Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী শহীদ আলতাফ মাহমুদ

রহমান রা’আদ
৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:৩৪

নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন হারাবার ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়া খুব স্বাভাবিক। দোষ না, অপরাধ না, বরং খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। বেশিরভাগ মানুষই হয়তো নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাহস হারিয়ে স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি, বিবেক-নৈতিকতা ইত্যাদি সকল গুণ হারিয়ে স্রেফ জীবন বাঁচাতে সম্ভাব্য সবকিছু করবে। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু কিছু মানুষ থাকেন যারা ঠিক সেসময়ে হয়্যে ওঠেন অমিত সাহসী অকুতোভয়, প্রচন্ড মানসিক শক্তিতে নিশ্চিন্ত মৃত্যুতে বরণ করে নেবার মানসিকতায় দৃঢ়তায় গড়েন অভূতপূর্ব বীরত্বের ইতিহাস! গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, মিউজিশিয়ান, গণসঙ্গীত শিল্পী, কিংবদন্তী সুরকার ও সংস্কৃতি কর্মী আলতাফ মাহমুদ ছিলেন মৃত্যুমুখেও অকুতোভয় বলীয়ান এক দুঃসাহসী বীর!

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তান হবার পর প্রথম আঘাতটা এসেছিল ভাষার উপর। ছোট্টবেলায় মায়ের মুখে শুনতে শুনতে যে মাতৃভাষায় প্রথম কথা বলতে শিখেছি আমরা, সেই বাংলাকে দাবিয়ে পাকিস্তানীরা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল উর্দু। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত অকাতরে রাজপথে ঢেলে রক্ষা করেছিল মায়ের ভাষার অধিকার, সেই বীর ভাষাশহীদদের স্মরণে জন্মেছিল সেই বিখ্যাত চরণ, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?” প্রাথমিক যে সুরে রচির হয়েছিল গানটি, কালের গর্ভে সেই সুর প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

বিজ্ঞাপন

গানটা এখন আমরা গাই আলতাফ মাহমুদের সুরে, পরম যত্নে যেন প্রাণের গভীর থেকে উৎসারিত এক বিষাদমাখা সুরে বেঁধেছিলেন কথাগুলো তিনি, সৃষ্টি হয়েছিল এক অমর সঙ্গীতের। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটায় খুব ভোরে উঠে প্রভাতফেরির সাথে হাঁটতে হাঁটতে শহীদমিনার যেতেন আলতাফ, ঠোঁটের হারমোনিকায় বাজতো সেই কালজয়ী সুর। সেখান থেকেই আজ কোটি বাঙ্গালী তার সেই সুরে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারীতে স্মরণ করে ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়া সংগ্রামী শহীদ ভাষাসৈনিকদের।

আলতাফ মাহমুদের জন্ম ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর, বরিশাল জেলার মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে। ডাকনাম ছিল ঝিলু। শৈশব থেকেই ছিলেন ডানপিটে, গানের চমৎকার গলার পাশাপাশি ছিল ছবি আঁকার দারুণ হাত। কাঁঠাল গাছে খোদাই করে লিখেছিলেন নিজের নাম, “ঝিলু দ্য গ্রেট”। রাশভারী বাবার চোখ এড়ায়নি তা। বিদ্রুপের সুরে বলেছিলেন, গানবাজনায় মত্ত হইয়া গাছে খোদাই কইরা নিজের নাম লিখলেই কি গ্রেট হওয়া যায়রে! ঝিলু দৃঢ়স্বরে বলেছিল, আমি গ্রেট হইয়াই দেখামু!

ঝিলু তার কথা রেখেছিল। অসম্ভব প্রতিভাবান, সংস্কৃতিমনা ঝিলু স্রেফ গানের মানুষ হিসেবে কথা সুর আর কন্ঠে হারমোনিকা আর প্রিয় বেহালায় ইতিহাসের পাতায় রয়ে যেতে পারত গ্রেট হিসেবে, কিন্তু মহাকালের যে তাঁকে নিয়ে ছিল অন্য পরিকল্পনা! কে জানতো সেদিনের সেই ঝিলু গ্রেটনেসের সীমা লিখবেন নতুন করে, মুক্তিযুদ্ধের আরবান গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুনের একজন কিংসপিন হিসেবে তার বাড়িটা পরিণত হবে এক সেইফ হেভেনে, অস্ত্র-গোলাবারুদের নিরাপদ আশ্রয়ের পাশাপাশি যেখানে থাকবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য থাকবে দুহাত বাড়িয়ে সাহায্য, এমনকি নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়ে দেবার জন্য তিনি একলাই নেবেন মৃত্যুপরোয়ানার সমস্ত দায়!

আলতাফ মাহমুদের সাহসের পরিচয় পাওয়া যায় একদম ছোট থেকেই। দশ বা বারো বছর বয়সে একদিন কোরআন তেলাওয়াত করতে গিয়ে ঘটিয়েছিলেন এক অদ্ভুত ঘটনা। বাবা নেজাম আলী ছিলেন কট্টর মুসলিম লীগ ঘরানার, তিনি ভোরে ফজরের নামাজ শেষ করে উঠোনে আসতেই হঠাৎ শুনতে পেলেন কেউ একজন চমৎকার সুললিত কণ্ঠে কোরআন পড়ছে, শুনতেই ভালো মুশকিল হচ্ছে যে কোরআন পড়ছে সে পড়ছে গজলের সুরে। প্রবল ক্ষিপ্ত হয়ে নেজাম আলী ঘরে ঢুকে দেখলেন তার পুত্র তখনকার বিখ্যাত একজন গজল শিল্পীর গাওয়া গানের সুরে তেলাওয়াত করছে। লাঠি নিয়ে ছেলেকে শাসন করবার আগেই সে দৌড়ে পালিয়ে যেতে যেতে বলেছিল, “সুর তো সুরই। তা গানের হোক বা কোরআন তেলাওয়াতের হোক। আমি এভাবেই তেলাওয়াত করবো।”

এই ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালের খ্যাতনামা বেহালাবাদক সুরেন রায়ের কাছে বেহালাবাদন শেখেন। এরপর তিনি এই কলেজের শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে, চিত্রকলা শেখার জন্য কলকাতা আর্টস স্কুলে ভর্তি হন। তবে এই শিক্ষাও তিনি শেষ করেন নি। এই সময় বরিশাল অশ্বিনিকুমার টাউনহলে পাট চাষিদের এক সভায়, গণনাট্য সংঘের বিখ্যাত গান ‘ম্যায় ভুখা হুঁ’ গানটি গেয়ে প্রশংসিত হন।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো না হওয়ায় বাবার সাথে প্রবল বাকবিতন্ডা হয়েছিল তার, এরপর থেকে ক্রমেই বাবার সাথে দুরত্ব বাড়তে থাকায় ১৯৪৯ সালের শেষদিকে একদিন মায়ের হাতে সেলাই করা নকশী কাঁথা এবং প্রিয় বেহালা কাঁধে নিয়ে বাড়ি ছাড়লেন আলতাফ,চড়ে বসলেন ঢাকাগামী লঞ্চে। প্রগতিশীল সংগঠন ‘ধূমকেতু শিল্পী সংঘ’-এর সাথে যুক্ত হন ঢাকায় এসে। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি যুবলীগের সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট-এর “পূর্ব-পাকিস্তান শিল্পী সংসদ”-এ যোগদান করেন। এই সময় তিনি গণসঙ্গীত দ্বারা গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেন।এই সময়ে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গণসঙ্গীত গাইতেন।

এভাবেই তিনি হয়ে যান ইতিহাসের অংশ। ভাষা আন্দোলনের অনবদ্য মোড় ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে ভাষার মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন অনেকেই, তাদের স্মরণে মোশারফ উদ্দিন রচিত ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে’ কবিতাটিতে সুরারোপ করেন আলতাফ মাহমুদ। এটি বিবেচিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রথম গান হিসেবে। এর দুদিন পরেই ২৩ ফেব্রুয়ারি, আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি রচনা করেন। এই গানটির প্রথম সুর করেছিলেন তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক সুরকার আব্দুল লতিফ।

আলতাফ মাহমুদের সুরারোপিত ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে’ গানটি গাওয়া হয় ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রথম প্রভাতফেরীতে। এই সময়ে আলতাফ মাহমুদ আরো একটি কাজ করেন। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটিতে আলতাফ মাহমুদ নতুন করে সুরারোপ করেন। সেটি এতোটাই হৃদয়স্পর্শী ছিল যে এরপর থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের প্রভাতফেরীতে আলতাফ মাহমুদের সুরারোপিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটিই গাওয়া হতে থাকে।

এই গানটিতে তার সুরে আরো একটি পরিবর্তন এনেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। সেটি ১৯৬৯ সালে। সামান্য পরিবর্তন আনা সুরটি জহির রায়হানের চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া’য় ব্যবহৃত হয়। এই সুরটিই “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারীর চূড়ান্ত সুর হিসেবে আজ আমরা শুনে থাকি। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনের উপর গাজিউল হক রচিত ‘ভুলবো না ভুলবো না একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবো না’ ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচিত ‘মেয়েটার বর মরেছে আর বছর’ গানেরও সুরারোপ করেন তিনি। মোটকথা, মহান ভাষা আন্দোলনের মহিমা হৃদয়স্পর্শী অলৌকিক সব সুরে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌছে দেবার এবং চিরসজীব রাখবার কাজটা অনুপম দক্ষতায় করে গেছেন আলতাফ মাহমুদ।

সংস্কৃতি সংগঠক হিসেবে আলতাফ মাহমুদের নেতৃত্বদানের শুরু ‘বরিশাল শিল্পী সংসদ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সংসদের কার্যনির্বাহী পরিষদ সদস্য নূর আহমেদ রচিত ‘আগামী দিন’ ও তারাশংকরের ‘দুই পুরুষ’ নাটকের সঙ্গীত পরিচালনা ও নেপথ্য কণ্ঠ দানের মাধ্যমে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আলতাফ মাহমুদের যাত্রা শুরু। তা আরো সংহত হয় কুমিল্লা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ’ প্রযোজিত নৃত্যনাট্য ‘কিষাণের কাহিনী’ ও ‘মজদুর’ এ সংগীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়ে আলতাফ মাহমুদ ঘটিয়েছিলেন আরেক অভিনব সাহসী ঘটনা।

তিনি বরিশালের মঠবাড়িয়া ও সমগ্র বরিশাল জেলায় নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। সে সময় তার গাওয়া গানগুলোর মধ্যে ‘মোরা কি দুঃখে বাঁচিয়া রবো’ ও ‘মন্ত্রী হওয়া কি মুখের কথা’ এ গান দুটি জনপ্রিয়তা পায়। তার বাবা নেজাম আলী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু আলতাফ মাহমুদ পিতার পক্ষে কোনো প্রচারণা চালাননি । কারণ তার পিতার গোঁড়া ধর্মান্ধ রাজনীতি তার পছন্দ ছিল না। নির্বাচন শেষে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর শাসন প্রবর্তিত হয় এবং পূর্ব-বাঙলায় ৯২-ক ধারা আরোপ করা হয়। এই ধারা মোতাবেক আলতাফ মাহমুদ ও নেজামুল হকের বিরুদ্ধে পুলিশী হুলিয়া জারী হয় এবং তাঁরা দু’জন আত্মগোপন করেন।

ছয়মাস পরে হুলিয়া প্রত্যাহার করা হলে, তিনি সে সময়ের সাড়া জাগানো নিজামুল হক পরিচালিত ছায়ানাট্য-এর ‘শিল্পী’র সঙ্গীত পরিচালন ও কণ্ঠদান করেন। এই সময়েই ভৈরবে ঘটে এক অভাবিত ঘটনা। ছাত্রলীগ নেতা জিল্লুর রহমানের আহ্বানে ও ব্যবস্থাপনায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদের লেখা, সুরকরা ও গাওয়া ‘মেঘনার কূলে ছিল আমার ঘর/হঠাৎ একটা তুফান আইসা ভাইসা নিল তারে রে’ গানটি মানুষের হৃদয়কে এমনই নাড়া দেয় যে শ্রোতাদের বারংবার অনুরোধে আলতাফ মাহমুদকে গানটি একই মঞ্চে পর পর ১৯ বার গেয়ে শোনাতে হয়। এ থেকেই বোঝা যায় ধীরে ধীরে গণমানসে অসামান্য প্রতিভা ও তার নিবেদনে জায়গা করে নিচ্ছিলেন আলতাফ।

তার সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত ছিল আলতাফ মাহমুদ কৈশোর থেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন গণমানুষের শিল্পী হিসেবে, খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমিক-মজুর-কৃষকের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই আগস্ট, ১২টা ১ মিনিটে স্থানীয় ‘তরুণ মাহফিল’-এর পক্ষ থেকে পাকিস্তান বরণ উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন কিশোর আলতাফ মাহমুদ। কিন্তু স্বাধীনতা স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষা থেকে পাকিস্তানের জন্য করা আন্দোলনের অংশ হবার ভুল শুধরে নিয়েছিলেন তিনি, আত্মনিয়োগ করেছিলেন গণমানুষের স্বাধিকার আর স্বাধীনতার আন্দোলনে, অসামান্য এক অস্ত্র গানের শক্তি নিয়ে! সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান পর্যন্ত সবগুলো গণআন্দোলনে আলতাফ মাহমুদকে পাওয়া গেছে সাধারণ মানুষের কাতারে, গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গঞ্জ থেকে বন্দর, নগরে, রাজপথে গান করছেন তিনি অবিশ্রান্ত উৎসাহে।

সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ‘তানহা’, ‘ক্যায়সে কহুঁ’, ‘কার বউ’, ‘জাগো হুয়া সাভেরা’, ‘বাঁশরী’, ‘আপন দুলাল’, ‘দুই ভাই’, ‘সংসার’, ‘কুঁচবরণ কন্যা’, ‘সুয়োরাণী দুয়োরাণী’, ‘সপ্তডিঙা’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘নয়ততারা’, ‘রহিম বাদশা ও রূপবান’, ‘বেহুলা’, ‘হাজার তারের বীণা’ ইত্যাদি সবমিলিয়ে ১৯টি চলচ্চিত্র এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনভিত্তিক ঘটনার উপস্থাপনা ‘হাজার তারের বীণা’ নৃত্যনাট্যের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে পরিচিত হন পাকিস্তান আমলের অন্যতম প্রধান সৃজনশীল সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্বে।

মাত্র ১৬ বছর বয়সেই বরিশালে কৃষকদের জনসভায় ‘ম্যায় ভুখা হুঁ’ গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে যে প্রতিভার জন্ম, তারপর একে একে ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ থেকে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ‘মন্ত্রী হওয়া কি মুখের কথা’ হয়ে ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর ‘এ ঝঞ্ঝা মোরা রুখবো’র মতো অসামান্য সব গানের মধ্য দিয়ে পরিণত হয়েছিলেন অসমসাহসী আলোকশিখায়। আর সেই সাহস যে অবিনাশী চির জাজ্বল্যমান, তার প্রমাণ তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে গিয়েছিলেন একাত্তরে।

৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় থাকতেন আলতাফ মাহমুদ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দুই নম্বর সেক্টর গঠিত হলে ঢাকায় আরবান গেরিলারা চালাতে থাকে একের পর এক দুঃসাহসী অভিযান। যাদের অকুতোভয় সাহসে কপট বিরক্তি আর নিখাদ বিস্ময়ে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এই গেরিলাদের নাম দিয়েছিলেন ক্র্যাক পিপল, সেখান থেকেই ক্র্যাক প্লাটুন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অসামান্য বেপরোয়া লড়াইটা লড়েছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা। শত্রু অধ্যুষিত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় একের পর এক বোমা ফাটিয়ে, স্থাপনা উড়িয়ে, চেক পয়েন্টে গুলি চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তারা।

আর সেই গেরিলাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের সেইফ হেভেন ছিল আলতাফ মাহমুদের এই ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলারের বাড়িটি। অস্ত্রপাতি লুকিয়ে রাখা থেকে শুরু করে শত্রুপক্ষের ইনটেল, পরবর্তী অপারেশনের প্ল্যানিং, নতুন গেরিলাদের আবাসন- সব কিছুর দায়িত্ব ছিলো তার ওপর। বাসাটা পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম তীর্থে, অগণিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, তাদের থাকা-খাওয়া, তাদের মেলাঘরের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া, আলতাফ মাহমুদ সবই করতেন। বাড়িটি পরিচিতি পেয়ে যায় একাত্তরের দুর্গবাড়ি নামে।

এখান থেকেই আলতাফ মাহমুদ এপ্রিলের শেষে প্রচুর গণসঙ্গীত রচনা, সুরারোপ ও কণ্ঠ রেকর্ড করে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে পাঠাতে শুরু করেন। এরমধ্যে ১২টি গানের একটি স্পুল একজন মুক্তিযোদ্ধা সীমান্তের ওপারে নেবার সময় পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়েন এবং তাকে মেরে ফেলা হয়। ফলে খালেদ মোশাররফের নির্দেশে শাহাদাৎ চৌধুরী প্রায়ই আসতেন তার কাছে, স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের গান রেকর্ড করে তার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন আলতাফ।

একদিন ক্র্যাক প্লাটুনের কয়েকজন এসে বললেন, ঢাকায় প্রচুর পরিমানে আর্মস অ্যান্ড অ্যামিউনেশন আনতে হবে, রাখার জায়গা নাই। তার বাসায় রাখতে হবে। আলতাফ বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না, তার বাসা পরিণত হল অস্ত্র-গোলাবারুদের বিশাল এক দুর্গে। এভাবে ঢাকা শহরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আতংক হয়ে ওঠা ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম প্যাট্রোনাইজার হয়ে উঠলেন তিনি, জানতেন মাথার উপর মৃত্যু ঝুলছে। কিন্তু তিনি ভয় পাননি। ভয় শব্দটা তার অভিধানে ছিল না।

৩০ শে আগস্ট ভোরে যখন পাকিস্তানী সেনারা বাড়িতে ঢুকে গেল, চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘মিউজিক ডিরেক্টর কৌন হ্যায়?’, তখনো তিনি ভয় পাননি। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে শির উচু করে বেরিয়ে এলেন বীর, ভোরের পবিত্র আলোয় তাকে যেন অপার্থিব লাগছিল, বুকটা টান টান করে জবাব দিলেন, আমিই আলতাফ মাহমুদ, কি চাও তোমরা?

— হাতিয়ার কিধার হ্যায়?

আলতাফ বুঝে গেলেন ওরা সব জেনেই এসেছে। তার মাথায় একটাই ভাবনা ঘুরতে লাগলো, যেভাবেই হোক ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধারা (যারা তার বাসায় তখন ছিল), তার পরিবার-পরিজন সবাইকে বাঁচাতে হবে। বললেন, এসো আমার সাথে। পাকিগুলো তার হাতে কোদাল তুলে দিল, মাটি খুঁড়তে বললো।

একটু দেরি হয়েছিল হয়তো, একজন রাইফেলের বাট দিয়ে সাথে সাথে মুখে মারলো, আরেকজন বেয়োনেট চার্জ করলো। একটা দাঁত ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল, কপালের চামড়া ফালাফালা হয়ে কেটে ঝুলতে লাগলো চোখের উপর।

ওই বাসা থেকে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আটক করা হয় গেরিলা আবুল বারাক আলভী, আলতাফ মাহমুদের চার শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা লিনু বিল্লাহ, দিনু বিল্লাহ, নুহে আলম বিল্লাহ, খাইরুল আলম বিল্লাহসহ ছয় জনকে। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁও নাখালপাড়ার ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে। চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। বিশেষত আলতাফ মাহমুদসহ পাকিস্তানীদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠা গেরিলাদের উপর অত্যাচার পৈশাচিকতার সব সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ক্র্যাক প্লাটুনের অন্য সবার মত আলতাফ মাহমুদের মুখ থেকেও একটা শব্দ বের করতে পারেনি। আলতাফ মাহমুদ আর ফিরে আসেননি, উন্নত মম শিরের সেই অসামান্য বীরের আর কখনো দেখা হয়নি তার ছোট্ট শাওনের মুখটা।

মুক্তিযোদ্ধা লিনু বিল্লাহ, আবুল বারাক আলভীসহ সেদিন গ্রেফতার হওয়া সবাই পরবর্তীতে নির্যাতন শেষে ছাড়া পান পাকিস্তানী টর্চার সেল থেকে। কারণ নিশ্চিত মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানীদের আলতাফ মাহমুদ বলছিলেন, “আমার সঙ্গে যারা এসেছে, আমি ছাড়া আর কেউই অস্ত্রের ব্যাপারে কিছু জানে না। “পুরো দায়ভার তিনি নিজের উপর নিয়েছিলেন, লিনু, দিনু, আল্ভীদের বলেছিলেন, ‘তোমরা সবাই অস্বীকার করবে। আমি বলেছি সমস্ত দায় আমার। তোমাদের কোনো দোষ নেই।’

কর্ম আর কীর্তিতে নিজেকে ইতোমধ্যেই বাঙ্গালী ইতিহাসে উজ্বলতম করে তোলা আলতাফ মাহমুদ তার বাবাকে দেয়া কথা রেখেছিলেন। কাঁঠালগাছের গায়ে লেখা ঝিলু দ্য গ্রেট লাইনটা সত্য হয়েছিল, রক্তের অক্ষরে ক্ষতবিক্ষত ঝিলু গ্রেটনেসের সংঙ্গা লিখেছিলেন নতুন করে, জীবনের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে হাসিমুখে শুধু নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে যাওয়ার চেয়ে বড় পুণ্য তো আর নেই, তাই না?

তথ্যসূত্র :
১. শহীদ আলতাফ মাহমুদ ডট কম/ https://shahidaltafmahmud.com/
২. একাত্তরের দিনগুলি/ জাহানারা ইমাম

সারাবাংলা/এসবিডিই

অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষ্মী শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রহমান রা'আদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর