Tuesday 03 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেমন ছিল একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর?

ফিচার ডেস্ক
১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:২৫ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:২৭

একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর, দিনটি ছিল বুধবার। কনকনে শীতের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধকর চরম উৎকণ্ঠার একটি দিন। মিত্র-মুক্তিবাহিনী চারিদিক দিয়ে ঢাকাকে ঘেরাও করে রেখেছে। পালাবার কোনো পথ নেই, অবরুদ্ধ ঢাকা অচল, নিথর, থমথমে হয়ে পড়েছে। ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিভিন্ন সামরিক স্থাপনার ওপর মিত্রবাহিনীর মিগ-২১ বিমানের বোমাবর্ষণে পাকিস্তানিরা বিধ্বস্ত। বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি কখন আসবে!

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা, বিশেষ করে অবরুদ্ধ ঢাকাবাসীদের নানা উৎকণ্ঠায় মনের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন— মার্কিন সপ্তম নৌবহর কি আসবে? এলে কী হবে? নিয়াজি কি সত্যিই সারেন্ডারের করবে? নাকি সপ্তম নৌবহরের অপেক্ষায় সারেন্ডারের কথা বলে কালক্ষেপণ করছেন? চীন কি পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য বা সমর্থন করার জন্য এগিয়ে আসবে? নাকি জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির জন্য নাটকীয় কিছু ঘটে যাবে? নাকি ঢাকার অবস্থা বার্লিন হবে?

বিজ্ঞাপন

দেশবাসী আর অবরুদ্ধ ঢাকাবাসীর ভরসা তখন বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী আর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে এম আর আখতার মুকুল পাঠ করছেন উত্তেজনাময় ‘চরমপত্র’, আর বাজানো হচ্ছে রক্তগরম করা দেশাত্মবোধক বিজয়ের গান ও বিজয়ের রণসঙ্গীত—

‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের/ শ্মশান করেছে কে,/ এহিয়া তোমায় আসামীর মত/ জবাব দিতেই হবে।।/ শ্যামল বরণ সোনালি ফসলে/ ছিল যে সেদিন ভরা/ নদী নির্ঝরে সদা বয়ে যেত/ পূত অমৃত ধারা/ অগ্নিদহনে সে সুখ স্বপ্ন/ দগ্ধ করেছে কে।।/ আমরা চেয়েছি ক্ষুধার অন্ন/ একটি স্নেহের নীড়/ নগদ পাওনা হিসেব কষিয়া/ ছিলনা লোভের ভিড়।/ দেশের মাটিতে আমরা ফলাব/ ফসলের কাঁচা সোনা/ চিরদিন তুমি নিয়ে যাবে কেড়ে/ হায় রে উন্মাদনা/ এই বাঙালির বুকের রক্তে/ বন্যা বহালো কে।।’

[গানটির কথা লিখেছেন মকছেদ আলী খান, সুর মুহ. আবদুল জব্বার]

এদিকে, দুইটি ভাগে ভাগ হয়ে মার্কিন নৌবহর এগিয়ে যাচ্ছে- বঙ্গোপসাগরে অনুপ্রবেশকারী মার্কিন সপ্তম নৌবহরে রয়েছে এই বহরে আটটি যুদ্ধ জাহাজ রয়েছে। এর একটির নাম ‘ত্রিপলী’, এতে আছে ২৩টি হেলিকপ্টর। আজ বিবিসি ও রেডিও অস্ট্রেলিয়ার খবরে বলা হয়, ভারত মহাসাগরের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাধুনিক আণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ নৌবহরের দুইটি ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ জাপান সাগর অতিক্রম করে দ্রুতগতিতে ভারত মহাসাগরের দিকে ছুটে আসছে। এই বহর ভারত মহাসাগরে অপেক্ষমাণ সোভিয়েত নৌবহরের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং বঙ্গোপসাগরে মিলিত হবে। চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি।

বঙ্গোপসাগরে রওনা দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর যখন বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২৪ ঘণ্টার দূরত্বে গভীর সমুদ্রে এসে অবস্থান করছিল, তখন ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় ১৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান নেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে। ফলে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত সপ্তম নৌবহর সাহায্যটুকু পাওয়ার যে আশা করেছিল, তা নিরাশায় পরিণত হয়।

পরদিন, অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী যদি নিঃশর্তে নিকটস্থ ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ ও পূর্ণ অস্ত্র সম্বরণ না করে, তবে তার পরে আর কোনো সময় দেওয়া হবে না— যৌথবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশের আদেশ। ভারতীয় বাহিনীর কাছে কিংবা মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হবে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও একই ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার জেনারেল নিয়াজির সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।

বার্মা দিয়ে পালাতে চেয়েও পালানোর পথ ফাঁস হয়ে যাওয়াতে মিত্র বাহিনী সেটাও বন্ধ করে দেয় এবং ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সকালে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে পাঠানো এক প্রস্তাবে নিয়াজী বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ বন্ধ করেছি। তবে বাংলাদেশে অবস্থানরত গোটা পাকবাহিনীকে চলে যেতে দিতে হবে, কাউকে গ্রেফতার করা চলবে না।’ ঢাকার মার্কিন দূতাবাস কর্মীরা দিল্লির মার্কিন দূতাবাসে সেই প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলে সেটি পাঠানো হয় ওয়াশিংটনে। ওয়াশিংটন নিয়াজীর এই প্রস্তাব নিয়ে দূতিয়ালি করতে গেলে সেটিকে সাময়িক যুদ্ধবিরতির কৌশল মনে করে ভারত সরকার নাকচ করে দেয়।

নিয়াজীর প্রস্তাবের জবাবে ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ জানান, শর্তহীন আত্মসমর্পণ করতে হবে। পরদিন (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) সকাল ৯টার মধ্যে বেতারে জানাতে হবে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করছেন কিনা। তবে আন্তরিকতার নিদর্শন হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখতে হবে বলে পাকিস্তানি জেনারেলকে জানান মিত্রবাহিনী প্রধান। এ সময় হানাদার বাহিনীকে হুঁশিয়ারি দিয়ে আরও জানানো হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা থেকে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ করা ছাড়া মিত্রবাহিনীর কোনো গত্যন্তর থাকবে না।

বিষয়টি জেনারেল নিয়াজী তাৎক্ষণিকভাবে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান হেডকোয়ার্টারকে অবহিত করেন। তখনও জেনারেল নিয়াজি মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সাহায্যের আশা করছিলেন এবং প্রহর গুণছিলেন। কিন্তু নিয়াজি যখন বুঝতে সক্ষম হন মার্কিন সপ্তম নৌবহর তার কোনো কাজে আসবে না, তখন আত্মসমর্পণের বিষয়ে অগ্রসর হন।

এদিকে, ১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভারতীয় তথা মিত্রবাহিনীর দু’টি বিমান থেকে ঢাকায় প্রচারপত্র ছাড়া হয়। প্রচারপত্রে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক কমান্ডকে উদ্দেশ করে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। গভীর রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় অবস্থানরত জেনারেল নিয়াজীকে নির্দেশ দেন, ভারতের সেনাপ্রধান পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছেন, তা মেনে নেওয়া যেতে পারে।

১৫ ডিসেম্বরের রণাঙ্গনের সর্বশেষ খবর— ১৫ তারিখ সিলেট সম্পূর্ণ মুক্ত হয়, সিলেটে তখন উড়ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা- বিজয়োল্লাস করছে মুক্তিযোদ্ধারা এবং সিলেটের মানুষ জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় সিলেটের খাদেমনগর ছিল হানাদারদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি। মুক্তি-মিত্রবাহিনীর সাথে পাকিস্তানিদের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষের পর খাদেমনগর নিয়ন্ত্রণে আসে। চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী ও ফৌজদারহাটের কুমিরায় প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়।

এদিনই শত্রুমুক্ত হয় রাঙ্গুনিয়া। এ দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে করতে বগুড়া ছেড়ে পালিয়ে যায়। হানাদারমুক্ত হয় খাগড়াছড়ি, মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানিরা পালাবার আগে খাগড়াছড়ি বাজার লুটপাট করে।

এদিকে, মেঘনা নদীর পূর্বাঞ্চল সম্পূর্ণ মুক্ত হলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে চলছে জয়বাংলা বনাম জিন্দাবাদধারীদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘাঘটিয়া নামক স্থানে তিতাস নদীর তীরে একটি পাকা মসজিদে ঘেরাও করে রেখেছে। পাকিস্তানিদের সেখানে শক্ত অবস্থান। এই যুদ্ধে বাঞ্ছারামপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অনেক আগেই মুক্ত হয়ে যাওয়া হোমনা ও মুরাদনগর থানার কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাও যোগ দিয়েছেন। দুই পক্ষের প্রচণ্ড গোলাগুলিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে বাঞ্ছারামপুর-হোমনা এলাকার বিরাট এলাকা। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে থেকে বাংকারে বসে রেডিওতে সর্বশেষ শ্বাসরুদ্ধকর খরব শুনছি।

মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘাঁটি হানাদারমুক্ত করার যুদ্ধে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মহানন্দা নদী পার হয়ে যখন তিনি একের পর এক শত্রু বাংকার দখল করে জীবনের পরোয়া না করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ শত্রুর একটি গুলি বিদ্ধ হয় তার কপালে এবং তিনি শহীদ হন।

‘এস ফোর্স’-এর মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার বাসাবোতে পাকিস্তানি শক্ত অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। টঙ্গী, ডেমরা গোদনাইল ও নারায়ণগঞ্জে মিত্রবাহিনীর মর্টার-আর্টিলারি আত্রমণে দিশেহারা হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। এদিকে, মিত্র বাহিনীর সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী যোগ দিয়ে সাভার পেরিয়ে মিত্র-মুক্তিবাহিনী মিরপুরের গাবতলীর কাছাকাছি চলে এসে শক্ত অবস্থান নেয়। রাতে যৌথবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যের মুখোমুখি হয়। মিত্র-মুক্তিবাহিনী মিরপুর ব্রিজ দখলের জন্য প্রথমে কমান্ডো হামলা চালায় এবং দুই পক্ষেই সারারাত প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

কেমন ছিল একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর? ফিচার মুক্তিযুদ্ধ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর