একাত্তরের কল্যাণপুর: রীতাভিলায় পৈশাচিক গণহত্যা
২৫ জানুয়ারি ২০২৪ ২০:১৭
কল্যাণপুরের ১২ নম্বর রোডের ২ নম্বর বাড়িটির নাম ছিল রীতাভিলা। এলাকার অন্য বাড়িগুলো তুলনায় পাকা ও দ্বিতল এই বাড়িতেই একাত্তরের ২৮ এপ্রিল সবচেয়ে নৃশংসতম গণহত্যাটি সংঘটিত হয়। বাড়ির মালিক পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার প্রেস ম্যানেজার আহসান উল্লাহ চৌধুরী ছিলেন উপকারী সজ্জন ব্যাক্তি। সেই বিভীষিকাময় দিনে কল্যাণপুর ও আশেপাশের এলাকা থেকে বিহারীদের তাড়া খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে আসা অসংখ্য বাঙ্গালিদের তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিহারীদের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের জীবন রক্ষা করতে পারেননি। পরিবারের বাকিদেরসহ তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়া প্রায় সবাইকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করেছিল বিহারীরা।
বাড়ির মালিক শহীদ আহসান উল্লাহ চৌধুরীর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়। সেখান থেকে পাকিস্তান অবজার্ভারে যোগদান করেন তিনি। এখানেই প্রেস ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আহসান উল্লাহ ছিলেন পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের জনক। জনদরদী ও সমাজসেবক, পরোপকারী ও রাজনীতি সচেতন আহসান উল্লাহ একাত্তরের আগে থেকেই পাকিস্তানীদের বিশেষত মিরপুরের বিহারীদের অব্যাহত অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করতেন। মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের পর থেকেই যতটা সম্ভব বাঙ্গালীদের নিরাপদ আশ্রয় ও সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে আসছিলেন। এপ্রিলের ২৮ তারিখ পরোপকারী এই মানুষটা পরিবার সমেত শিকার হন বর্বর গণহত্যার।
১২ নম্বর রোডের রীতাভিলায় ভোর থেকেই কল্যাণপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে আসা অজস্র বাঙ্গালীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন আহসান উল্লাহ। তারা এসে জানাচ্ছিল যে বিহারীরা সকাল থেকেই পাকিস্তানী আর্মি নিয়ে হামলা চালিয়েছে তাদের বাড়িঘরে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে, বাঙ্গালী সামনে পেলেই নির্বিচারে হত্যা করছে। আহসান উল্লাহ বাড়ির দরজা খুলে দিলেন। দেখতে দেখতে দোতলা বাড়ি ভরে গেল প্রচন্ড আতংকিত পালিয়ে আসা নিরীহ সাধারণ মানুষে। কিন্তু তাদের প্রাণে বেঁচে যাবার স্বস্তির নিঃশ্বাস দীর্ঘ হলো না।
বাড়ির মূল দরজা একসময় বন্ধ করে দেয়া হলো আগুয়ান বিহারী নরপিশাচদের এদিকে আসার কথা শুনে। কিন্তু ঘাতকেরা এসে বাড়ির সদর দরজা ধাক্কাতে লাগলো। আহসান উল্লাহ’র ৮ বছর বয়সী ছেলে হায়দার আলম চৌধুরী (স্বপন) লুকিয়ে ছিল বাড়ির ভেতরের বেডরুমের খাটের নীচে। সবগুলো রুমের দরজা আটকানো, শুধু এই ঘরের দরজাই খোলা ছিল। হুড়মুড় করে বিহারীরা এই ঘরে ঢুকে পড়ল, হাতুড়ি-শাবল দিয়ে আলমার, বাক্স-পেটরা ভেঙ্গে লুটপাট চালাল। মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে বেরিয়ে যাবার পরেই স্বপন খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে পাশের রুমের কাছাকাছি আসতেই কেউ একজন তার কোলে তার ছোট বোন ৫-৬ মাসের রিতাকে দিয়ে গেল। বোনকে কোলে নিয়ে এক দৌড়ে পাশের রুমে ঢুকে যেতেই কেউ একজন দরজা ভেতর থেকে আটকে দিল।
দরজা আটকানোর শব্দেই টের পেয়ে গেল বিহারীরা, এসে ধাক্কাতে লাগলো দরজায়। ১৫-২০ মানুষ ভয়ে আতংকে কাঁপছে, ওদিকে দরজা ভাঙ্গার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে বিহারীরা। একপর্যায়ে রুমের দৌড়ে ঢুকতে দেখা স্বপনকে ডাকতে লাগলো এক বিহারী, বলতে লাগলো এই খোকা দরজা খোলো, তোমাকে কিছু বলব না। বের হয়ে চলে যাও।’ বেশ কয়েকবার এমন বলার পরে ছোট্ট স্বপন এই রক্তলোলুপ হায়েনাদের কথা বিশ্বাস করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।
তারপরেই শুরু হলো নৃশংসতম গণহত্যা। রীতিমত উৎকট উল্লাসে ফেটে পড়লো বিহারী কসাইগুলো, উদ্যত চাপাতি আর তরবারি হাতে অসহায় মানুষগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আদিম হিংস্রতায়। প্রাণভয়ে আর্তচিৎকার, আর্তনাদ, আহাজারি, ক্রন্দন সবকিছু মিলিয়ে মুহুর্তেই ঘর পরিণত হলো জীবন্ত নরকে। বিহারী নরপিশাচেরা কাউকে বল্লম দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে, কাউকে চাপাতি দিয়ে উপুর্যপরি কুপিয়ে ফালা ফালা করে, কাউকে ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটিতে ফেলে পশু জবাইয়ের মতন করে জবাই করতে শুরু করে। ছোটবোনকে কোলে নিয়ে চোখের সামনে এই বীভৎস দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া স্বপনকে টেনে একপাশে লুকিয়ে রেখে গেলেন কে যেন, কিছুক্ষণ পর তাকেও জবাই করে ফেলা হলো। অন্য ঘরগুলো থেকেও ভেসে আসছিল ধস্তাধস্তি ও আর্তচিৎকারের শব্দ। এভাবে কতক্ষণ চলল স্বপনের খেয়াল নেই, কিছুক্ষণ পর সে টের পেলো কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে তাদের বাড়িতে।
বেরিয়ে এলো স্বপন, দেখলো রক্তাক্ত বল্লম তরবারী চাপাতি ছুরি হাতে একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে বিহারীরা। বাইরে বেরিয়ে অন্য ঘরগুলোর কাছে আসতেই গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসতে শুনলো স্বপন পাশের ঘরগুলো থেকে। বোনকে বুকে চেপে ধরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতেই স্বপনের চোখে পড়ে এক ভয়াবহ দৃশ্য। তার বাবা মাটিতে পড়ে আছেন, তার মাথা কোনকিছু দিয়ে প্রচন্ড আঘাতে থেঁতলে দেয়া হয়েছে, খুলি ফেটে মগজ বেরিয়ে পড়ে আছে বাইরে। আহসান উল্লাহ’র কিছুটা দূরে পড়ে আছে ২০-২২ বছর বয়সী তরুণ মহিউদ্দিন, সম্পর্কে স্বপনের মামা এই মানুষটার পেট কাটা, গলা চেরা। তাঁকে জবাই করা হয়েছে। গোঙাচ্ছেন তিনি।
পাশেই থাকা মায়ের কাছ থেকে বিস্তারিত শোনে স্বপন। বিহারী জল্লাদেরা যখন দরজা ধাক্কাচ্ছিল, তখন তিনি সরল বিশ্বাসে দরজা খুলে দিয়ে বিহারীদের বলেছিলেন, “তোমরা আমার বাসায় যা আছে, সব নিয়ে যাও। কিন্তু যে মানুষগুলো এখানে আশ্রয় নিয়েছে প্রাণ বাঁচাতে, তাদের মেরো না। মানুষ মারা ভালো না।”
আহসান উল্লাহ’র কথা শেষও হয়নি, এক বিহারী তার কলার ধরে টানতে টানতে ঘরের বাইরে বের করে আনে তাঁকে। আরেকজন কিছু বলার বা বোঝার সুযোগ না দিয়েই হাতে থাকা বিশালকৃতির শাবল দিয়ে আঘাত করে আহসান উল্লাহর মাথায়। সাথে সাথে তার খুলি ফেটে ঘিলু বেরিয়ে আসে। কিন্তু আহসান উল্লাহ তখনই মারা যাননি। দুঃস্বপ্নের পালা তখনো শেষ হয়নি।
বাড়িতে উপস্থিত সকল যুবক ও বয়স্ক বাঙ্গালিদের হত্যা নিশ্চিত করে বিহারীরা চলে যাওয়ার পরে দিশেহারা আহসানউল্লাহ’র স্ত্রী কাজের ছেলে কিশোর নুরুজ্জামানকে পানি আনতে বললেন। নুরুজ্জামান পানি আনলে তিনি স্বামীর মাথায় পানি ঢালছিলেন। গলগল করে রক্ত বেরোনো তাতে অবশ্য কোনক্রমেই ঠেকানো যায়নি। কিন্তু এই দৃশ্য দেখে ফেলল পাশের বাড়িতে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকা কিছু বিহারী। মুহুর্তের মধ্যে নেমে এলো নরকের দ্বিতীয় অধ্যায়।
এক দৌড়ে ছুটে এলো কয়েকজন বিহারী, স্বপনের মা তাদের পায়ে ধরে অনুরোধ করেন যেন তার স্বামীকে আর মারা না হয়। কিন্তু তাতে পাষাণের মন বিন্দুমাত্র গলল না। এক বিহারী গরু জবাইয়ের একটা বড় চাপাতির মাথা আহসানউল্লাহর বুকে চেপে ধরে অমানুষিক পৈশাচিকতায় পুরোটা ঢুকিয়ে দিল, বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেল চাপাতিটা। সন্তানের চোখের সামনে বাবার বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ভিজিয়ে দিল মায়ের চেহারা ও পরনের শাড়ি। আজো স্বপন সেই ভয়াবহ দৃশ্য এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারেননি।
সেখানেই শেষ নয়, দ্বিতীয়বার রীতাভিলায় হামলার একপর্যায়ে বিহারীরা খুঁজে পেলো সিঁড়ির কাছে লুকানো এক বৃদ্ধকে। বর্তমান কল্যাণপুর গার্লস স্কুলের পাশে তার একটা দোকান ছিল তখন। প্রাণভয়ে আশ্রয় নেয় মানুষটাকে দুইজন বিহারী পাজকোলা করে তুলে এনে ফেলে দিল বাড়ির সামনে, এরপরে একটা শাবলের দুই মাথা ধরে সেই বৃদ্ধের ঘাড়ে এমন অভিনব কায়দায় সজোরে চাপ দিল যে ঘাড়টা মট করে ভেঙে গেল। আরেকজন সাথে সাথে বড় একটা হাতুড়ি বসিয়ে দিল বৃদ্ধের মাথায়, আঘাতে খুলি ফেটে বেরিয়ে এলো ঘিলু।
এই দৃশ্য দেখে বেঁচে যাওয়া ১৫-১৬ বছর বয়সী এক কিশোর ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইল করিডোর ধরে। দৌড়াতে গিয়ে তার লুঙ্গি খুলে যাওয়ায় বিবস্ত্র ভয়ার্ত বাচ্চাটা থেমে লুঙ্গি তোলার চেষ্টা করতেই তাঁকে মুরগী ধরার মত করে ধরে ফেললো ছেলেটাকে। এরপরে হাসতে হাসতে ছুরি দিয়ে কেটে ফেললো বাচ্চাটার পুরুষাঙ্গ। অসহনীয় আর্তচিৎকারে চারপাশ কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সেই কিশোর। স্বপনের বড় ভাই ১৩-১৪ বছর বয়সী সারোয়ার আলম চৌধুরী পবন রক্তাক্ত অবস্থায় পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, তাঁকে কয়েকটা বিহারী ছেলে ছুরি মারতে উদ্যত হলে কয়েকজন বয়স্ক বিহারীর হস্তক্ষেপে বেঁচে যায় তারা। কিন্তু বাঁচতে পারেনি পানি এনে দেয়া কাজের ছেলে নুরুজ্জামান ও আরেকজন কিশোর, তাদের আবার বাড়ির ভেতরে ঢুকে হত্যা করে বিহারীরা।
বিহারী জল্লাদেরা এরপরে সেই স্থান ত্যাগ করে পাড়ার অন্য বাড়িগুলোতে ছুটলো হত্যার নেশায়। সেই মুহুর্তেই বাঁচার আশা দেখালো এক পরিচিত বিহারী কসাই। সে ছুটে এসে বললো, যারা মরে গেছে তাদের তো আর পাবে না তোমরা, কিন্তু এখানে থাকলে তোমরাও মারা পড়বে। এরপরে সেখান থেকে বেঁচে থাকা স্বপন, স্বপনের ভাই-বোন আর মাসহ কয়েকজনকে কল্যাণপুর জামে মসজিদে নিয়ে গেল সে, সেখানে উপস্থিত আরেক বিহারী নাপিত এদের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দিল। ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিল আরো অসংখ্য বাঙ্গালী। মূলত অস্ত্র হাতে বিহারীরা যেন দেখে মনে করে মসজিদে কেউ নেই, সেজন্যই তালা মেরে রাখা হয়েছিল। অবস্থাটা তখন এমন দাঁড়িয়েছিল যে যদি মসজিদে আটকে রেখে খুনীদের ডেকে আনা হত, তাহলেও কিছু করার ছিল না। কিন্তু এই গুটিকয়েক বিহারী আসলেই বাঙ্গালীদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল, ফলে তাদের তৎপরতায় প্রাণে বেঁচে যায় স্বপন, পবনসহ আরো অনেকেই।
এরপরে দুপুরের দিকে বিহারী নরপিশাচগুলো এলাকা ত্যাগ করলে সেই নাপিত তালা খুলে জানাল, বিহারীরা চলে গেছে, কিন্তু বাঁচতে চাইলে এই এলাকায় আর এক মুহুর্ত থেকো না। এখুনি চলে যাও। মসজিদ থেকে বের হয়েই বেশিরভাগ মানুষ ছুটলো কল্যাণপুর ইপিআরটিসি বাসডিপোর দিকে। বাঙালী ড্রাইভার, কন্ট্রাক্টর ও কর্মচারীরা ডিপো খুলে দ্রুত বাস বের করে বাঙ্গালীদের বাসে তুলে নিয়ে বাস ছেড়ে দিল। দ্রুত গতিতে ডিপো এলাকা পেরিয়ে যাবার সময় তরবারী হাতে বিহারীরা বাস থামানোর চেষ্টা করল, না পেরে ধাওয়া করল। কিন্তু সৌভাগ্যবশত তারা বাস থামাতে পারেনি। রীতাভিলায় ৩০ জনেরও বেশি নিরীহ মানুষকে জবাই করা হয়েছিল, পুরো এলাকায় শত শত বাঙ্গালীর লাশ পড়ে রইল সেভাবেই, বিজয়ের আগ পর্যন্ত। আহসানউল্লাহ সাহেবের স্ত্রীর পরনে রক্তমাখা শাড়ি আর সন্তানদের মনে চোখের সামনে পিতাহত্যার বীভৎস দৃশ্য। আজো এই শহীদ স্বজনেরা বিচার পাননি। হয়তো সেই হত্যাকারী বিহারী জল্লাদেরা আজো বুকভরে শ্বাস নিচ্ছে শহীদের রক্তে ভেজা এই জমিনে দাঁড়িয়ে।
তথ্যসূত্রঃ
১। কল্যাণপুর গণহত্যা/আলী আকবর টাবী
১৯৭১ গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট
২। একাত্তরে মিরপুর: সেখ ইসমাইল হোসেন
সারাবাংলা/এসবিডিই
একাত্তরের কল্যাণপুর: রীতাভিলায় পৈশাচিক গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধ রহমান রা’দ