Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অবিনাশী সংশপ্তক শহীদুল্লাহ কায়সার

রহমান রা’আদ
৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:০৯

তার যৌবনের একটা বড় অংশ কেটেছে জেল থেকে জেলে। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মুক্তির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতি করার কারণে শুরু থেকেই ছিলেন সরকারের রোষানলে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় প্রথমবারের মতন গ্রেফতার হন তিনি। পরের দশ বছরের মধ্যে আট বছরই ছিলেন কারাগারে। এই দীর্ঘ জেলজীবন জন্ম দেয় বাংলা সাহিত্যের এক অবিনাশী আগ্নেয়গিরির। তিনি শহীদুল্লাহ কায়সার, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উন্মেষকালের এক অসামান্য প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।

বিজ্ঞাপন

তার পরিচয় অনেক। ভাষাসৈনিক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক। কিন্তু আর সব পরিচয় ছাপিয়ে তার যে পরিচয়টাই আমাদের কাছে তীব্র উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়, সেটা হচ্ছে এক বীভৎস জেনোসাইডের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে একাত্তরের পুরোটা সময়জুড়ে কলমকে অস্ত্র বানিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এক দেশপ্রেমিক, যিনি মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে পারবেন না ভেবে ঢাকা ত্যাগ করতে রাজি হননি। যার ফলে পাকিস্তানীদের নির্মমতার কবলে পড়ে চিরতরে হারিয়ে গেছেন তিনি, রেখে গেছেন আমাদের জন্য স্বাধীন সার্বভৌম এক স্বদেশ!

বিজ্ঞাপন

ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামের সৈয়দ পরিবারে ১৯২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। বাবা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ও মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুনের আট সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠ। তাঁর সাত ভাই-বোনঃ নাফিসা কবীর, মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ্ ওরফে জহির রায়হান, জাকারিয়া হাবিব, সুরাইয়া বেগম, সাহানা বেগম, মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ্ এবং মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ। কলকাতার ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’র আরবি সাহিত্যের অধ্যাপক বাবার জন্য তাদের নিবাস ছিল জন্মভূমি থেকে দূরে। শৈশব থেকেই রাজনীতি ও স্বাধিকারের চেতনা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন শহীদুল্লাহ। ১৪-১৫ বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন, স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেশীয় কাপড় তৈরীর বিপ্লবে বেগম রোকেয়ার সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে অংশ নেন তিনি। দেশপ্রেম ও বুদ্ধিবৃত্তিক সচেতনতার দীক্ষাই শুধু নয়, শহীদুল্লাহ’র সাহিত্যবোধ তৈরিতেও মা রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত টানা প্রথম স্থান অধিকার করা শহীদুল্লাহ কায়সার ১৬ বছরে ম্যাট্রিক এবং ২০ বছর বয়সে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ করার জন্য ভর্তি হলেও দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন তারা, এসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলকাতায় থাকাকালীন আইন পড়াও শুরু করেছিলেন তিনি, তখন বামপন্থী ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে মার্কসবাদ-লেলিনবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ-তে পড়ার সময় কমিউনিস্ট পার্টিতে জড়িত থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারী হয়। আত্মগোপনে অবস্থায় তিনি গোপনে গোপনে ছাত্রদের সংগঠিত করেন। আত্মগোপনে থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত এমএ পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি।

তারপরেই শুরু হয় তার দীর্ঘ জেলজীবন। ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ও লড়াকু ভূমিকা রাখার কারণে আগে থেকেই কমিউনিস্ট হিসেবে পাকিস্তানীদের কাছে ‘কুখ্যাত’ শহীদুল্লাহ কায়সার ৩ জুন ১৯৫২ সালে গ্রেফতার হন। সাড়ে তিন বছর কারাগারে আটকে রাখার পর বের হওয়ার অল্প কয়েকদিনের মধ্যে পাকিস্তান সরকার তাঁকে আবার গ্রেফতার এবং কারারুদ্ধ করে। আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। যোগ দেন ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ পত্রিকায়। শুরু হয় সাংবাদিক জীবন।

কিন্তু না, ১৯৫৮ সালের ১৪ অক্টোবর তাঁকে আবার গ্রেফতার করে আইয়ুব সরকার, জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে আটকে রাখা হয় ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। শিক্ষানীতি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল ছাত্র-আন্দোলনের ফলে অন্যান্যদের সাথে শহীদুল্লাহ কায়সারও কারাগার হতে মুক্ত হন। এ সময় তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’-এর সম্পাদকীয় বিভাগে যুক্ত হন। সাংবাদিক-সাহিত্যিক জহুর হোসেন চৌধুরী, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ, সন্তোষ গুপ্ত প্রমুখ গুণীজনের নার্চারে শহীদুল্লাহ প্রস্ফুটিত হন দুর্দান্তভাবে। সংবাদে উপ-সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি প্রাপ্তিতে সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত ‘দেশপ্রেমিক’ ছদ্মনামে ‘রাজনৈতিক পরিক্রমা’ ও ‘বিশ্বকর্মা’ ছদ্মনামে ‘বিচিত্র কথা’ শীর্ষক উপসম্পাদকীয় লিখতেন। এসব লেখায় ফুটে ওঠে শোষিত ও নিপীড়িত বাঙ্গালীর স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষা।

শুধু নিজেই নন, ছোট ভাই বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির আরেক কিংবদন্তি জহির রায়হানকেও যত্ন করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শহীদুল্লাহ। ১৯৫৬ সালে জহির রায়হানের (১৯৩৫-৭২) সম্পাদনায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সাপ্তাহিক ‘প্রবাহ’ প্রকাশিত হয়। প্রতি শনিবার প্রকাশিত হওয়া প্রবাহের পেছনে অন্যতম কুশীলব ছিলেন শহীদুল্লাহ। ততদিনে তিনি নিজেও লিখছেন দুর্নিবার গতিতে। জেলজীবনে রাজবন্দি হিসেবে অখন্ড অবসরে নাটক লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি, ১৯৫২ সালে ‘নাম নেই’ এবং ১৯৫৪ সালে ‘যাদু-ই-হালূয়া’ রচনার মাধ্যমে তার সাহিত্যজীবন শুরু। তার সবচেয়ে আলোচিত সাহিত্যকর্ম ‘সংশপ্তক’ রচনা করেন আইয়ুব খানের আমলে জেলজীবনে।

১৯৫৯-১৯৬২ এই সময়ের মধ্যে রচিত সংশপ্তকে ফুটে উঠেছে তার বিপ্লবীচিত্তের অনলবর্ষী রূপায়ণ। অনেকেই বলেন, ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস নাকি তার সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখেছিলেন তিনি। তার আপন ছোট মামা রূপায়িত হয়েছিলেন মিয়ার ব্যাটা চরিত্রে, হুরমতি এবং রমজানসহ সকল চরিত্রই বাস্তবে ছিল তার ছোট মামার বাড়িতে। এরফলে নাকি তার মামাবাড়ির সাথে সকল সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তার। এছাড়াও ছোটভাই জহির রায়হানের অনুরোধে জেলজীবনে বিপ্লবী নেতাকর্মীদের মনোভাব আর প্রতিজ্ঞা নিয়ে রচনা করেছিলেন স্মৃতিকথা “রাজবন্দীর রোজনামচা”। তবে তার রচিত “সারেং বৌ” ১৯৬২ সালে প্রকাশ হবার পর রীতিমত শোরগোল পড়ে যায়। সাগরের জেলেজীবন আর অকুল পাথারে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ জেলের স্ত্রী আর সন্তানের বেঁচে থাকার অহর্নিশ লড়াইয়ের উপর ভিত্তি করে লেখা এই উপন্যাসের জন্য ১৯৬২ সালে আদমজী পুরষ্কার এবং পরবর্তীতে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও ১৯৮৩ সালে সাংবাদিকতায় মরণোত্তর একুশে পদক ও ১৯৯৮ সালে সাহিত্যে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয় তাঁকে।

পাকিস্তানীদের বিষাক্ত নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে একটা স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশের স্বপ্ন আর সবার মতন শহীদুল্লাহ কায়সারেরও ছিল। আর তাই সেজন্য সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন আত্মত্যাগটাও তিনি করেছিলেন অবলীলায়। একাত্তরের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানীদের গণহত্যা শুরু হবার পর ছোটভাই জহির রায়হানসহ অনেক শিল্পী-সাংবাদিক-সাহিত্যিক-শিক্ষক দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিলেন, যুদ্ধটা চালিয়ে গিয়েছিলেন। শহীদুল্লাহ কায়সারকেও বারবার সরে যেতে বলা হয়েছিল। দৈনিক ‘সংবাদ’ অফিস পাকিস্তানীরা পুড়িয়ে দেবার পর শহীদুল্লাহ কায়সারকে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির বার বার লোক পাঠিয়েছিল নিয়ে যাবার জন্য। কমরেড মনি সিং ‘আর এখানে থাকা সঙ্গত নয়’- এ কথা জানিয়ে তাঁর কাছে চিঠি লেখেন। রাশিয়ান দূতাবাসও বার বার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ব্যর্থ হয়। তার মতন একজন অসামান্য প্রতিভাবান সাহিত্যিক দেশের মুক্তিসংগ্রামে আরো বড় জায়গা থেকে অবদান রাখতে পারবেন ভেবেই সকলে তাঁকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করছিলেন।

কিন্তু শহীদুল্লাহ’র মাথায় তখন অন্য চিন্তা। তিনি কেবলই ভাবছিলেন সবাই যদি সরে যায়, তাহলে দেশের ভেতরে যুদ্ধ করতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সাহায্য পৌছাবে কে? মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্যই দেশের ভেতরে রয়ে গেলেন তিনি। একাত্তরের পুরোটা সময় জুড়ে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে অনেকেই কবি সুফিয়া কামালের কাছে তাদের রেশনকার্ড রেখে যেতেন। কবি সুফিয়া কামাল সেইসব রেশনকার্ড দিয়ে চাল, ডাল, ঔষধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিস তুলে এনে বাসায় জড়ো করতেন। শহীদুল্লাহ কায়সার সেসব জিনিস মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌছে দিতেন। তাঁর বাসা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এই বাসা থেকে প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার তৈরী করে দেওয়া হত। দিনের বেলা বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন লোকের কাছ টাকা ও ঔষধ সংগ্রহ করে রাতে তা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিতেন তিনি।

খুব ভালোভাবেই জানতেন তিনি কাজটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। এও জানতেন আক্রান্ত হতে পারেন তিনি পরিবারসমেত। তবুও একমুহুর্তের জন্যও থামেননি। এটাই তার কাল হলো। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা খালেক মজুমদার আলবদর কর্মীদের সাথে এসে তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। আর ফিরে আসেননি তিনি। তার স্ত্রী পান্না কায়সারের জবানীতে জানা যাক পুরো ঘটনাটাঃ

“১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাত। বাসায় ছোট্ট শিশু শমীকে তখন দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। বাসায় মুখোশপরা একদল ঘাতকের হানা। হাত টেনে ধরেও স্বামীকে রাখতে পারেনি। বর্তমান জামায়াত নেতা খালেক মজুমদারসহ ঘাতকরা ওকে ধরে নিয়ে যায়। পরে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাকে আমার স্বামী হত্যাকারী হিসেবে শনাক্ত করেছিলাম। বিচারককে বলেছিলাম, খুনের বদলে খুন। আইনে হত্যাকারীর বিচার হবে না। আমি আমার স্বামীর হত্যাকারীকে নিজের হাতে খুন করতে চেয়েছিলাম- বলেছেন পান্না কায়সার। শুধু বিশেষ দিন বা ঘটনা বলে কথা নয়-শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারকে প্রতিনিয়তই মনে পড়ে। তার স্মৃতি আমার মনের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে।

এই শক্তি আমাকে অনেকখানি সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর ও ২৫ মার্চ রাতের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িত। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাত। কায়েৎটুলীর বাড়িতে ছিলাম আমরা। সেদিনও ছিল সবকিছু অন্ধকার। বাড়িতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও আত্মীয়স্বজন আশ্রয় নিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় শহীদুল্লাহ কায়সার ও আমার চাচাশশুর শাহরিয়ার কবিরের বাবা মিলে সোফায় বসে ভয়েস অব আমেরিকা শুনছিলেন। তখন আমি শমীকে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। এমন সময় দরজায় ঠক ঠক শব্দ। আমার দেবর এসে শহীদুল্লাহ কায়সারকে বললো, বড়দা দরজায় শব্দ শোনা যাচ্ছে। দরজা খোলার জন্য বলছে। আমি দরজা খুলতে নিষেধ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। শহীদুল্লাহ কায়সার তখন বললো- খুলে দাও। মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে। এদিকে ও আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুললো। বুঝতে পারলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা দেয়ার জন্যই আলমারি খুলেছে। সব অন্ধকার তখন। মোমবাতি নিয়েই ঘরে ও বারান্দায় হাঁটছে।

ইতিমধ্যে দরজা খোলা হয়ে গেছে। আমরা নিচ থেকে কোনো শব্দই শুনতে পাচ্ছিলাম না। শহীদুল্লাহ কায়সার বলছিল- কি ব্যাপার কে এলো? কোনো শব্দই তো আর শোনা যাচ্ছে না। তখন ও ভাবলো, কোনো আত্মীয় হয়তো এসেছে। এ কথা বলতে বলতেই নিচতলা থেকে ওরা উপরের দিকে উঠছে। সিঁড়িতে ঠক ঠক শব্দ। উপরে উঠতেই আমাদের বসার ঘর। মোমবাতি জ্বলছিল। ঘরে ঢুকেই ঘাতকরা জিজ্ঞেস করলো, এখানে শহীদুল্লাহ কায়সার কে? ওরা শহীদুল্লাহ কায়সারকে চিনতো না। ঘাতকদের সবাই ছিল মুখোশধারী। তখন সে নিজেই নিজের পরিচয় দিলো। আমি শহীদুল্লাহ কায়সার। সেদিন সে পরিচয় গোপন করেনি। শহীদুল্লাহ কায়সার পরিচয় দেয়ার পরই তার হাত ধরে হেঁচকা একটা টান দিলো। টান দিতেই দুধের শিশু শমীকে আমি ছুড়ে ফেলে দিলাম। ও ছিটকে পড়ে গেলো। দুধের বোতলটাও ছিটকে পড়ে যায়।

তখন ওর বয়স দেড় বছরের কম। ঘাতকরা কায়সারকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি ওর পেছন পেছন আরেকটি হাত ধরে টানছিলাম। কিন্তু তাকে টেনে ধরে রাখতে পারছিলাম না। ওরা যখন বারান্দায় ওকে টান দিয়ে নিয়ে গেলো তখন আমি বারান্দার সুইচটা অন করে দিলাম। বারান্দাটা আলো হয়ে গেলো। পাশের রুমেই আমার ননদ ছিল। গর্ভবতী অবস্থায় পাশের রুম থেকে সে অনেক কষ্টে বারান্দায় আসে। মুখোশ পরা এক ঘাতকের মুখের কাপড় টান দিয়ে খুলে ফেলে সে। চিৎকার করে বলে, আমার বড়দাকে তোরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস। এই বলে ও বড়দাকে জড়িয়ে ধরে। আমার ননদকে ওরা ছিটকে ফেলে দেয়। আলোতে আমরা ঘাতককে চিনে ফেললাম। ঘাতকরা সময় নষ্ট না করে শহীদুল্লাহ কায়সারকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নিয়ে যায়। তখন ওর হাতে আমার হাত ধরা ছিল। টানতে টানতে একপর্যায়ে ওর হাত থেকে আমার হাতটা ছুটে যায়। চলে যাওয়ার সময় একটা কথাই বললো সে- ‘ভালো থেকো, সন্তানদের আমার মতো করে মানুষ করো’।

বিড়বিড় করে আর কি বলছিল বুঝতে পারিনি। ওরা কিছু বলতেও দিচ্ছিল না। তাকে বাসা থেকে বের করার পর আমি ও আমার ননদ অজ্ঞান হয়ে গেলাম। পুরো ঘটনাতেই নিচের তলার লোকদের কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। ঘাতকরা ঘরের ভেতরে ঢুকেই তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। তাই নিচতলা ছিল একেবারেই নীরব। ১৬ ডিসেম্বর কারফিউ নেই। বিজয়ের আনন্দ আমরা ভোগ করতে পারলাম না। ১৬ ডিসেম্বর আমার দেবর বলে, শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে জেলে যাবে। তখন আমার ধারণা হলো, তাকে আগেও অনেকবার জেলে নেয়া হয়েছে।

তাকে হয়তো জেলে আটকে রেখেছে। দেবর জাকারিয়া হাবিব আমাকে জহুর হোসেন চৌধুরীর বাসায় নিয়ে যায়। তিনি আমাকে অনেক কিছু বোঝান। শক্ত হয়ে বাস্তবতাকে মোকাবেলার কথা বলেন। আমার দেবর ও আমি রিকশা নিয়ে যাচ্ছি। রায়েরবাজারে গিয়ে রিকশা থামলো। আমি এর আগে সেখানে যাইনি। সেখানে অসংখ্য মানুষ। দেবরকে বললাম, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছো? সবাই স্বজন হারানোর শোকে কাঁদছে। আমি শক্ত হলাম। আরেকটু সামনে এগুতেই দেখি অসংখ্য লাশ।

আমি স্বামীর লাশ শনাক্ত করার চেষ্টা করি। নিজেই একটা একটা করে লাশ উল্টে উল্টে দেখি। কতোগুলো লাশ এভাবে দেখবো আমি! শহীদুল্লাহ কায়সারের লাশ পেলাম না। কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে আসি। ১৮ জানুয়ারি শহীদুল্লাহ কায়সারের ছোট ভাই জহির রায়হান ঢাকায় আসে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একদিন নিচতলায় প্রচণ্ড হৈচৈ শোনা যাচ্ছিল। অনেক লোক জমা। শাহরিয়ার কবির আমাকে নিচে আসার জন্য ডাক দিলো। গিয়ে দেখি, খাবার ঘরে একজন লোকের হাত পেছনে বাঁধা। পা বাঁধা চেয়ারের সঙ্গে।

ওকে দেখেই বাঘের মতো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। এই আমার স্বামীর হত্যাকারী বলে গলা টিপে ধরি। টেনে শার্ট ছিঁড়ে ফেলি। যার মুখোশ খুলে ফেলেছিল আমার ননদ, এই লোকটা ছিলো সে। কিন্তু তার মনে আমি কোনো ভয় দেখিনি। সে এখনো বেঁচে আছে। জামায়াতের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। ঘাতক খালেক মজুমদারকে থানায় দেই। থানায় ডায়রি করা হয়। ১৯২৭ সালের দিকে শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যার বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। কোর্টে দাঁড়িয়ে আমি আমার ননদসহ আত্মীয়স্বজন খালেক মজুমদারকে শনাক্ত করলাম।

বিচারককে বলছিলাম, আমি ওকে শাস্তি দেবো। আদালতে উত্তেজিত হওয়ায় আমাকে সরিয়ে নেয়া হয়। তারপর শুনলাম তার ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। আসামি আদালতে খুনের কথা স্বীকার করেনি। সে শহীদুল্লাহ কায়সারকে অন্যদের হাতে তুলে দেয়ার কথা বলেছে। হত্যার প্রমাণ না হওয়ায় তার ফাঁসি হয়নি। জেলে বসেও সে আমাদের হুমকি দিয়েছে। বিচারের নামে প্রহসন হয়েছিল সেদিন।”

খালেক মজুমদারকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল। আদালতে আবারো শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী, বোন, ভাইয়েরা তাকে শনাক্ত করেন। কিন্তু বিচারক তাঁকে সশ্রম কারাদন্ডে দেন। তার পুরো নাম ঠিকানা হচ্ছে, এ বি এম খালেক মজুমদার, পিতা-আব্দুল মজিদ মজুমদার, গ্রাম-দোহাটা, হাজিগঞ্জ, কুমিল্লা। এই নরপিশাচের বাসায় বিজয়ের পর অভিযান চালিয়ে বুদ্ধিজীবিদের নামের তালিকা সম্বলিত একটা ডাইরি খুঁজে পান মুক্তিযোদ্ধারা, যার অনেকগুলা নামের পাশে লাল কালিতে ক্রস চিহ্ন দেয়া ছিল। তারা আর কখনো ফিরে আসেননি। এতো প্রমাণ, চাক্ষুষ সাক্ষ্মী থাকার পরেও খালেক মজুমদারকে শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরণ করার দায়ে ১৪ মতান্তরে ৭ বছরের (তার নিজের আত্মজীবনীতে ৭ বছরের কথা উল্লেখ করেছে সে) সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। তারপরেই শুরু হয় ঘৃণিত এক কালো অধ্যায়। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ক্ষমতায় এসে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবতর্ন হিসেবে আজকাল বেশ বিখ্যাত জিয়াউর রহমান খালেক মজুমদারসহ বিচারের অপেক্ষায় থাকা এগারো হাজার চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী রাজাকার আলবদর আল শামস খুনীদের সসস্মানে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল হাইকোর্টের এক রায়ে খালেক মজুমদারকে ‘শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণ মামলার অভিযোগ’ থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।

কি, শুনতে অবিশ্বাস্য লাগছে, তাই না? বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারীদের অন্যতম এ বি এম খালেক মজুমদার। তার নেতৃত্বেই আলবদর বাহিনীর কিলিং স্কোয়াড তুলে এনেছে একের পর দেশ মাতৃকার সেরা সন্তানদের। শুধু সিরাজউদ্দিন হোসেন, ডঃ মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারই নন, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ড. আবুল খায়ের, এস এম এ রাশীদুল হাসান (ঢাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক), ড. ফয়জুল মহি, ড. সেরাজুল হক খান, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা কে (প্রধান চিকিৎসক, ঢাবি) অপহরণ ও হত্যার সাথেও এই ঘাতক সরাসরি জড়িত ছিল।

মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য পৌছে দেবার জন্য যে অকুতোভয় বীর নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে শত্রুর বেষ্টনীতে রয়ে গিয়েছিলেন, তার খুনীরা শহীদুল্লাহ কায়সারদের জীবনের বিনিময়ে শত্রুমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বুকভরে শ্বাস নিয়ে আরাম আয়েশে বেঁচে ছিল বছরের পর বছর, এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখি?

তথ্যসূত্র_
১। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ দেওয়া পান্না কায়সারের জবানবন্দী
২। পান্না কায়সারের সাক্ষাৎকার, দৈনিক দিনের শেষে
৩। বিপ্লবীদের কথা (মাসিক পত্রিকা), শেখ রফিক
৪। ৭১-এর দলিল: বুদ্ধিজীবিদের নিধন চলেছিলো সারা বছর ধরেই/অমি রহমান পিয়াল
৫। জামাতে মওদুদীর খালেক মজুমদার: এ ঘাতক কে চিনে রাখুন

লেখক: একটিভিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

অবিনাশী সংশপ্তক শহীদুল্লাহ কায়সার ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রহমান রা'আদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর