বিস্মৃতির অতলে অকুতোভয় বীর তারামন বিবি
১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:০৭
একাত্তরের অক্টোবর মাস। খালিয়াভাঙ্গা গ্রামের একপাশে ভেড়ামারি খাল। খালের একপাশের গ্রামে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প, অন্যপাশের গ্রাম দখল করে আছে পাকিস্তানী সেনারা। ভেড়ামারি খালের পাড় ধরে এক পাগলী এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানী ক্যাম্পের দিকে। পাগলীর সারা গায়ে কাদা, মাথায় চুলের জট, কাপড় নানা জায়গায় ছেঁড়া, পুরোপুরি অপ্রকৃতস্থ। এমন এক কিম্ভুতকিমাকার বেশভূষা দেখে পাকিস্তানী সেনারা নোংরা গালাগালি দিতে শুরু করল, পাগলীও পাল্টা অশ্রাব্য গাল দিচ্ছে, পাগলীর গালি শুনে হাসতে হাসতে টিটকারী দিতে থাকলো পাকিস্তানীরা। পাগল ক্ষেপিয়ে মজা নিতে মজাই লাগার কথা!
কিন্তু পাগলীর চোখ তখন ঘুরছে পুরো ক্যাম্প জুড়ে। তামাশা টিটকারীতে মশগুল পাকিস্তানী সেনাদের কেউই খেয়াল করল না যে পাগলীর চোখ মোটেও অপ্রকৃতস্থ কোন চোখ নয়, বরং সে খুব সাবধানে হিসেব করে নিচ্ছে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ক্যাম্পে হামলা চালালে সবচেয়ে ক্ষতি হবে; কোনদিকে পাহারা কড়া, কোথায় পাহারা দুর্বল; ক্যাম্পের কোথায় কি আছে, কার কি ধরনের অবস্থান, অস্ত্রের ধরণ ও রসদের পরিমাণ, সবই খেয়াল করে নিল সে। পাগল বেশভূষার কারণে ক্যাম্প থেকে কখন সে বেরিয়ে গেল কেউ সেটারও খোঁজ রাখল না।
পাকিস্তানীদের ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সেই পাগলী খাল সাঁতরে অন্যপারে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে এলো, তার করা রেকির নির্ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে নদীর অপরপাড়ে পাকিস্তানী ক্যাম্পে সাঁড়াশি আক্রমণ চালালেন মুক্তিযোদ্ধারা, শত্রুরা হলো পরাভূত। এমন আরো অজস্র রেকিওয়ার্ক থেকে শুরু সমুক্ষ যুদ্ধ পর্যন্ত সবখানে একাত্তরের নয় মাস জুড়ে প্রবল দাপটে যুদ্ধ করে স্বাধীন জমিনকে শত্রুমুক্ত করা এক অসামান্য বীর তারামন বিবি। যাকে সবাই চিনতেন তারাবানু নামেই।
কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুরের শংকর মাধবপুর গ্রামে ১৯৫৭ সালের কোনো এক দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তারাবানু। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। কিভাবে যুদ্ধে এলেন সেই গল্প শুনি তার জবানীতেইঃ
“আমাদের বাড়ি ছিল রাজীবপুরের আলেকচর শংকর-মাধবপুর ইউনিয়নে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ১৪। সে সময় দেশে শুরু হলো তোলপাড়। শয়ে শয়ে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে। কে কোথায় যাচ্ছে জানি না। আমরাও পালিয়ে যাই কোদালকাঠিতে।
‘একদিন, দিন-তারিখ মনে নাই, জঙ্গলে কচুর মুখি তুলছিলাম। একজন বয়স্ক মানুষ (মুহিফ হালদার), আমাকে বললেন, “তুমি আমাদের ক্যাম্পে কাজ করবা। ভাত রাইন্ধা দিবা। কী, পারবা না মা?” সেদিন কোথা থেকে যেন একটা শক্তি পেলাম। মনে হলো, এই তো সুযোগ। মাথার ওপর রক্ষা করার মতো কেউ নাই, যার ভরসায় বেঁচে থাকব। মরতে তো হবেই। যুদ্ধ করে বাঁচার চেষ্টা করলে দোষের কী!
‘তাঁকে বললাম, আফনে আমার মায়ের লগে কথা কন। উনি যাইবার দিলে যাইমু। সেই সন্ধ্যায় তিনি আমার মার কাছে যান। শুধু বিশ্বাসের ওপর আমার মা আমাকে তাঁর সাথে দেন।
‘কোদালকাঠিতেই আমার প্রথম ক্যাম্পজীবন শুরু। রান্না করা, ডেক ধোয়া। অস্ত্র পরিষ্কার করা। একদিন আজিজ মাস্টার বললেন, পাকিস্তানি ক্যাম্পের খবর আনতে হবে। কোনো পুরুষ যেতে পারবে না। যেতে হবে আমাকে। তা-ও নদী (নদ) পার হয়ে। কথাগুলো শুইনাই কইলজাটা চিনচিন করে উঠল। রাজি হয়ে গেলাম, যা থাকে কপালে! পাগলির বেশে, ছেঁড়া কাপড় পরে যেতাম শত্রুর ক্যাম্পে।”
কিন্তু নিয়তি তারাবানুর জন্য গল্পটা লিখে রেখেছিল অন্যভাবে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের কথা। একদিন ক্যাম্প কমান্ডার মুহিব হাবিলদার তারাবানুকে অস্ত্র নাড়াচাড়া করতে লক্ষ্য করলেন। দুই এক কথাতেই তিনি টের পেলেন তারাবানুর অস্ত্র চালানোর আগ্রহ আছে। বয়সে ছোট তাই স্টেনগান চালনার প্রশিক্ষণই দিলেন তিনি তাকে। তখনো ঘূর্ণাক্ষরেও জানতেন না তিনি কয়েকদিনের মধ্যেই তারাবানুকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেবার এই সিদ্ধান্ত প্রাণে বাঁচিয়ে দেবে তার গোটা দলকে।
একদিন দুপুরবেলা ভীষণ বৃষ্টির মধ্যে দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এমন সময় হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধা আজিজ মাস্টার তারাবানুকে পাশের এক পিছলা সুপারী গাছে উঠে চারপাশে নজর রাখতে বললেন। কারণ পাহারায় কেউ ছিল না তখন। খাবার রেখেই গাছে উঠে বায়নোকুলার দিয়ে চারপাশে নজর রাখতে রাখতে আচমকাই তারাবানু পাকিস্তানী গানবোট দেখতে পেলেন নদীতে। তাদের অবস্থানের দিকেই আসছে। সাথে সাথে কমান্ডারকে জানালেন তিনি, খাওয়া ফেলে সাথে সাথে অস্ত্র হাতে পজিশন নিলেন সবাই। সেদিন বৃষ্টির মতো গুলি চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত। নিজেও অজান্তেই একসময় হাতে তুলে নিলেন স্টেনগান। পুরুষ সহযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে ১৪ বছরের কিশোরী তারাবানুও অপরিসীম সাহসে শত্রুসেনাদের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করলেন। সেদিন যদি তাৎক্ষণিক শত্রুসেনাদের তথ্য না জানাতে পারতেন তারাবানু, অতর্কিত আক্রমণের শিকার হতেন মুক্তিযোদ্ধারা।
কেবল এই যুদ্ধই নয়, মোহনগঞ্জ, তারাবর কোদালকাটি, গাইবান্ধার ফুলছড়ির বহু বিখ্যাত যুদ্ধে পুরুষ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখসমরে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন তারামন বিবি। যেকোন অপারেশনেই বিস্তারিত রেকি তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রেকি ভালো হলে অপারেশন হয় নিখুঁত, রেকিতে যদি দুর্ভাগ্যক্রমে কিছু বাদ পড়ে যায়, তাহলে আক্রমণ করতে গিয়ে অপ্রস্তুত অবস্থায় বিপদে পড়তে পারে বাহিনী। তারাবানু তাই সবসময়ই রেকি করতেন সবচেয়ে অভিনব উপায়ে, যেন সংগ্রহ করতে পারেন শত্রুপক্ষের সবচেয়ে হামলার তথ্য, তৎপরতার খবর ও সম্ভাব্য অবস্থান।
আর এই রেকি করতে গুপ্তচর হিসেবে একেকসময় একেক বেশভূষা নিতেন তিনি। কখনো সারা শরীরে কাদা মাটি, চক, কালি লাগিয়ে, কখনো পঙ্গুর অভিনয় করে, এমনকি কখনো মনুষ্যবিষ্ঠা গায়ে মেখে তার পাগলীর অভিনয়কে করে তুলতেন নিখুঁত ও বিশ্বাসী, যেন ঘূর্ণাক্ষরেও পাকিস্তানী তাকে সন্দেহ করতে না পারে। এলোমেলো জটা চুলে কখনো বোবা সেজে, কখনো উন্মাদের মতন হাসতে হাসতে বা কাঁদতে কাঁদতে কৌশলে পাকিস্তানী ক্যাম্পে ঢুকে গিয়ে শুনতেন নানান গোপন তথ্য, পাকিস্তানীদের পরবর্তী হামলার নানা আলাপ।
মাত্র ১৪ বছর বয়সী এই দুঃসাহসিক নারী কখনো সাঁতরে এনেছেন শত্রুসেনাদের খোঁজ, তথ্য এনেছেন তাদের অবস্থান, পরবর্তী মুভমেন্টের বিস্তারিত। শুধু তাই নয়, অনেক সময় মুক্তিবাহিনীর পাকিস্তানীদের উপর বিভিন্ন অপারেশনের আগে কলার ভেলায় করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে রসদ, অস্ত্র গোলাবারুদ পৌঁছে দিয়েছেন জায়গা মতো। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে অসম্ভব সাহসী এইসব কাজে মুক্তিযোদ্ধারা শুধু রসদ-অস্ত্র-গোলাবারুদই পাননি, এক কিশোরী সহযোদ্ধার এহেন বীরত্বে তারা একইসাথে পেয়েছেন অপরিসীম উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা!
অথচ কি আশ্চর্য! শত্রুমুক্ত একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এনে দেবার কিছুদিন পরেই তারাবানু যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেন। ১১ নম্বর সেক্টরে নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুরে ছিলেন তিনি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি জানতেও পারেননি যে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। কারণ তারাবানুকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের দুইজন নারী বীর প্রতীকের একজন তারামন বিবি ছিলেন নিখোঁজ!
অবশেষে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের সাবেক শিক্ষক বিমল কান্তি দে অনেক চেষ্টার পর খুঁজে পান তারামন বিবিকে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর কাজ করতে গিয়ে তারামন বিবি নামের একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম পান। ১১ নম্বর সেক্টরের এই মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেন রাজীবপুরের বাসিন্দা তার সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা আবদুর সবুর ফারুকী ও সোলায়মান আলী। তারামন বিবির খোঁজ পাবার ঘটনা এক অভাবিত সাড়া ফেলে। বাকি দুনিয়া তো বটেই, তারামন বিবির স্বামী আব্দুল মজিদও যে জানতেন না যে তার স্ত্রী কি অকুতোভয় এক মুক্তিযোদ্ধা। এক সাক্ষাৎকারে মজিদ খুবই বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন তিনি ‘হ্যায় যে মুক্তিযোদ্ধা, হেইটা বিয়ের পরও বুঝি নাই। লেহা পড়া নাই। চর্যার মধ্যে বাড়ি। পেটের ভাত জোগাড় কোরতেই দিন চইলা যাইত, হ্যাই খবর কেমনে নিমু?’
তারা তাকে জানতেন তারাবানু নামে। তাদের বাড়িতে তারামন বিবির খোঁজে গিয়ে খোঁজ নেয়া অধ্যাপকেরাই কাগজপত্র দেখিয়ে বললেন এই তারা বানুই হচ্ছে তারামন। বিস্ময়ে আর গর্বে হয়তো প্রবল উচ্ছ্বসিতই হয়েছিলেন আব্দুল মজিদ এবং তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ১৯৯৫ সালের ২১ নভেম্বর দৈনিক ভোরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হয় তারামন বিবিকে খুঁজে পাবার কথা, ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে সরকার তারামন বিবির হাতে তুলে দেয় বীর প্রতীক সম্মাননা।
২০১৮ সালে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম দিনে আমাদের ছেড়ে চিরবিদায়ের পথে পাড়ি জমান তারামন বিবি। কিশোরী বয়সে অকুতোভয় সাহসে একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়েছিলেন তারামন আমাদের, তার প্রতিদানে পরের ২৫ বছর আমরা তার খোঁজও রাখিনি। যে তারামনের দুঃসাহসিক দেশপ্রেমের আখ্যান আমাদের সন্তানদের জানিয়ের কথা ছিল, সেই তারামনকে স্রেফ ডিসেম্বর ছাড়া বছরের বাকি সময়টায় স্মরণ করবার সুযোগ হয় না আমদের। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ধুলোপড়া পাতায় তাই মোছাম্মত্ তারামন বেগম কেবল সনদ নম্বর ৩৯৪ “বীর প্রতীক” হয়েই রয়ে যান।
তথ্যসূত্রঃ
১। নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীর প্রতীক/ তাজুল মোহাম্মদ।
২। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নারী মুক্তিযোদ্ধা প্রথম খণ্ড/ মেহেরুননেসা মেরী।
লেখক: একটিভিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ফিচার বিস্মৃতির অতলে অকুতোভয় বীর তারামন বিবি মুক্তিযুদ্ধ রহমান রা'আদ