সৃষ্টিজগতের ০.০১ ভাগ হয়েও বাকি সব প্রাণ বিনাশ করছে মানুষ
২২ মে ২০১৮ ১৮:১১
সারাবাংলা ফিচার ডেস্ক।।
পৃথিবীতে জীবজগতের সব ধরণের প্রাণির সংখ্যা ও অন্যান্য প্রাণির উপর মানবজাতির প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি এক সমীক্ষার ফল বেরিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পিএনএস বা প্রোসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসের করা এই সমীক্ষা বলছে, পুরো সৃষ্টিজগতে মানুষ সংখ্যায় অত্যন্ত কম। কিন্তু প্রকৃতি ও বাকি সমস্ত প্রাণের উপর তাদের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি, আর তা খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ৭.৬ বিলিয়ন হলেও তা সমস্ত প্রাণিজগতের ০.০১ শতাংশ মাত্র। কিন্তু সভ্যতার শুরু থেকে এই মানুষই ৮৩% বন্য স্তন্যপায়ী প্রাণি ও আর অর্ধেক গাছপালা শেষ করে ফেলেছে। অথচ এসব গাছপালা আর পশুপাখির উপর নির্ভর করেই মানুষ বেঁচে আছে।
পৃথিবীতে কত ধরণের জীবন্ত প্রাণি আছে তা নিয়ে ব্যপক আকারের এই নতুন সমীক্ষাটি আমাদের আগের অনেক ধ্যানধারণাকে প্রত্যাখ্যান করছে। জীবজগতে সবচেয়ে বড় জায়গা জুড়ে আছে গাছপালা। শতকরা ৮২ ভাগ জায়গা নিয়ে আছে এরা। এর পরের স্থান ব্যাকটেরিয়ার, ১৩ ভাগ । বাকিসব সৃষ্টি- কীটপতঙ্গ থেকে ফাঙ্গাস, মাছ থেকে জীবজন্তু সবমিলিয়ে সমস্ত রয়েছে জীবজগতের মাত্র ৫ ভাগ জুড়ে।
সম্প্রতি বিবিসি টেলিভিশনের ‘ব্লু প্লানেট টু’ সিরিজে দেখানো হয়েছে সাগরে পরিপূর্ণ জীব অর্থাৎ যারা সন্তান জন্ম দেয় এমন প্রাণি পুরো প্রাণিজগতের মাত্র ১%। এইযে বিশাল জীবজগৎ, তার অধিকাংশই ভূপৃষ্ঠে থাকে। আর একটা বড় অংশ, প্রায় আট শতাংশ হল ভূপৃষ্ঠের অনেক গভীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া।
এই সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ইসরায়েলের ওয়েইজম্যান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সেসের গবেষক অধ্যাপক রন মাইলো ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘জীবজগতের সব প্রাণির সংখ্যা নিয়ে এতদিন বিস্তারিত কোন গবেষণা হয়নি দেখে আমি দারুণ বিস্মিত হয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার আশা এই গবেষণার ফলে মানুষ বুঝতে পারবে যে আমরা সমস্ত জীবজগতের উপর কী রকম প্রভাব বিস্তার করে চলেছি।’ গবেষণায় অংশ নেওয়ার পর থেকে তিনি মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন বলেও জানান।
মানুষের কাজের ফলে এই গ্রহের যে ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা নতুন ‘ভূতাত্ত্বিক যুগ’ ‘দ্য অ্যান্থ্রোপোসিন’ ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন। এই পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য চিহ্ন হল দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়া অগণিত গৃহপালিত মুরগির হাড়।
নতুন এই সমীক্ষা দেখাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত পাখির মাঝে ৭০ ভাগই হচ্ছে পোলট্রি বা খামারে পালিত মুরগি, টার্কি ইত্যাদি আর বাকি ৩০ ভাগ হচ্ছে বন্য পাখি। চিত্রটা স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রেও বেশ চিন্তার কারণ। মোট স্তন্যপায়ীর ৬০ ভাগই হচ্ছে খাওয়ার উপযোগী গৃহপালিত পশু, ৩৬ ভাগ মানুষ আর ৪ ভাগ বন্যপ্রাণি।
অধ্যাপক মাইলো বলেন, ওয়াইল্ডলাইফ মুভিগুলোতে আমরা দলে দলে নানাজাতের পাখির ওড়াওড়ি দেখি কিন্তু পরে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এদের বেশিরভাগই পোষা পাখি।
‘ব্যপ্যারটা আসলে বেশ ভাবনা জাগানোর মতই’, অধ্যাপক মাইলো বলেন।
হালচাষ, গাছ কেটে কাঠ বানানোসহ উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে পৃথিবীর চার কোটি বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জীবজগত লুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। গত পঞ্চাশ বছরেই পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক প্রাণি লুপ্ত হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
মানুষ যখন থেকে কৃষিকাজ শুরু করেছে অথবা শিল্পোন্নয়নের ফলে যে বিরাট আকারের ক্ষতি হয়েছে তা উঠে এসেছে প্রাণিজগৎ নিয়ে করা নতুন এই সমীক্ষায়। ইঁদুর থেকে শুরু করে হাতির মত বন্য স্তন্যপায়ী প্রাণি সংখ্যায় এত কমে গেছে যে তা বিজ্ঞানীদের পর্যন্ত বিস্মিত করেছে।
অধ্যাপক মাইলো বলেন, পৃথিবীতে আমাদের সংখ্যা আসলে খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি যখন আমার মেয়ের সাথে পাজল খেলি তখন প্রথমে আসে হাতি, তারপর জিরাফ তারপর রাইনো থাকে। কিন্তু আমি যদি পৃথিবীর বর্তমান চিত্র তুলে ধরতে চাই, তাহলে সাজাতে হবে এভাবে- প্রথমে একটা গরু, তারপর আরেকটা গরু তারপর আরেকটা গরু আর তারপর একটা মুরগি।
হোমো স্যাপিয়েন্স ডেকে মানবজাতিকে আধিপত্যের জায়গা দেওয়া হলেও আমরা আসলে মোট ওজনের তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র। পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা ভাইরাসের মোট ওজন সব মানুষের চাইতে তিনগুণ বেশি। কীটদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। মাছেরা আমাদের চাইতে ১২ গুণ বেশি আর ফাঙ্গাস প্রায় দুইশ গুণ বড়।
কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর আমাদের, বিশেষত আমাদের খাদ্যাভ্যাসের অসম্ভব প্রভাব, বলেন অধ্যাপক মাইলো। এই প্রভাবের শিকার জীবজন্তু, গাছপালা ইত্যাদি।
‘আমার আশা, মানুষ এই গবেষনার ফল দেখে নিজেদের খাদ্যাভ্যাস পুনঃবিবেচনায় উৎসাহী হবে’, বলেন মাইলো।
‘আমি এখনও ভেজিটারিয়ান হয়ে যাইনি কিন্তু এই গবেষণার ফলে আমি খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় প্রকৃতির উপর তার প্রভাব নিয়ে চিন্তা করি। ভাবি যে গরু কিংবা ফার্মের মুরগি খাবো নাকি তার বিপরীতে টফু বেছে নেবো,’ বলেন তিনি।
সমীক্ষাটি চালাতে গবেষকরা শত শত পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করেছেন। স্যাটেলাইট রিমোটের দ্বারা বিশাল জায়গা স্ক্যান করা, আণুবীক্ষণিক জগতের জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের মত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষাগুলো চালানো হয়েছে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ- রাজনীন ফারজানা
সারাবাংলা/আরএফ/এসএস