কল্যাণপুর গণহত্যা: চোখের সামনে ক্ষতবিক্ষত স্বজন
২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:০১
১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল কল্যাণপুরে যে ভয়ংকর নারকীয় তান্ডব চালিয়েছিল বিহারী নরপিশাচেরা, তাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য পরিবার। শত শত মানুষের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল চারপাশে, এমনকি অনেকক্ষেত্রে হতভাগ্য মানুষগুলোর শেষকৃত্য বা দাফনটুকুও করার সুযোগ হয়নি প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালানো স্বজনদের। গত পর্বে আমরা জেনেছি রীতাভিলার কথা, যেখানে ২৮ এপ্রিল হত্যা করা হয়েছিল ৩০ জনের বেশি মানুষকে। পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার প্রেস ম্যানেজার আহসান উল্লাহর বাড়ি রীতাভিলা ছাড়াও আক্রান্ত হয়েছিল আশেপাশের সব বাড়ি। এর একটি ছিল মরহুম জালাল আহমদ চৌধুরীর ১ নম্বর বাড়িটি।
তিনি পরিবারের সবাইকে বিশেষ করে নারী ও শিশুদের আগেই সরিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়িতে ছিল শুধু তার দুই কিশোর সন্তান মহিউদ্দিন ও আজিমুদ্দিন। ১৫-১৬ বছর বয়সী আজিমুদ্দিনের বড় ছিলেন তার ভাই মহিউদ্দিন, কিন্তু তিনি ছিলেন বাকপ্রতিবন্ধী। ২৭ এপ্রিল রাতেই ৮-৯টার দিকে কল্যাণপুর ব্রিজের কাছ থেকে গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। পরদিন সকালে জালাল সাহেব অফিসে চলে যাবার পর হঠাৎ করে সাতটা সাড়ে সাতটার দিকে মিরপুরের দিক থেকে ভয়ার্ত মানুষদের গগনবিদারী চিৎকার ভেসে এলো। আজিমুদ্দিন বাইরে বেরিয়ে দেখেন এলাকার অনেকগুলো বাড়িতে আগুন জ্বলছে। বড় লাঠি, সড়কি, বল্লম, তলোয়ার, কুড়াল, চাপাতি, বড় ছুরি ও বন্দুক হাতে অসংখ্য অবাঙ্গালি বিহারী কল্যাণপুরের দিকে ধেয়ে আসছে। মিরপুরের দিক থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মানুষদের কাছ থেকে জানা গেল, বিহারী নরপিশাচেরা বাঙ্গালিদের বাড়িঘর বেপরোয়াভাবে লুটপাট করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, নির্বিচারে খুন করছে যাকে ইচ্ছে তাকে।
ততক্ষণে আজিমুদ্দিন নিজেই শুনতে পাচ্ছিলেন এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে মৃত্যুপথযাত্রী নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধদের ভয়ার্ত আর্তচিৎকার। উত্তরদিক থেকে বিহারীদের আসতে দেখে তিনি এবং তার ভাই মহিউদ্দিন দক্ষিণদিকে দৌড় দিলেন প্রাণভয়ে, ২ নং রোডে ১০ নং বাড়িতে ঢুকে বাবাকে ফোনে জানালেন পরিস্থিতি, সেখান থেকে বেরোতেই ভেসে এলো মোহাম্মদপুরের দিক থেকে প্রবল শোরগোল ও আর্তচিৎকার। অর্থাৎ দুই দিক থেকেই বিহারীদের সাঁড়াশি আক্রমণে রীতিমত নরক নেমে এলো। উপায়ন্তর না দেখে আজিমুদ্দিন আবার তার বাড়ির দিকেই ছুটতে লাগলেন। কাছাকাছি এসে দেখতে পেলেন ততক্ষণে বিহারীরা বাড়িতে কাউকে না পেয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও দেখে আসা সাজানো গোছানো বাড়িটা আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়তে দেখে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আজিমুদ্দিন। তখনই এক বিহারী তাকে দেখে ফেলল। চিৎকার করে উঠলো এই বলে, ‘উ সালে বাঙ্গাল, ধর সালেকো, মার সালেকো’!
প্রাণ বাঁচাতে তক্ষুণি ছুটতে ছুটতে পালিয়ে প্রফেসর আজিজুল ইসলামের ‘ঠিকানা’ বাড়িতে ঢুকে পড়লেন আজিমুদ্দিন, প্রাণভয়ে সবাই পালিয়ে গেছে, শুধু সার্ভেন্টস টয়লেটের দরজা খোলা। তাতেই ঢুকে পড়ে আজিমুদ্দিন টের পেলেন ছিটকিনি নেই। কোনক্রমে দরজা আটকে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। টয়লেটের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছিলেন বিহারীরা একের পর এক বাড়িতে যাচ্ছে, লুটয়াট করছে, জবাই করছে এবং শেষে আগুন ধরিয়ে পরের বাড়িতে যাচ্ছে। এভাবে তারা আজিমুদ্দিন যে বাড়িতে লুকিয়েছিলেন, সেখানে হাজির হলো। সৌভাগ্যক্রমে বাড়িতে কাউকে না পেয়ে বাড়ির আনাচে কানাচে খুঁজে আর টয়লেট খুঁজতে এলো না, আগুন ধরিয়ে দিয়ে পরের বাড়িতে চলে গেল। পাশের বাড়িটা ছিল পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার প্রেস ম্যানেজার আহসান উল্লাহ চৌধুরীর। তিনি ছিলেন সম্পর্কে আজিমুদ্দিনের দুলাভাই। দুইতলা পাকা বাড়িটায় অনেক বাঙ্গালী আশ্রয় নিয়েছিলেন, বিহারীরা সেই বাড়িতে প্রবেশ করেই আদিম পাশবিক হিংস্রতায় উন্মত্ত হয়ে উঠলো।
এতোগুলো মানুষকে পেয়ে হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ল বিহারীরা, একসাথে অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের বাঁচার আকুতি ও বুকফাটা আর্তচিৎকারে রীতিমত নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হলো। আজিমুদ্দিন গগনবিদারী আহাজারি আতংকিত স্বর এবং আহাজারির মধ্যেও কসাইখানায় জবাই করা গরুর মতন গলা কেটে ফেলা মানুষের অন্তিম গোঙরানির ভয়ংকর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন, ভয়ে আতংকে তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছিল ঠান্ডা স্রোত। কতগুলো গোঙরানি শুনেছেন আপনি একসাথে? আজিমুদ্দিন সেদিন একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা গোঙরানি শুনতে পাচ্ছিলেন, একপর্যায়ে তিনি আর হিসাব রাখতে পারলেন না। একসাথে অনেকগুলো মানুষের গোঙরানি শোনা যাচ্ছিল, বোঝাই যাচ্ছিল বিহারীরা শুরুতে একজন একজন করে জবাই দিলেও একপর্যায়ে ঘরে থাকা বাকিদের একইমুহুর্তে একসাথে জবাই করেছে।
বেলা বারোটা পর্যন্ত চলল এই বীভৎস জবাইপর্ব। একপর্যায়ে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এলো যেন চারপাশে। আজিমুদ্দিন বুঝতে পারলেন সবাইকে জবাই করা শেষ, আর কেউ বেঁচে নেই। আচমকা তিনি বাংলায় ফিসফিস শব্দ শুনতে পেয়ে খুব সাবধানে টয়লেটের দরজা খুলে বের হলেন। পাশের বাসার বন্ধু রহিম তাকে দেখে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘আরে আজিম বেঁচে আছে!’ আজিমুদ্দিন টের পেলেন এই নারকীয় পৈশাচিকতার পর বেঁচে থাকাটাই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সাময়িক স্বস্তির কিছুক্ষণ পরেই রহিমের গলায় আজিম শুনতে পেলেন হাহাকার, “মহিউদ্দিন ভাইকে তো ওরা জবাই করে ফেলেছে”!
এতোক্ষণ নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত থাকা আজিমুদ্দিন আচমকা যেন প্রবল শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। দ্রুতপায়ে এগোতে গিয়ে বড় বোনের বাসার সামনে দেখলেন বীভৎস দৃশ্য। তার বুবুর সমস্ত শরীর রক্তাক্ত। তার স্বামী আহসান উল্লাহ সাহেবকে প্রথমবার বিহারিরা মারথায় শাবল দিয়ে প্রচন্ড আঘাতে ঘিলু বের করে ফেলে, পরের বার আবার ফিরে এসে পুরো চাপাতি বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বুকটা ফালাফালা করে ফেলেছিল। ফিনকি দিয়ে বেরোনো রক্তে তার শাড়ীসহ পুরো শরীর ভিজে গেছে। তিন শিশুকে নিয়ে অসহায়ের মতন দাঁড়িয়ে আছেন আহসান উল্লাহ সাহেবের স্ত্রী, দেখে চোখ ফেটে পানি এলো আজিমুদ্দিনের। হাওমাও করে কাঁদতে কাঁদতে আজিমুদ্দিন বুবুর রক্তে ভেজা শাড়িটা বদলাবার জন্য একটা কাপড়ের খোঁজে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এক বিহারী কসাই এসে খবর দিলেন বিহারীরা আবার এদিকে আসতে পারে, এবার আর কাউকেই বাঁচিয়ে রাখবে না।
দ্রুত বোন-ভাগনা ভাগনিদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটলেন আজিমুদ্দিনসহ সবাই। পরবর্তীতে এক বিহারী নাপিত তাদের কল্যাণপুর জামে মসজিদের ভেতরে আশ্রয় নেবার পরামর্শ দিলেন। মসজিদের ভেতর গাদাগাদি করে অসংখ্য মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন, বাইরে বেস কয়েকবার রাউন্ড দিয়ে গিয়েছিল বিহারী শ্বাপদরা আর কোন বাঙ্গালী জীবিত আছে কিনা জানতে, কিন্তু ঐ বিহারী নাপিতটা মসজিদটা বাইরে দিয়ে তালা মেরে যাওয়ায় এবং মসজিদে বাঁ এদিকে কেউ নেই জানানোয় মানুষগুলো বেঁচে যায়। দুপুর দুইটার পর মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের সব বিহারী নরঘাতকেরা চলে গেলে সেই নাপিত মসজিদের দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে বলে তাদের।
মসজিদ থেকে বেরোবার সময় রহম আলীর নামে একজনের সাথে হয় আজিমুদ্দিনের। সে জানায়,’তোমার ভাই মহিউদ্দিন এখনো বেঁচে আছে, মরার আগে একবার পানি খাওয়াবে না? শুনে আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যান আজিমুদ্দিন, বুবু আর তার বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী ভাইয়ের কথা মনেই নেই তার। রুবেল ও পবনদের বাড়ির মাঝের খালি প্লটে পড়ে ছিল মহিউদ্দিনের দেহ, পিশাচের দল একজন বাকপ্রতিবন্ধীকেও ন্যুনতম দয়া দেখায়নি, তার গলায় ছুরি চালাতে তাদের একবিন্দু হাত কাঁপেনি। পেটে আর পিঠে ৫টা বল্লমের ক্ষত চেপে অসার হয়ে অড়ে থাকা মহিউদ্দিন তখনো মারা যাননি। তার পাশে আহসান উল্লাহ চৌধুরীসহ আরো অনেকের লাশ পড়ে ছিল। ভাইকে বাঁচাতে একটা গাড়ির খোঁজে বাসস্ট্যান্ডে ছুটে গেলেন আজিমুদ্দিন, সেখানে রেডক্রসের একটা অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেল। আওয়ামীম লীগ নেতা ডাঃ হায়দার আলী অ্যাম্বুলেন্সটা এনেছিলেন আহতদের হাসপাতালে নিতে, কিন্তু চালক কোনভাবেই কল্যাণপুরের ভেতরে ঢুকবে না। বলল, আহতদের এখানে নিয়ে আসেন।
আজিমুদ্দিন মহিউদ্দিনকে তুলে ধরার জন্য বাঁশ আর কাপড় আনতে পবনদের বাড়িতে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো এক বীভৎস দৃশ্যের। যদিও টানা ঘন্টাখানেকের বেশি তিনি জবাই করা মানুষের গোঙানি আর আর্তচিতকার শুনেছেন, তবুও ভেতরে ঢুকে ভয়ে আতংকে প্রায় অজ্ঞান হবার দশা হল। প্রতিটা ঘরে গলাকাটা আর জবাই করা মানুষের লাশ, সবমিলিয়ে কমপক্ষে ৩০টারও বেশি। রক্তের ছোট ছোট পুকুর তৈরি হয়েছে সমস্ত বাড়ি জুড়ে, জুতো ডুবে যাচ্ছে সেই রক্তে। বাঁশ আর কাপড় আর আনা হল না, ভাইকে পাজকোলা করে তুলে ধরেই অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে গেলেন আজিমুদ্দিন।
পরদিন ডেইলি পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার মালিক হামিদুল হক তার আত্মীয় পত্রিকার প্রেস ম্যানেজার আহসান উল্লাহর লাশ আনতে বহু দেনদরবার করে কয়েকজন পাকিস্তানী সেনা আর একটা ট্রাক ম্যানেজ করতে পারলেন। পাকিস্তানী সেনাদের সেই ট্রাকের সাথে আহসান উল্লাহর ভাতিজা এ টি এম মনিরুল হক চৌধুরী লিলু এবং মনির আহম্মদ চৌধুরী ও ডাঃ শেখ হায়দার আলী এসেছিলেন। তারা উন্মুক্ত প্রান্তরে পড়ে থাকা আহসান সাহেবের লাশ ট্রাকে তোলার পর আবার বাড়িতে ঢুকলেন যদি আর কাউকে জীবন্ত পাওয়া যায়। রীতিমত দুরাশা যদিও, তবুও তারা একটা একটা লাশ পরীক্ষা করে দেখছিলেন যে যদি কারো দেহে সামান্যতমও প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়। অবিশ্বাস হলেও সত্য, একজন ব্যাক্তির শরীরে পালস পাওয়া গেল। চাপাতির কোপে তার মাথার বিশাল ক্ষত তৈরির পর কোন এক অজানা কারণে কিংবা বেখেয়ালে তাকে আর জবাই করেনি বিহারীরা। সাথে সাথে তাকে তুলে বাইরে এনে ট্রাকে তুলতে গেলেন তারা, কিন্তু পাকিস্তানী সেনারা কোনভাবেই তাকে ট্রাকে তুলতে দেবে না। তারা বলতে থাকলো, শুধু ম্যানেজার সাহেবের লাশটাই নেবার পারমিশন আছে, অন্য কাউকে তারা নিতে পারবে না।
কিন্তু উপস্থিত মানুষগুলোর আপ্রাণ চেষ্টায় ও চাপে আহত ব্যাক্তিকে তারা নিতে বাধ্য হয়। তিনি ছিলেন চন্দ্রমা, বাড়ি নম্বর ৭১, কল্যাণপুর প্রধান সড়কের বাসিন্দা ইসমাইল মিয়া। তার ছেলে ডাঃ হাবিবুল্লাহ। দীর্ঘদিন ইসমাইল মিয়া ও মহিউদ্দিনের চিকিৎসা চলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ২৮ এপ্রিলের গণহত্যায় আহসান উল্লাহ চৌধুরীর রীতাভিলায় বিহারীদের পৈশাচিকতায় আক্রান্ত মানুষগুলোর মধ্যে কেবল এই দুইজনেই বেঁচে ফিরেছিলেন। মাথায় প্রচন্ড আঘাতে ইসমাইল মিয়ার শরীরের ডান পাশ চিরতরে অবশ হয়ে যায়। বাকশক্তি না থাকা মহিউদ্দিন প্রচন্ড মানসিক আঘাতে বাকি জীবন বিপর্যস্ত ও জীবন্মৃত হিসেবে বেঁচে থাকেন।
তথ্যসূত্র-
১। কল্যাণপুর গণহত্যা/আলী আকবর টাবী, ১৯৭১ গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট
২। একাত্তরে মিরপুর: সেখ ইসমাইল হোসেন
সারাবাংলা/এসবিডিই
কল্যাণপুর গণহত্যা: চোখের সামনে ক্ষতবিক্ষত স্বজন ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রহমান রা’দ