মানবকল্যাণে উৎসর্গিত প্রাণ নূতন চন্দ্র সিংহ
১১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:১৪
‘এদেশ আমার
স্বদেশ আমার উত্তরাধিকার
মৃত্যু মেনে মৃত্যু জেনে
রাখব অধিকার’
কথাগুলো যার স্মৃতিবেদীতে লেখা আছে তিনি জীবনের শেষমুহুর্ত পর্যন্ত কাজে লাগিয়েছিলেন মানবকল্যাণে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিয়েছেন শিক্ষার আলো, নারীদের শিক্ষিত করে সমাজের মূল স্রোতে আনতে চাওয়া কিংবা দুর্গম অঞ্চলে চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছে দিতে তার অবদান- এসকলকিছুই তাকে পরিণত করেছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য এক প্রদীপ্ত আলোকশিখায়। সশস্ত্র পিশাচ পাকিস্তানীদের হাতে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও অপরিমেয় দেশপ্রেমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় নিজের জন্মভূমির মাটি ছাড়তে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তিনি, মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন অকুতোভয় সাহসে। তিনি মহান দানবীর, সমাজসেবী, শিক্ষাব্রতী, কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ। তার পরম পুণ্যস্মৃতি আজো আমাদের সত্য, শুভ্র কল্যাণকর আগামী বিনির্মাণে উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা যোগায়।
নূতন চন্দ্র সিংহের শৈশবটা ছিল কঠিন ও নির্দয়। ১৯০০ সালে পহেলা ডিসেম্বর রাউজানের গহিরা গ্রামে মামাবাড়িতে জন্ম তার। মাত্র আড়াই বছর বয়সে মা গয়েশ্বরী সিংহকে হারিয়ে তার স্থান হয়েছিল জগৎপুর পূর্ণানন্দ আশ্রমে। সেখানেই তার ছয়বছর বয়সে অক্ষরজ্ঞান শিক্ষা শুরু হয়। নয় বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের তাগিদে বাবা অখিল চন্দ্র সিংহের সাথে যেতে হয়েছিল বার্মায়। জীবনযুদ্ধের কঠিন এই অধ্যায়ে মুদির দোকান, কাপড়ের ব্যবসা, ফল ও শরবতের দোকান, সাবান প্রস্তুতকারক সহ বিভিন্ন পেশায় উপার্জিত অর্থ ফেলে রেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন তিনি। ধারণা করা হয় বিহারে কুণ্ডধাম তীর্থ দর্শন করে তার ভেতরে আসে বিশাল এক পরিবর্তন। তিনি চট্টগ্রামে ফিরে এসে প্রতিষ্ঠা করেন দেবী কুন্ডেশ্বরীর মন্দির। এরপরে ১৯৪৬ সালে তার গ্রাম গহিরায় প্রতিষ্ঠা করেন কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়, যা ধীরে ধীরে পরিণত হয় ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আয়ুর্বেদিক ঔষধশিল্পে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশ বিভাগ এবং তার পরবর্তী পাকিস্তানি শোষণে বাংলা তখন টালমাটাল। নূতন চন্দ্র ইতোমধ্যেই দেখেছেন ১৯৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের নিদারুণ অভিশাপ, ফেলে এসেছেন শৈশব-কৈশোরের দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করা দিন। তাই কঠোর পরিশ্রম ও প্রতিভায় পেশাগত সফলতায় সম্পদশালী হয়ে উঠলেও ফেলে আসা দুঃসহ দিনগুলো তাঁকে সবসময় ধরে রেখেছিল সাধারণ জনগণের কাতারেই। অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত নূতন চন্দ্র সিংহ বিলাসিতায় গা না ভাসিয়ে সমাজ ও মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন নিরলস প্রচেষ্টায়।
চট্টগ্রাম-রাউজান-রাঙামাটি সড়কে হালদা নদীর সত্তারঘাট এলাকায় সাধারণ মানুষের খেয়া পারাপারে ঘটতো বিশাল সমস্যা। ইজারাদারদের হয়রানি থেকে শুরি করে অতিরিক্ত ভাড়া দাবী ইত্যাদি নানা কারণে খেয়াঘাটে ভোগান্তির শিকার হতে হত যাত্রীদের। নূতন চন্দ্র খেয়াঘাটটি সারা বছরের জন্য নিজের নামে ইজারা নিয়ে যাত্রীদের বিনা পয়সায় পারাপারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার হাত খুলে দান করার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে সারাদেশে। সেই গোঁড়ামিপূর্ণ ধর্মের নামে উগ্রতা ছড়াবার কালে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অগণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মন্দির-মসজিদ-গীর্জায়ও তিনি অকাতরে দান করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের যে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে তার থেকে লব্ধ অর্থে দেশের সকল সম্প্রদায়ের অধিকার আছে।
কিন্তু দান করে মহৎ খেতাব পাওয়া বা সুনাম অর্জন তার উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি মানুষের কল্যাণে যা কিছু গড়েছেন জীবনে, সেসবের সবকিছুতেই সকলের অবদান চাইতেন তিনি। চাইতেন ভালো কাজে মানুষের দানের অভ্যাস গড়ে তুলতে। একটি স্মৃতিকথায় এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমি চাই সে অঞ্চলের অধিবাসীদেরও কিছু কিছু ত্যাগের ভাগ এই প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকুক। নইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি গ্রামবাসীদের দরদ থাকবে না। তাই আমি প্রস্তাব করলাম, আপনাদের এলাকার অধিবাসীদের থেকে প্রথমে প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ সংগ্রহ করুন এবং আপনারা যত টাকা সংগ্রহ করতে পারবেন, আমি নিজে তত টাকা আপনাদের দেব। আমার কাছ থেকে বেশি পাবার আশায় এই সৎকাজে তাদের ত্যাগের পরিমাণ যেন বেশি হয়, এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য’।
নারীশিক্ষা বিস্তারে তার দূরদর্শিতা ছিল অসামান্য। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সঙ্কটকালে বা রাষ্ট্র-সমাজের কনশাসনেস তৈরিতে বৌদ্ধিক পরামর্শদানের মাধ্যমে যথার্থ দিকনির্দেশকারী পন্ডিতকে বলা হয় বুদ্ধিজীবী। নূতন চন্দ্র সিংহ ছিলেন তৎকালীন সময়ে প্রজন্মকে এগিয়ে দেয়া একজন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী। আজকের চট্টগ্রামে কুন্ডেশ্বরী গ্রাম বদলে গেছে, নগরায়নের ফলে বদলেছে রাউজানের পুরো চিত্রও। এরপরও নারী শিক্ষার অগ্রগতির কথা চিন্তা করে একটা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা কেউ ভাববেন সেটা এখনো অপ্রত্যাশিত। কিন্তু সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আজ থেকে পাঁচ দশক আগে নূতন চন্দ্র তৈরি করেছেন একের পর এক নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সমাজ বদলানোর ব্রত নিয়ে নূতন চন্দ্রের এইসব উদ্যোগ ছিল বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তার প্রতিফলন। তিনি নিজ গ্রামে নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে যেমন নিয়েছেন গ্রামের প্রতি ঘর থেকে মুষ্টিভিক্ষা, তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি চেয়েছেন সে অঞ্চলের মানুষের দান যুক্ত থাকুক সেখানে। আরেক শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. রশিদুল হক লিখেছিলেন, ‘আমাদের ধারণাই ছিল না যে গ্রাম-দেশে এরকম সুন্দর, সুপরিচালিত একটি স্কুল বিশেষ করে মেয়েদের স্কুল থাকতে পারে।’
যার যেমন সামর্থ্য সেভাবে সাহায্য গ্রহণ করেছেন, যে পরিবার টাকা দিতে পারেনি সে পরিবার ধান-চাল দিয়ে সাহায্য করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন গ্রামের প্রথম মেয়েদের স্কুলটি প্রতিষ্ঠার গর্বিত অংশীদার যেন হতে পারেন এলাকার সবাই। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং তার অনুপ্রেরণায় সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় ১৯৬০ সালে কুণ্ডেশ্বরী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কুন্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির তৈরি হয়। অসংখ্য মেয়েশিশুদের লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করতে পেরে অনুপ্রাণিত নূতন চন্দ্র ১৯৬৯ সালে বালিকা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় পাঠশালায় নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা শিখতে পেরেছেন যিনি, সেই স্বশিক্ষিত নূতন চন্দ্র তার অন্তরের আলোয় আলোকিত হয়ে জ্বালালেন শিক্ষার চিরস্থায়ী প্রদীপ শিখা। যার আলোয় আজ পর্যন্ত আলোকিত হচ্ছে রাউজান থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সারা বাংলাদেশের অগণিত নারী। শুধু শিক্ষা নয়, দরিদ্র নারীদের স্বনির্ভরতার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি, বর্ণভেদপ্রথায় জর্জরিত সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন নারীদের, কুন্ডেশ্বরী পূজায় তার তৈরি করা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পংক্তিভোজের রীতি আজো পালিত হয় প্রতিবছর।
সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত না হলেও পাকিস্তানীদের শোষণ আর বঞ্চনার করাঘাত ব্যাথিত করত নূতন চন্দ্রকেও। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন কুণ্ডেশ্বরী কমপ্লেক্সে এসে অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের সাথে সাক্ষাৎ করে গেলেন, নতুন করে জন্মভূমির স্বাধিকার আর মুক্তির চেতনায় অনুপ্রাণিত হলেন তিনি। মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও রাজনীতিবিদদের আশ্রয় ও পরামর্শস্থল ছিল কুন্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স। অপারেশন সার্চলাইটের পর যা পরিণত হয় মুক্তিকামী মানুষের পরম নিরাপদ আশ্রয়স্থলে। গোলার ধান, পুকুরের মাছ, ক্ষেতখামারের ফসল অবারিত ছিল বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকা অসহায় মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। তখনো পাক বাহিনী রাউজানে প্রবেশ করেনি, কুন্ডেশ্বরী ছিল মুক্তাঞ্চল। যেসব এলাকা পাক বাহিনীর দখলে চলে যাচ্ছে, সেসব এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দসহ মুক্তি সংগ্রামী ‘জয় বাংলা’ বাহিনী, রণক্লান্ত সৈনিক, হানাদার বাহিনীর হামলার ভয়ে পলায়নপর নারী-পুরুষ – আবাল – বৃদ্ধ-বণিতা খাদ্য ও সাময়িক বিশ্রামের জন্য যাত্রাবিরতিস্থল হিসেবে কুন্ডেশ্বরীকেই বেছে নিচ্ছিল। রাউজানের প্রধান সড়কের পার্শ্বস্থিত কুন্ডেশ্বরী পরিণত হয়েছিল এক ট্রানজিট ক্যাম্পে।
শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢুকে পড়ায় পালাতে থাকা শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের কুন্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স ছিল উন্মুক্ত। উপাচার্য প্রফেসর ডক্টর আজিজুর রহমান মল্লিক, বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা বিভাগের রিডার ড. আনিসুুজ্জামান, সহকারী অধ্যাপক ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী, সহকারী অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, গবেষণা সহকারী মাহবুব তালুকদার, সহকারী অধ্যাপক মনিরুজ্জামানসহ ৪৭জন অধ্যাপক আশ্রয় নিয়েছিলেন কুন্ডেশ্বরীতে। এদের মধ্য্যে আজিজুর রহমান মল্লিক ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পালন করেছেন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও। এরা সবাই তাদের জীবনের জন্য ঋণী ছিলেন অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্রের কাছে।
কুন্ডেশ্বরীতে পাকিস্তানী সেনাদের সম্ভাব্য হামলা আঁচ করে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন কাছের ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় চলে যাবেন। তখন তাঁরা নতুন চন্দ্র সিংহকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে। ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ড. রশীদুল হক নূতন চন্দ্রকে তিনদিন ধরে ক্রমাগত বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে, কুন্ডেশ্বরীতে থাকা আর কারো পক্ষে নিরাপদ নয়, তাঁর পক্ষে তো নয়ই। কিন্ত তিনি তাঁর দেশ, দেশের মাটি এবং তাঁর দেবী মা কুণ্ডেশ্বরীকে ছেড়ে কিছুতেই যাবেন না নূতন চন্দ্র।তার অকাট্য যুক্তি ছিল সবাই যদি চলে যাই, তাহলে অসহায় আশ্রয় নিতে আসা মানুষগুলোকে সেবা করবে কে? তাঁর এক কথা, তিনি তো কারও ক্ষতি করেননি, সুতরাং তাঁর ক্ষতি কে করবে! স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘সত্য ও ধর্মের পথে যে থাকে, তার বিনাশ হয় না’। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তারা কিংবা তার সন্তান প্রফুল্ল চন্দ্র সিংহ বাবাকে ভারতে নিয়ে যেতে পারেননি।
১৩ এপ্রিল খুব সকালে কুন্ডেশ্বরীতে হাজির হয়েছিল একদল বেলুচ রেজিমেন্টের পাকিস্তানী সেনা। তারা নূতন চন্দ্রের সাথে কথা বলে চলে গিয়েছিল। এরপরে আবার আরেক দল পাকিস্তানী সেনা এসে ঘুরে দেখে কথা বলে চলে যায়। কিন্তু সকাল দশটার দিকে কুন্ডেশ্বরীতে হাজির হয় তার বিশিষ্ট বন্ধু ফজলুল কাদের চৌধুরীর পুত্র সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সঙ্গে নিয়ে আসে পাঞ্জাবী সৈন্যদের একটি দল আর তার স্থানীয় রাজাকারদের। প্রতিদিনকার মতো নূতন বাবু তখন মাতৃমন্দিরের ভেতরে উপাসনায় মগ্ন।
পাঞ্জাবী সৈন্যরা এমনিতেই চরম বাঙালি-বিদ্বেষী, ঔদ্ধত্যপূর্ণ রূঢ় আচরণ, অশালীন খিস্তি-খেউড়ের জন্য যাদের কোন জুড়ি নেই। তার উপর তাদের নূতন চন্দ্র সিংহ সম্পর্কে নানাবিধ জঘন্য বানোয়াট নোংরা কথা বলে নিয়ে এসেছিল সাকা চৌধুরী। প্রথমে তারা জেনে নিয়েছিল তিনি মন্দিরে আছেন কিনা, এরপরে বুটজুতা পায়েই মন্দিরকে অপবিত্র করে ঢুকে পড়ে তারা, জোর করে টেনে হিঁচড়ে মন্দিরের সামনে এনে ফেলে নূতন চন্দ্রকে। হয়তো তখন তাঁকে পাঞ্জাবীরা জিজ্ঞাসাবাদ করত, কিন্তু নরাধম পিশাচ সালাহউদ্দিন কাদের ক্রমাগত পাঞ্জাবী সৈন্যদের উস্কাতে থাকে এবং জানায়, কুন্ডেশ্বরীতে নূতন চন্দ্র সিংহ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের আশ্রয় দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, এখানে ভারতীয় সৈন্যরা আশ্রয় নিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের উপর হামলা চালাচ্ছে, প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে এখানে, হিন্দু হওয়ায় ভারত সরকার কুন্ডেশ্বরীর নূতন চন্দ্রের মাধ্যমেই বিচ্ছিন্নতাবাদী মুক্তিদের সহায়তা করছে। সাথে সাথে পাঞ্জাবী নরপশুদের অস্ত্র গর্জে ওঠে।
তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজের পিস্তল বের করে গুলি চালায় নিথর নূতন চন্দ্রের দেহে। রাউজানের দানবীর, নারী শিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত, মানবকল্যাণে নিজেকে উজাড় করে দেয়া ঋষি অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের পবিত্র রক্তে ভিজে যায় কুন্ডেশ্বরীর মাটি। স্বাধীন বাংলাদেশে নয় মাস পর সন্তান প্রফুল্ল চন্দ্র বাড়ি ফিরে দেখেন শূন্য ভিটার দেয়ালগুলো কেবল দাঁড়িয়ে আছে। সাকা চৌধুরীর নেতৃত্বে রাজাকারেরা বিশাল কুন্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স, স্কুল, হাইস্কুলের দরজা-জানালা, কড়ি-বরগা, খাট-পালঙ্ক, সমস্ত আসবাবপত্র, হাড়ি-পাতিল, তামা-পিতল-কাসার সকল সামগ্রী, লেপ-তোষক-বালিশ একটি একটি করে খুলে নিয়ে গিয়েছিল। তারা পাকিস্তানের সেবক, ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং তার সন্তান সাকা চৌধুরী সাব আছেন মাথার ওপর, তারা ‘স্পেশাল’ ডাকাত, তাই ধীরে সুস্থে রয়ে সয়ে একটি পেরেকও যেন বাদ না যায় সেভাবেই লুট করে নূতন সিংহের ভিটা সাফ করে ফেলে। হরিলুটের পর কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের কাঁচামালসমূহ গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়।
মন্দিরের কুন্ডেশ্বরী দেবীর প্রতিমার হাত পা মুখ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়, দেবীর দেহে থাকা ২৫০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে চৌধুরীদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। আর মন্দিরের সামনে জায়গাটায় রক্ত শুকিয়ে গেলেও অনেকখানি জায়গা জুড়ে গোল হয়ে লাল দাগ রয়ে গিয়েছিল। প্রফুল্ল জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলেন সেখানেই পিতার বুকের তাজা রক্তে তৈরি হয়েছিল ছোটখাট পুকুর।
৪৪ বছর পর অবশেষে অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের হত্যাসহ নয়টি অভিযোগের মধ্যে মানবতাবিরোধী হত্যা ও গণহত্যার চারটি অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় কুখ্যাত নরপিশাচ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর। এই নোংরা কীটটি নূতন চন্দ্রএর তাজা রক্তের ভিতে তৈরি স্বাধীন বাংলাদেশে ছয়বার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। এর চেয়ে ভয়াবহ লজ্জা আর হয় না।
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’- এই আপ্তবাক্যকে নিজের জীবনের বিনিময়েও সত্য করে গিয়েছেন অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ। সত্য ও ধর্মের পথে থাকা নূতন চন্দ্রের বিনাশ হয়নি, বরং নিজের দেশের মানুষকে বাঁচাতে দেশের মাটিতেই মরতে চাইবার ধনুর্ভাঙ্গা পণ পূরণ করে নূতন চন্দ্র মহাকালের বুকে অবিনাশী ঔজ্জ্বল্যে চিরভাস্বর হয়ে আছেন, থাকবেন সবসময়। এই মহাপ্রাণের প্রতি শ্রদ্ধা। ভালোবাসা।
তথ্যসূত্রঃ
১। শ্রদ্ধায় স্মরণ: শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ, সুবর্ণা চৌধুরী, কলেজ শিক্ষক ও আবৃত্তি শিল্পী; শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের পৌত্রবধূ।
২। শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ/ মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
৩। শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ/ আলী মোঃ আবু নাইম-কানিজ ফাহিমা লাভা
৪। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র/ ৮ম খন্ড ৪৬৫ পৃষ্ঠা
৫। ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে’/ মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব
লেখক: একটিভিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ফিচার মানবকল্যাণে উৎসর্গিত প্রাণ নূতন চন্দ্র সিংহ মুক্তিযুদ্ধ রহমান রা'আদ