Tuesday 17 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিস্মৃত এক বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজিয়া বেগম কমলা

জয়িতা শিল্পী
১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:৩৯ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:৪১

বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজিয়া বেগম কমলা

ময়মনসিংহ অঞ্চলের যে কয়েকজন বীরাঙ্গনা মায়ের সাথে আলাপচারিতা ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম সাহসী রেজিয়া বেগম কমলা। তাকে অনেকে কমলা বেগম বলেও চেনেন। সরাসরি কথা বলতে গিয়ে বোঝা যায় রেজিয়া বেগম কমলা প্রকৃতই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার জন্ম তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জে হাওড় এলাকায়। আবহাওয়াগত কারণে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় এ অঞ্চলের মানুষদের। বোধ হয় এ সকল কারণে রেজিয়া বেগম কমলার অসীম সাহস। তার পিতার নাম মো. আব্দুল আজিজ এবং মায়ের নাম আনেছা খাতুন। দুই বোন ও এক ভাইয়ের সংসারে তিনি ছিলে সবার ছোট। তাই বাবা-মায়ের আদরের সন্তান ছিলেন। সংসারেও টানাটানি থাকার পরেও রেজিয়া বেগম বাবা-মায়ের তত্বাবধানে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছেন মনোযোগের সাথে। ছোট বেলা থেকেই সাহসী এবং মেধাবী ছিলেন তিন।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতায় সবকিছু ওলট পালট হয়ে যায় রেজিয়া বেগমের। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন যুবতী। বাবা তাকে এ বাড়ি ও বাড়ি লুকিয়ে লুকিয়ে রাখতেন। তার বড় ভাই ও বোনকে নিয়েও দুশ্চিন্তা কম ছিলনা। তার উপর তিনি ছোটবেলা থেকেই দেখতে সুন্দরী ছিলেন। যুবতী নারীদের প্রতি পাক হানাদারদের ঝোঁক ছিল বেশি। রাজাকাররা তাদেরকে ধরে নিয়ে পাক বাহিনীর ক্যাম্পগুলোতে সরবরাহ করার কাজটিই করতো।

বিজ্ঞাপন

রেজিয়ার বাবা খেয়াল করলেন তার মেয়েদের প্রতি অন্যদের নজর পড়েছে। তখন তার বড় বোনকে বিয়ে দিয়ে দেন। একদিন রাজাকার বাহিনীর লোক তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন মেয়েরা কোথায়? তিনি উত্তরে বলেন মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বাস্তবে তখনও রেজিয়ার বিয়ে হয়নি। কিন্তু ভয়ে তিনি মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য ছিলেন। আর মনে মনে ভাবতে থাকলেন রেজিয়াকে আর ঘরে রাখা যাবে না। তাকেও দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। তাই একদিন হঠাৎ করে রেজিয়াকে এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন। তুলে দেন তিনি। দেখে শুনে পছন্দের পাত্র খুঁজে মেয়ে বিয়ে দিবেন সেটা পারেননি তিনি। রেজিয়া তার চেহারাও দেখেনি ভাল করে। কে তার স্বামী তা সে বলতে পারেনা।

১২ নভেম্বর, ২০২০। হঠাৎ করেই সুযোগ হয় রেজিয়া বেগমের সাথে দেখা করার। সরাসরি সাক্ষাতের অনুমতি নিয়ে চলে যাই তার কাছে। যখন যেভাবে মনে পড়ছে সেভাবেই বলে যাচ্ছেন স্মৃতি থেকে। তিনি কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ক্যাম্পে থেকেছেন, পাক বাহিনীর অত্যাচার থেকে কিভাবে রেহাই পেয়েছেন সব যেন এখনো স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু হরেন কমলা─

“পাক বাহিনীগোর আমি ধরছি। তারারে আমি থাপা মাইরা ধরছি, আমারে যখন নির্যাতন করছিল। একজনের কান্দের ফুলডা ছিইড়া গেছে। তহন যে মাইর শুরু করল। আমি কইলাম আমরা কী অন্যায় করছি, আমরাতো কোনো অন্যায় করিনাই। বিরাট মারছে। দুইডা হাতই ভাইঙ্গা দিছে। কত কী করছে তারা। কত মাইয়ার জীবন নষ্ট করছে!”

বললাম, মা আপনি বলেন। এগুলো আমাদের অহংকারের কথা। আমাদের গর্বের কথা। আপনাদের ত্যাগের জন্যই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সকলের জানা উচিত। উত্তরে রেজিয়া বেগম কমলা বললেন─

“অনেকেই তো দাম দেয় না। কোন সম্মান করে না। ভাল-মন্দ কেউ জানতে চায়না। কিন্তু আমি সব জায়গায় সত্য কথা বলি। আমারে একজন মুক্তিযোদ্ধা কিছু বই দেয়। আমি বাড়ি বাড়ি স্কুলে বই বিলাই। মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সাথে কাজ করি। অফিসে যাই। অফিস ঘর পরিষ্কার করি। চা বানাই। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি। মুক্তিযুদ্ধের বইগুলো বিলাই আর সবাইকে পড়তে বলি। দেশের জন্য কাজ করতে বলি। এটাই আনন্দ। আমি অনেক মিটিং-এ গেছি। রাজাকারের বিচার চাইছি।

একদিন ঢাকা যাদুঘরে গেছিলাম। একজন বিদেশী আইলো, সে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মিশছেন। সে একটি সিনেমা করতে চায়। বিদেশী আমারে সিলেক্ট করে। আমি তহন অসুস্থ। তার পরেও আমারে অভিনয় করতে বলে। আমার মাথার চুল নাই। একটা কেমোথেরাপি দিয়ে মাথার সব চুল পড়ে গেছে। আমি কেমনে আপনার সাথে অভিনয় করি। তহন সে কইল আপনে যেমনে পারেন চেয়ারে বইসা হইলেও আমার সাথে অভিনয় করতে হবে। আমি এইটা বিদেশে দেখাব। পরে যতখানি অভিনয় দেখিয়ে দেয় সবটুকু অভিনয় আমি করি। সেই সিনেমাটা মুক্তিযুদ্ধের উপর ছিল।”

আবার পরিবারের কথা বলতে শুরু করেন রেজিয়া বেগম কমলা। যেন এই সেদিনের কথা । শুনতে চাইলে রেজিয়া বেগম খুবই আগ্রহ সহকারে বলতে থাকেন─ আমার বাবা কৃষক মানুষ, গৃহস্থি করত। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বড় ভাই আছিল। বড় একজন বোন আছিল। আমার বয়স তখন চৌদ্দ কি পনের। আমি নির্যাতনের শিকার হইতাম না। আমার বাবা যুদ্ধের বছর বড় বোনকে বিয়া দিল এক জায়গায়। রাজাকারগো আমাগোর দুই বোনের প্রতি নজর আছিল। ঝাউতলা বাজারে একদিন বাবাকে রাজাকাররা কয় তোমার ঘরে দুইডা মাইয়া আছে, আমগোর এট্টা দিয়া দাও। নাইলে গরু দেওয়ন লাগব। আর দশ মন চাইল দেওয়ন লাগব। তহন আমার বাবা কইল আমার মাইয়াগো আমি বিয়া দিয়া দিছি।

রেজিয়া বেগমের ভাষ্য, বাবা আমাকে বাঁচানোর জন্য রাজাকারদের কাছে মিথ্যা কথা বলে। বাবা বলে এক ছেলে আসে। আমি বাড়ি ঘর চিনি না। মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে গেছে। রাজাকাররা ঝাউতলা বাজারে আমার বাবাকে অনেক মারে। রাতে এসে আমাদের একটা গরু নিয়ে যায়। চাল দেওয়ার জন্য মারধর করে। তখন আমরা করিমগঞ্জে, আমাদের বাড়িতে। বাড়ির পাশেই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পের কাছেই এক ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেয় আমার বাবা। ছেলেরা ছয় ভাই ছিল। তার বাবাসহ সকলে যুদ্ধে চলে যায়। আমি আমার স্বামীকে চিনি না। বাবা তাদেরকে বলে আমি তোমাদের দশ কাঠা জমি দিব। তোমরা আমার মেয়েটাকে দেখে শুনে রাখবে। এই বলে রাতারাতি বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দিল। দেশ স্বাধীন হলে বাবার দেওয়া জমি নিয়ে আমরা চাষবাস করে খাবো এই আশায় বাবা ঐ পরিস্থিতিতে তাড়াহুড়া করে অচেনা ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের পর স্বামীসহ সবাই যুদ্ধে চলে যায়। কোথায় যায় তাও আমি জানি না। আমি তখন শ্বশুড়বাড়ি। একদিন দুপুরে আমার শাশুড়ী আরেকজন ভাবী নামাজ পড়ছিলেন। হঠাৎ গুলাগুলি শুরু হয়। আমার ওই ভাবীর বুকে গুলি লাগে। তাই দেখে আমার শাশুড়ী বললেন, মা তুমি যে বাড়ির মেয়ে সেই বাড়িতে দিয়ে আসি। তোমার চোখের সামনে গুলি খেয়ে একজন মরে গেল। তোমার আমার মরতে সময় লাগবেনা। তার চেয়ে ভাল তুমি তোমার বাপের বাড়ী চলে যাও।

শ্বশুড়বাড়ি ও বাপের বাড়ীর মাঝখানে পাকবাহিনীর ক্যাম্প। আমার শাশুড়ি আমাকে নিয়ে বাপের বাড়ি রওয়ানা দিলেন। রাস্তার মাঝেই গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। আমরা একটি বাড়ির আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। পাশেই পাটক্ষেত। পাটক্ষেতের ভিতরে একটি জঙ্গলের পথ ধরে আমরা নামলাম। হঠাৎ একটা বাঁশের ঝাড়ে আমার চুল আটকে গেল। আমি চুল ছাড়িয়ে দেখলাম আমার শাশুড়ি কোথাও নাই। কোথাও শাশুড়িকে খুঁজে পেলাম না। আমি কান্না করতে করতে একটা রাস্তা ধরে হাঁঠতে থাকলাম। ঐসময় কোন একটা ছেলে রোগা মত দেখতে আমাকে বলল, তুমি কোথায় যাও। বললাম আমি শ্বশুড় বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাচ্ছি। ইউসুফ প্রধানের বাড়ি। আমার ছোট চাচার নাম নিয়ে আমাদের বাড়ির কথা বললাম। ছেলেটি বলল, আমার সাথে চল। আমি তোমাকে তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দেই। আসলে ওই ছেলেটি রাজাকার ছিল। যে রাস্তা দিয়ে আমাকে সে নিয়ে যায় ওটা আমাদের বাড়ির রাস্তা ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর অন্য রাস্তা দিয়ে আমাকে পাক বাহিনীর ক্যাম্পের মধ্যে ঢুকায়। আমি বুঝলাম এটা আমাদের বাড়ি না। আমাদের বাড়িতে লাইট জ্বলে না। কুপি বাতি জ্বলে। এটাতো আমাদের বাড়ি না। ভাই তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে আসলা। ছেলেটি আমাকে বলে─এটাই তোমাদের বাড়ী। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি পাক বাহিনীর লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। পোশাক পড়া, সবার হাতে অস্ত্র। তখন ঐ ছেলেটাকে আমি ঝাপটে ধরি। বলি আমাকে তুমি কেন এখানে এনেছ। আমার শরীরটা কাঁপতে থাকে। সে কোন কথা বলে না। পাক বাহিনীর লোকগুলো একজনের পর একজন এগিয়ে আসে। সবাই হাসাহাসি করতে থাকে। ইংরেজী ভাষায় কি সব বলে। রেজিয়া বেগম প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে বলল─

তাদের মধ্যে একজন আমার গাল ধইরা কইলো খুব সুন্দর, খুব সুন্দর, ফুল, ফুল। এই কথাডা আমি বুঝতে পারলাম। তহন আর কিছুই কই নাই। একজন মাথার উড়ানাটা টান দিয়া নিয়া গেল। পড়নের কাপড়টা টান মাইরা খুলল। আহারে যহন টান মাইরা কাপড়াটা খুলল, আমার খুব রাগ হইল। কইলাম আমরা কী দোষ করছি। আমরাতো কিছু করিনাই। তহন আমিও হেরে সাহস কইরা ঝাবড়াইয়া ধইরা রাখছি। মনে মনে কইলাম এমনেও মরমু ওমনেও মরমু। মারার মত কিছু থাকলে তহনেই মাইরা ফেলতাম। কথা বলতে গিয়ে রেজিয়া বেগম যেন আবার প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। মনে পড়ে গেল সব দুঃসহ স্মৃতি।

দেখলাম আরও অনেক মহিলা আছে। সবাই কান্না করছে। সবার চোখে জল। পাক বাহিনীর সদস্যরা বড় গামলার ভিতর ভাত আর গরুর গোশত দিয়ে খাবার দিয়েছে। জোর করে সবাইকে খেতে বাধ্য করছে। যে খাচ্ছে না তাকে লাথি মারছে। কারো পড়নে কাপড় নাই। কারো মুখে খাবার তোলার পরিস্থিতি নাই। বুট দিয়ে লাথি মারে। কেউ ভাত মুখে দেয়, কেউ দেয়না। আর রাজাকার যারা আছে তারা মজা দেখছে আর হাসছে তো হাসছেই।

রেজিয়া বেগম কমলা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলেন।

দেশ স্বাধীন হবার পর আমি আমার বাবার বাড়ি গেছিলাম। তারা ( রেজিয়া বেগমের পরিবারের লোকজন) আমারে কেউ মাইন্যা নেয় নাই। আমি হালুয়াঘাট থাইক্যা ময়মনসিংহ আইছি। ময়মনসিংহ থাইক্যা বাড়িতে গেছি। তারা আমারে মনে নাই। তবে আমাদের গ্রামে দেশ স্বাধীনের পর কয়েকজন রাজাকারকে বাইড়াইয়া (পিটিয়ে) মাইরা ফেলছে। গাছের মধ্যে বাইন্দা ইট দিয়া বাইরাইয়া মাইরা ফেলছে। তবে তারা আমারে পাত্তা দেয় নাই। বলছে আমারে বিষ খাওয়াইয়া মাইরা ফেলবে। গ্রামে থাকতে দিবে না। তাইলে হেগুর ইজ্জত থাকবো না। তখন আমার মা আরেকটা ভাবি আমারে বাঁচাইয়া দিল। একটা খাল দিয়া আমারে পার কইরা দিল। কইল তুমি যেদিক পার চইলা যাইবা, যে দেশে পার যাও।

আমি একটা বাসায় আসলাম। কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের পাশে একটি বাসায় উঠলাম। দুই তিন দিন কাজ করলাম। তারা আমাকে ভাত দেয় না। সারাদিন কাজ করার পর ভাংতি পয়সা দেয়। বলে তুমি হোটেলে গিয়ে ভাত খাও। আর রাতে অন্য কোথাও গিয়ে থাক। আমি বলি কোথায় গিয়ে থাকবো। আর আমি তো কোন হোটেল চিনি না। কোথায় গিয়ে খাব। এর পর কত কিছু হলো। কত যায়গায় থাকলাম, কত কিছু করলাম। তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। কোন আশ্রয় নাই, কোন ট্রেন গাড়ী নাই। মানুষ কোন দিকে যায়না। সব মানুষ গরিব। সব মানুষেরেই ভাতের কষ্ট। কেউ একমুঠ ভাত, কাপড় দিবে তার উপায় নাই। এরকম অবস্থায় আল্লার সাথে যুদ্ধ করে এতদিন বেঁচে আছি। আর কতদিন বাঁচবো জানি না।

কমলা বেগম আবার নতুন করে ক্যাম্পের গল্প শুরু করলেন─

ক্যাম্পে আমারে আটকাইয়া রাখছিল কয়েকদিন। ছেলেডার নামডা মনে পড়তেছে না। কাদের না কি যেন। আমি ক্যাম্পে আটকা, কিছু করার নাই। একদিন দেখলাম ছেলেটা পাক বাহিনীর লোকেদের কতগুলো কাপড় সাবান দিয়ে ভিজায়। সামনে একটা পাগাড় আছে। আরেকটা তিল ক্ষেত। সে কাপড় ধুইতে যায়। আমি মনে মনে সুযোগ খুঁজতে থাকি, কেমনে পালাবো। তারে কইলাম, আমারে তোমার লগে লইয়া লও। আমি কাপড়গুলা ধুইয়া দেই। ছেলেডা আমারে কইল, পাক বাহিনীর লোকেরা তোমার সাথে খারাপ কাজ করবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবতে থাকি। কিভাবে এই ক্যাম্প থেকে বের হবো। কাপড় কাচার উছিলায় যদি ক্যাম্প থেকে বের হওয়া যায়।

ছোট বেলা থেকেই আমার মাথায় বুদ্ধি ছিল আর সাহসও ছিল। ছেলেটা আমাকে আবারও বলল- পাক বাহিনীর লোকেরা তিল ক্ষেতে নিয়া তোমার সাথে খারাপ কাজ করবে। আমি কিছু বলিনা। মনে মনে সাহস করি। কিভাবে এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আমাকে চুপচাপ এগিয়ে যেতে বলে। পাক বাহিনীর একজন আমাকে বলে এই দাঁড়াও, আমার শরীর কাঁপতে থাকে। তবু মনের সাহস রাখি। মাথা গুঁজে বসে থাকি। একসময় গড়িয়ে গড়িয়ে খালের মধ্যে পড়ে যাই। খালে তখন প্রচুর কচুরীপানা। কচুরিপানা দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলি। খানিক পরে তারা আমাকে খুঁজে পায়না। খুব রাগ হয়। চারপাশ থেকে গুলি করতে থাকে। পানি নড়ে তবু আমি নড়ি না। আমাকে না দেখতে পেয়ে তাদের মাথা ঠিক নাই। দুই আড়াই ঘণ্টা একটানা গুলি করতে থাকে। আমি ততক্ষন পানির ভিতরে কচুরিপানা নিয়ে ডুবে আছি। বাঁচি কি বা মরি জানি না। কিন্তু পাক বাহিনীর লোকের কাছ থেকে ইজ্জত বাঁচাতে হবে। ঠাণ্ডা পানিতে দীর্ঘক্ষণ ডুবে থাকতে থাকতে শরীর হিম হয়ে যায়। গোলাগুলির শব্দ বন্ধ হলে অনেক কষ্টে একটি বাঁশের কঞ্চি ধরে পানি থেকে উঠে আসি। কাঁদার মধ্য থেকে বহু কষ্টে একটি রাস্তা ধরে আগাই। কোথাও কেউ নাই। কোথায় যাব জানি না। কিছুদূর এগিয়ে একটা বাড়ি দেখতে পেয়ে সেখানে ঢুকলাম। এক ভদ্রমহিলাকে পেলাম। বললাম মা আমাকে একখানা কাপড় দেন। তিনি বললেন তুমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাও। আমার ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে। যেকোন সময় পাকবাহিনী বাড়িতে এসে পড়বো।

লেখকের সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজিয়া বেগম কমলা

লেখকের সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজিয়া বেগম কমলা

আমার শরীরটা ভেজা, আমাকে উনি কাপড় দিতে চাইলেন না। আমি জোর করে তার কাছ থেকে একটি পুরুনো লুঙ্গি চেয়ে নেই। সেটা পড়ে শরীলটা মুছে ঠাণ্ডা থেকে রেহাই পেতে চেষ্টা করি। এর মধ্যে আযান দিল। আমি আবার বের হয়ে গেলাম। এরপর হাঁটতে হাঁটতে হালুয়াঘাট কড়ইতলা পৌঁছালাম। সেখানে যাওয়ার পর আমার পেটে ক্ষুধা, শরীরটা প্রচণ্ড খারাপ। দুই পা ফুলে গেছে। পুরো শরীর ব্যাথায় টনটন করছে। আমি হঠাৎ মাটিতে পড়ে যাই। সেই সময় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আমাকে দেখে বলে মা তোমার বাড়ি কোথায়? তুমি কোথা থেকে এসেছ? বললাম আমার বাড়ি করিমগঞ্জ। আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কিভাবে এইখানে আসলে? উত্তরে বললাম কিছু হিন্দু মহিলা আমার সাথে ছিল। তাদের সাথেই আমি এখানে এসেছি। তারা ভারতে গেছে। আমাকে এখানে রেখে গেছে। আমাকে তারা কিছু মুড়ি খেতে দেয়। আরেকটা কলা। তাই খেয়ে আমি শরীলে কিছুটা জোর পাই। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে থাকি। তাদেরকে বলি, বাজান আমিতো ভারতে যাইতে পারবাম না, আমারে তোমগোর লগে রাখো। তোমগোর কাজ কাম কইরা দিবাম। তারা রাজি হয়ে গেল। আমারে তাদের সাথে থাকতে দিল। আমার সবকিছু জেনে আমাকে ঔষধপত্র খাওয়ালো। এরপর তাদের সাথে আমি কালাপাহাড়ে কিছুদিন ছিলাম। কালাপাহাড়ে একটা স্কুল আছে। সেখানে তারা ট্রেনিং করলো। খাওয়ার ব্যবস্থা দুপুরে শুধু খিচুড়ি। দিনে একবার। আর কিছু না। ঐ ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হালুয়াঘাট আসলাম। সেখান থেকে ফুলপুর তারাকান্দা হয়ে আমাকে তারা ময়মনসিংহ দিয়ে গেল। বেগুনবাড়ী রেখে যায় আমাকে। রেল লাইনের পাশে। সেখানে দেখি কিছুই নাই। থাকার কোন জায়গা নাই, আশ্রয় দেওয়ার কেউ নাই, জীবনের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। রেললাইনের পাশে শুয়ে থাকি। রেললাইনের বাজারে ঘোরাফেরা করে চেয়ে চিনতে কিছু খাই। এইভাবে দিন কাটে। কত কষ্টে সেই দিনগুলা কেটেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। একদিন কিছু খেতে পেলে দুই তিন দিন কিছু খাইনি। চারদিকে মানুষ, কিন্তু খাবার নেই। রেললাইনের পাশে শুয়ে আছে। আমার সাথে আরও মহিলারা ছিল। সবারই আমার মত অবস্থা। কারোর পরিবার নাই, কোন ঠিকানা নাই।

এভাবেই দিন চলে যায়। কাজ করে পরিশ্রম করে যেভাবে পারি দিন চালাই। শরীরটা আগের চেয়ে একটু ভাল। মানুষের বাসায় এখানে সেখানে কাজ করে খাবার জুটে। তখন এক এতিমখানার কেরানী আমাকে বিয়ে করে। তাও স্বাধীনতার অনেক পরে। সে সময় দুইজন মিলে কাজ করে খেতে পারি। এরপর আমার দুটা ছেলে হলো। দুই ছেলে রেখে আমার স্বামী মারা গেলেন। এগারো বছর ঘর সংসার করেছি। তারপরে এই দুই ছেলে নিয়ে আমি আবার আমার মত চলি। বলার কিছুই নাই। দুঃখে দুঃখে আমার দিন কেটেছে। এখন আর কিছুই বলতে চাইনা। আমার বড় ছেলে আবু হানিফ আর ছোট ছেলে আবুল কায়সার মানিক। আমার স্বামীর নাম আবুল কাশেম। আমার ছেলেরা আমাকে ভালবাসে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম উঠেছে পাঁচ ছয় বছর। এখন ভাতা পাই। ছেলেদের একটা অটো কিনে দিয়েছি। দুই ভাই মিলে চালায়। কষ্টে সৃষ্টে জীবন চলে। এই আমার কথা।

তবু কথা যেন শেষ হয় না। মনের স্মৃতি থেকে আবার বলতে থাকেন রেজিয়া বেগম─

আমাদের গ্রামে বালিয়া স্কুলে পাক বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। যুদ্ধের পর বালিয়া ক্যাম্পে ১৭ জন রাজাকারকে একসাথে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা মেরে ফেলে। তাদের এলাকায় অনেক রাজাকার ছিল। করিমগঞ্জ বাজারে একদিন মিটিং হয়। সেখানে একদিন গেলাম। আমাদের গ্রামের সেই রাজাকারের ছেলেরা এখন মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় নাম পাওয়া যায়। আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখাতে পারবো। কিন্তু আমার কথা কে শোনে।

রেজিয়া বেগম এখনও মনের জোড়ে চলেন। শরীরটা ভেঙ্গে গেছে। এরই মাঝে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। একবার কেমোথেরাপি দেয়া হয়। পরে তিনি কেমো দিতে চাননি। তার মনে এত জোড় তিনি মনে করেন তিনি এমনিতেই ভালো হয়ে যাবেন। তিনি এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে মনের জমানো কথা সবাইকে বলতে পারেন না। কেউ শোনেন না তার কথা। তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েন।

রেজিয়া বেগম কমলার প্রাপ্তিও কম নয়। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা এএসপি মনোয়ারা বেগমের সাথে ২০ দিনের একটি সফরে কম্বোডিয়া গিয়েছিলেন। জাতিসংঘের কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তোলা সেটি অনেক বড় কাজ বলে মনে করেন তিনি। তার ইচ্ছা যত দিন বেঁচে থাকবেন মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলে যাবেন। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্য কাজ করে যাবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জীবন বাজী রেখে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিয়েছেন এজন্য তার নিকট চিরকৃতজ্ঞ তিনি।

লেখক: পুলিশ সুপার, উপ-পরিচালক (র‌্যাব)

সারাবাংলা/এজেডএস

জয়িতা শিল্পী রেজিয়া বেগম কমলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর