কেমন ছিল একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিকেল
১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:৪৪
সেদিনও সন্ধ্যা নেমেছিল বহু বছরের প্রাচীন নগরী ঢাকার বুকে। তবে সেদিনের সন্ধ্যা ছিলো অন্যদিনের চাইতে কিছু আলাদা। পৃথিবীর বুকে ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম যে তখন সময়ের ব্যাপার। যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর ঢাকা তখন থমথমে। শহরের আশেপাশে কোথাও থেমে-থেমে যুদ্ধও চলছিল, এমনকি শহরের প্রাণকেন্দ্রেও চলছিল বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ। এমন পরিবেশের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৫টা ২৫ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ‘ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। এরপরই মুক্তিযোদ্ধারা শহরের পথে-পথে আকাশে রাইফেলের ফাঁকা গুলিতে প্রকম্পিত করে স্লোগান তোলেন—‘জয় বাংলা’। সন্ধ্যার পর থেকেই থমথমে ঢাকা তখন বিজয় উৎসবের নগরী। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিবাদে বেরিয়ে আসে পথে। রাতভর আলো জ্বলে নির্ঘুম ঢাকা নগরীর ঘরে-ঘরে।
কেমন ছিল ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার চিত্র? প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপে, আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা গ্রন্থে পাওয়া যায় এর নানা বিবরণ। তাদের ভাষ্যে এসেছে, সেদিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সড়কে তরুণ-যুবা আর উৎসুক মানুষের ভিড় লেগে ছিল। সকাল সাড়ে ১০টার পর সাভার-মিরপুর সড়ক দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী বিপুল করতালি, আর জয়বাংলা জয়োচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। পথে-পথে মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর বিজয় উদযাপনের প্রধান সঙ্গী। একদিকে পারস্পরিক জয়োচ্ছ্বাস, অপরদিকে হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানোর প্রস্তুতি।
যৌথ বাহিনীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আত্মসমর্পণের দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ লে. জে. জে এফ আর জেকব। ভারত থেকে যশোরে হেলিকপ্টার পরিবর্তন করে ঢাকা এয়ারফিল্ডে আসেন। সেখান থেকে তিনি, ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকী, কর্নেল এম এস খারা নিয়াজির হেডকোয়ার্টার্সের উদ্দেশে রওনা দেন। তারা দুপুর একটা নাগাদ পাকিস্তানি আর্মির হেডকোয়ার্টারে পৌঁছান। এরপর আত্মসমর্পণের আনুষঙ্গিক কার্যক্রম গোছাতে শুরু করেন জেকব। ‘আমি নিয়াজির অফিসে ফিরে এলে কর্নেল খারা আত্মসমপর্ণের শর্তাবলি পাঠ করে শোনান। নিয়াজির চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঘরে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা।’ জে এফ আর জেকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ গ্রন্থে লিখেছেন এভাবেই।
হানাদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান নিয়াজির হেডকোয়ার্টার্সে পিনপতন নীরবতা থাকলেও বাইরের পরিবেশ ছিল তার উল্টো। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ঢুকছেন শহরে, পথে-পথে মানুষের ভিড় আর আনন্দ উল্লাস। একইসঙ্গে প্রতীক্ষা আত্মসমর্পণেরও।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুকুল বোস যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ফেরেন। ৫০ বছর আগে ঢাকা শহরের বিজয়ের সেই দৃশ্য এখনও তার স্মৃতিতে সজীব। তিনি বলছিলেন, ‘আমি যুদ্ধশেষে ১৬ ডিসেম্বরই ঢাকায় ফিরে আসি। শহরে ঢুকেই সবার মধ্যে আনন্দ, মিছিল আর উৎসব দেখি। পুরো ঢাকায় মিছিল হচ্ছে, মিটিং হচ্ছে। স্লোগান হচ্ছে। যার-যার সামর্থ্য অনুযায়ী আনন্দ উদযাপন করছে।’
সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান তার ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১০.৪০ মিনিটে মিত্র বাহিনী ঢাকা প্রবেশ করে। মোহাম্মদ হান্নান রচিত ‘ঢাকার রাজনৈতিক ইতিহাস’ গ্রন্থের তথ্য, ‘১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় মেজর জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী সাভার-মিরপুর সড়ক দিয়ে বিপুল করতালি ও মুহুর্মুহু জয় বাংলা ধ্বনির মধ্য দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। জেনারেল নাগরার সঙ্গে ছিল মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ-দল। এর আগে সকাল ৮.৩০ মিনিটে জেনারেল নাগরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় নায়ক জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির কাছে একটি চিঠি পাঠান। এতে দ্রুত পাকিস্তানি বাহিনীকে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।’
‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ গ্রন্থে জে এফ আর জেকব আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে লিখছেন, ‘গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর অরোরা ও নিয়াজি টেবিলের দিকে এগিয়ে যান। অরোরার নিয়ে আসা আত্মসমর্পণের দলিল টেবিলের ওপরে রাখা হয়। নিয়াজি সেটার ওপরে কৌতূহলী চোখ বুলিয়ে নিয়ে সই করেন। অরোরাও সই করেন। … ঘড়ির দিকে চোখ (ভারতীয় সময়) ফেলে দেখি, সময় বিকাল চারটা ৫৫ মিনিট। এরপর নিয়াজি তার কাঁধ থেকে অ্যাপলেট (সেনা ধিনায়কদের সম্মানসূচক ব্যাজ) খুলে ফেলেন এবং ল্যানিয়াড (ছোট দড়ি বিশেষ) সহ পয়েন্ট ৩৮ রিভলভার অরোরার হাতে ন্যস্ত করেন। তার চোখে অশ্রু দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতা তখন নিয়াজিবিরোধী ও পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান ও গালিগালাজ দিতে থাকে।’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তৎকালীন ছাত্রনেতা মুকুল বোসের ভাষ্য, ‘ঢাকার সারা শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো বাজছে। শহরজুড়ে আনন্দ আর আনন্দ। কেউ-কেউ মিষ্টিও দিচ্ছে ঘরে-ঘরে।’
সারাবাংলা/এজেডএস