Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাধীনতার দৃপ্ত কণ্ঠস্বর অধ্যাপক হবিবুর রহমান

রহমান রা’আদ
২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:৩৯

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইটের খবর পৌঁছেছে রাজশাহীতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে চলে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু এক অধ্যাপক কোনভাবেই যাবেন না। ২৬ মার্চ ভোরে পাকিস্তানী সেনারা ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। সারাদেশের মত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও চলমান অসহযোগ আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে সেই অধ্যাপক তার প/১৯-বি নম্বর বাসভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পাকিস্তানী সেনারা তা দেখে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে পতাকা নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলে তিনি তাদের দৃপ্তস্বরে জবাব দিলেন, ‘এ পতাকা নামানোর জন্য তোলা হয়নি।’

বিজ্ঞাপন

সেনাদের সাথে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পর তারাই জোর করে পতাকাটা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেললো। এরপরে পালিয়ে যাওয়া শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের খালি বাসা লুটপাট করতে শুরু করল পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারেরা। অসমসাহসে তাদের সামনে বাঁধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালেন সেই অধ্যাপক। লুটপাটে বাঁধা পেয়ে পাকিস্তানী সেনারা তার উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, কিন্তু অধ্যাপকের দৃঢ়তায় তখনকার মতন সুবিধা করতে পারল না। উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শেষে পাকিস্তানী সেনারা চলে যেতে বাধ্য হয়। কিন্ত তাদের কাছে মার্কড হয়ে থাকেন এই সাহসী অধ্যাপক। কিছুদিন পর ১২ এপ্রিল তার সহকর্মী, বন্ধু কয়েকজন শিক্ষকের একটি গ্রুপ চলে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাবার সময় তাকেও তাদের সাথে যেতে অনুরোধ করলে তিনি তাদের শান্তস্বরে তাদের জবাব দিলেন,

বিজ্ঞাপন

‘Like the Captain of a Ship, I shall be the last to leave.’

অসমসাহসী এই অধ্যাপকের নাম শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ হবিবুর রহমান। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে বিশ্বাসী এই মানুষটি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার (বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক) এবং গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। গণিত বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী এই মানুষটি ছিলেন সততা, আদর্শ, মূল্যবোধ ও সময়নিষ্ঠার সমন্বয়ে এক অনন্য অনুকরণীয় ব্যাক্তিত্ব।

৫০০ বছরের পুরোনো গণিতের এক অমীমাংসিত সূত্রের উপর দীর্ঘদিন গবেষণা করে ১৯৭০ সালের অক্টোবরে অবশেষে সমাধানের পথ উন্মোচনকারী মতামত দেন হবিবুর, যা তাকে এনে দেয় প্রভূত সুনাম ও মর্যাদা। গণিত বিষয়ে অমিত প্রতিভাধর ছিলেন তিনি, পাশাপাশি ছিলেন মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ। ১৯৪৬ সালে কলকাতা শহরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় আক্রান্ত হিন্দু পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেবার দায়িত্ব পালন করা হবিবুর ১৯৫০ সালে ঢাকায় হিন্দুদের উপর ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক হামলার সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক হিন্দু পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন।

চরম বিপদেও ধীরস্থিরভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার আশ্চর্য গুণের আরো একটি উজ্জ্বল পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৬৯ সালে। গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডঃ শামসুজ্জোহাকে নির্মম নিষ্ঠুরতায় পাকিস্তানী সেনারা হত্যা করার পর তাৎক্ষণিক অধ্যাপক হবিবুর গ্রহণ করেছিলেন আন্দোলনের নেতৃত্বভার। দুর্দান্ত বিচক্ষণতা ও দুরদর্শী নেতৃত্বে আহত-নিহত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নেয়া ও পাকিস্তানী সেনাদের হাত থেকে রক্ষা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ সকল দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। বাঙ্গালীর স্বাধিকার আন্দোলনের শুরু থেকেই একনিষ্ঠ সমর্থক ও কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছেন এই মানুষটি।

ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা হবিবুর জন্মেছিলেন ১৯২১ সালের ১লা জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার বালিয়াধার গ্রামে। তাঁর বাবার নাম কলিম উদ্দিন ভূঁইয়া, মায়ের নাম সিদ্দীকা খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে হবিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। স্কুল জীবনে থাকতেই অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়ে পঞ্চম শ্রেণীতেই বৃত্তি অর্জন করেন তিনি, সেই বৃত্তির টাকা আর ছাত্র পড়ানোর অর্থে নিজের শিক্ষাজীবন চালিয়েছেন তিনি। ১৯৩৮ সালে নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার ‘দত্তপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে পাঁচটি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন।

সেই আমলে ৫টা লেটার ছিল অসম্ভব ভালো ফলাফল, কিন্তু সেটা ছিল কেবল শুরু। ১৯৪০ সালে আইএসসি এবং ১৯৪৩ সালে বিএসসি পাশ করে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসিতে ভর্তি হন হবিবুর। ১৯৪৬ সালে তিনি রেকর্ড নম্বরসহ গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এম.এস-সি ডিগ্রি অর্জন করলে আলীগড়ের তৎকালীন উপাচার্য ও প্রখ্যাত গণিত বিশারদ স্যার জিয়াউদ্দীন চমৎকৃত হন। তিনি বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হকের কাছে হবিবুর রহমানকে স্টেট স্কলারশিপ ও চাকরি দেওয়ার জন্য বিশেষ সুপারিশ করে চিঠি দেন। ১৯৪৬ সালে হবিবুর রহমান প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতের প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন।

এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, ঢাকা কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৪ সালে নভেম্বরে যোগ দেন তিনি, সেখান থেকে সোজা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পা রাখেন! গণিতশাস্ত্রে ট্রাইপস ডিগ্রি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৮ সালে রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফলিত গণিতের উপর গবেষণা করতে যান তিনি, ১৯৬৪ সালে ফিরে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন, দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। পরের বছর তাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সৈয়দ আমীর আলী হলের প্রাধ্যক্ষ নিযুক্ত করে।

দায়িত্ব পালনে একের পর এক অসাধারণ সাফল্য আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিতের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা এই মানুষটা জাতীয় উন্নতির জন্য মাতৃভাষায় গণিত ও বিজ্ঞানের উচ্চতর বিষয়গুলো অধ্যায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন এবং মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা ও শিক্ষাদানকে উৎসাহিত করতেন। বাংলা ভাষায় রচিত তাঁর বইগুলো হলো : স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির জন্য ‘যোগাশ্রয়ী বীজগণিত’, স্নাতক শ্রেণির জন্য ‘কলেজ বীজগণিত’, স্কুলের জন্য ‘নতুন বীজগণিত’ এবং ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির জন্য ‘পাটীগণিত’। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির জন্য রচিত বই দুটি সেসময় অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ ও নিবন্ধের মধ্যে রয়েছে : On Pell’s Equation’, ‘On Fermat’s Last Theorem’, ‘On Crisis of Civilization’ (1950), ‘On fundamental Human Rights’ (1969,‘নতুন শিক্ষানীতি’ (১৯৬৯) এবং ‘ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক’ (১৯৭০)। শিক্ষা সংস্কারেও তিনি অত্যন্ত সাহসী ও ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছিলেন।

স্বাধিকার আন্দোলনে শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা হবিবুর মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করছিলেন। ২৫ মার্চের পর থেকেই ইপিআর বাহিনীর কিছু বাঙ্গালী সদস্য ক্যাম্পাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের জন্য খাদ্য থেকে শুরু করে সবধরনের সাহায্য দিতেন হবিবুর, তার স্ত্রী ওয়াহিদা রহমান নিজের হাতে রুটি বানিয়ে খাওয়াতেন বাঙ্গালী জওয়ানদের। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল হবিবুরের, যথাসাধ্য সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তিনি। এই বিষয়গুলো নজরে পড়ে যায় তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়া তারই দুই সহকর্মী অধ্যাপকের। অবাঙ্গালী এই দুই অধ্যাপক ২৬ মার্চের পর হবিবুরের বাড়িতে আশ্রয় চেয়েছিলেন, সরল বিশ্বাসে আন্তরিকতার দরুণ তাদের পরিবারসমেত আশ্রয় দিয়েছিলেন হবিবুর। ঘুর্ণাক্ষরেও হয়তো কল্পনা করতে পারেননি নিজের হাতে নিজের মৃত্যুপরোয়ানা লিখলেন তিনি।

১৪ এপ্রিল পাকিস্তানী সেনারা দ্বিতীয়বারের মতন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢোকে। এরপর পরেই আচমকা সেই দুই অবাঙ্গালী অধ্যাপক তাদের পরিবারসমেত বেরিয়ে গিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের কাছে আশ্রয় চায় এবং হবিবুরের কর্মকান্ডের ব্যাপারে সকল তথ্য জানায়। ২৫ মার্চের পরদিনই হবিবুরের জন্য পাকিস্তানী সেনারা ক্যাম্পাসের খালি বাড়ি লুটপাট করতে পারেনি, তখন থেকেই তিনি পাকিস্তানী সেনাদের টার্গেট ছিলেন। দুই অধ্যাপকের দেয়া তথ্য তাদের হবিবুরের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে আরো স্পষ্ট করে তোলে।

পরদিন ১৫ই এপ্রিল বিকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জিপ এসে থামে হবিবুর রহমানের বাড়ির সামনে। লুঙ্গি, গায়ে শার্ট এবং গলায় চাদর পরা হবিবুর স্যান্ডেল পায়ে বেরিয়ে যান। স্ত্রী কিংবা নিজের ছয় সন্তানের কাউকে একবার বিদায় বলে যাবার সময়ও পাননি। অস্থায়ী সামরিক হেড কোয়ার্টার ‘বিশ্ববিদ্যালয় অতিথি ভবনে’র ছাদের উপরে সামরিক অফিসারদের সামনে হাজির করা হয় হবিবুর রহমানকে। জানা যায়, হবিবুরকে অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করে পাকিস্তানী সেনারা, এরপরে পাকিস্তানী সেনাদের কর্মকান্ড ভালো এবং পাকিস্তান রক্ষায় জরুরি এই মর্মে একটি চিঠি লিখে দিতে বলা হয় হবিবুরকে। একটি কাগজ বাড়িয়ে দেয় কমান্ডিং অফিসার। স্বভাবতই ঘৃণাভরে এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন হবিবুর, কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দেন। পাকিস্তানী সেনারা হবিবুরকে নিয়ে নীচে নেমে আসে। তিনি অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তার বাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এরপর তাকে জীপে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানী সেনারা।

ডঃমুহম্মদ হবিবুর রহমানের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সেদিনই তাঁকে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনারা। দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে সত্য সুন্দর আর ন্যায়ের পথে মুক্তির ডাকে সাড়া দিয়ে প্রাণটা উৎসর্গ করে যান হবিবুর! বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসের নাম রেখেছে ‘শহীদ হবিবুর রহমান হল’, কিন্তু হবিবুরকে কি আমরা আদতেই মনে রেখেছি? যে অমিত প্রতিভাবান মানবকল্যাণে জীবন বাজি রাখা অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী হবিবুর রহমান তার জীবনটাই এই দেশের স্বাধীনতা আর মুক্তি আনতে বিসর্জন দিলেন, তার জীবনের গল্প আর অসামান্য সব কীর্তি অনাগত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে, আমাদের সন্তানদের তার মতন হবার প্রেরণা যোগাতে কি পদক্ষেপ নিয়েছি আমরা? হবিবুরের কথা আমাদের মনে আছে তো?

তথ্যসূত্র _
১। শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ/ আলী মোঃ আবু নাইম ও ফাহিমা কানিজ লাভা

লেখক: একটিভিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রহমান রা'আদ স্বাধীনতার দৃপ্ত কণ্ঠস্বর অধ্যাপক হবিবুর রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর