Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পৈশাচিক নির্যাতনের স্বাক্ষী বংশীতলার মুক্তিযোদ্ধা রাবেয়া

রহমান মুস্তাফিজ
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৫:১৯

বিজয়ের একান্ন বছর পরেও কুষ্টিয়ার বংশীতলা যুদ্ধ স্থানীয়দের কাছে স্মৃতিতে অম্লান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই যুদ্ধ একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। একাত্তরের ৫ সেপ্টেম্বরের সেই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীর ৯ জন অকুতোভয় বীর যোদ্ধা। আর মুক্তিসেনাদের সহায়তার ‘অপরাধে’ বর্বর পাকিস্তানি হানাদাররা লাঞ্ছিত করে স্থানীয় নারীদের। জ্বালিয়ে দেয় অনেক ঘরবাড়ি।

একাত্তরের টালমাটাল সেই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আসে ভোরে পাকিস্তানি কনভয় যাবে বংশীতলার রাস্তা দিয়ে। খবর পেয়ে অ্যামবুশ পাতে মুক্তিযোদ্ধারা। তিন রাস্তার মোড়কে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয় ব্যুহ। প্রায় এক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল। মোট চারভাগে ভাগ হয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ভোররাত থেকে শত্রু হননের টার্গেট নিয়ে শুরু হয় অপেক্ষার পালা। কিন্ত সেদিন নির্ধারিত সময়ের পরও বংশীতলার রাস্তায় পৌঁছায়নি হানাদাররা। পেশাদার বাহিনীর কৌশলের কাছে হার মানে অপেশাদার বাঙালি গেরিলা যোদ্ধারা। একপর্যায়ে ধৈর্য হারিয়ে তারা বেরিয়ে আসেন নিরাপত্তা ব্যুহ ভেঙে। অচিরেই সেই মাশুল গুনতে হয়েছিল কুষ্টিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের।

বিজ্ঞাপন

এদিকে অপারেশনের খবর পেয়ে আশেপাশের বাড়ির মানুষেরা যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী স্বতঃস্ফুর্তভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নাস্তা তৈরি করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী আসার দেরি দেখে ফুসরতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই অ্যামবুশ ছেড়ে নাস্তা খেতে যান। আর এর মধ্যেই খবর আসে, আসছে শত্রুরা। নাস্তা ফেলেই যোদ্ধারা ময়দানে ফেরেন। কিন্তু তাড়াহুড়ায় আগের মতো প্রতিরক্ষাবর্ম সাজানো যায়নি। অনেকটা অপরিকল্পিতভাবেই যে যেখানে পারেন অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানি আর্মির গাড়িগুলো টার্গেটে পৌঁছানোর আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ ফায়ার ওপেন করেন। ফলে সতর্ক হয়ে যায় অস্ত্রে সজ্জিত হানাদাররা। শুরু হয় যুদ্ধ।

বিজ্ঞাপন

সেদিনের স্মৃতিচারণায় এলাকার অনেকেই বলেন, এমন ভয়ংকর যুদ্ধ তারা আগে দেখেননি। একসময় তুমুল গোলাগুলি ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি মিলিটারি আগে থেকে সতর্ক হয়ে যাওয়ায় তাদের সাঁড়াশি আক্রমণে পিছু হটতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। একে একে স্বাধীনতার সূর্যকে লাল রঙে রাঙিয়ে শহীদ হন ৯ মুক্তিযোদ্ধা। অপরদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্তত ১৫ জন সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয়। অবস্থা এমনই ভয়ংকর ছিল, সহযোদ্ধাদের লাশ নিয়ে যেতে পারেনি বাংলার বীর যোদ্ধারা। সংগঠিত হয়ে শহীদ যোদ্ধাদের লাশ সংগ্রহে গেলে গাড়ি বোঝাই হয়ে আসা আরও পাকিস্তানি সৈন্য আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রাণ বাঁচাতে তারা নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান।

এরপরের ইতিহাস আরও করুণ। এই আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে হানাদারদের নৃশংস পৈশাচিক বর্বরতার শিকার হন ওই গ্রামের নিরীহ নারীরা। ধর্ষণের শিকার হন ৫ নারী। এদেরই একজন রাবেয়া। রাজাকারদের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তরুণী রাবেয়ার ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায় হানাদাররা।

আজও বেঁচে আছেন রাবেয়া। বেঁচে আছেন মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের বর্বরতার স্বাক্ষী হয়ে। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু মিললেও গেজেটে নাম না ওঠায় ভাতা বা অন্যকিছু পান না। নির্যাতনের শিকার অন্য চার নারী মুক্তিযোদ্ধার গেজেটভুক্ত করার মাধ্যমে স্বীকৃতি মিললেও যোগাযোগের অভাবসহ নানা কারণে তা মেলেনি রাবেয়ার। সময়ে সময়ে সরকারের কিছু সুযোগসুবিধা পেয়েছেন বটে, তা তার জীবনযাপনে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রাখতে পারেনি। ফলে, প্রায় বিনা চিকিৎসায় ক্যান্সারে ধুঁকে মারা গিয়েছে তার স্বামী। তিনিও বছর দেড়েক ধরে শয্যাশায়ী। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। প্রহর গুনছেন মৃত্যুর।

আজও এই অবস্থাতে থেকেও রাষ্ট্রের কাছে কিছুই চান না মুক্তিযোদ্ধা রাবেয়া। এই জীর্ণ অবস্থাতে থেকেও দাবি করেন রাজাকারদের বিচারের। বলেন, যুদ্ধের সময়ে আমাদের যেসব লোক হানাদারদের সাহায্য করেছে- তাদের বিচার হওয়া উচিত সবার আগে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

পৈশাচিক নির্যাতনের স্বাক্ষী বংশীতলার মুক্তিযোদ্ধা রাবেয়া ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রহমান মুস্তাফিজ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর