাদের আত্মত্যাগ কি আদৌ মনে রেখেছে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের উত্তরসূরিরা?
তথ্যসূত্র
১। সৈয়দ সালমা হক; ‘স্মৃতি:১৯৭১’, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ-১৯৮৯, সম্পাদনা-রশীদ হায়দার
২। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক, জীবনকোষ/বায়জীদ খুরশিদ রিয়াজ
সারাবাংলা/এসবিডিই
ফিচার মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে যার স্টেথোস্কোপ হয়ে উঠেছিল অস্ত্র রাতিন রা’দ