Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ওয়াজেদ মিয়ার দুঃস্বপ্নের দিনলিপি থেকে কিছু স্মৃতিকথা

রাহাত মিনহাজ
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:০৭

তার স্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা একটি জাতির পিতা। স্বপ্নের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি। নানাবিধ সমস্যা আর ষড়যন্ত্রের পরও যিনি কঠিন হাতে সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন। দুই ভাই নব বিবাহিত। বাড়িতে বিয়ের আমেজ। ছোট্ট রাসেল নিশ্চয় সে সময় বেশ আনন্দে সময় পার করছিল। নতুন দুই সদস্য সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছিলেন বেগম মুজিব ও ৩২ নম্বরের পরিবেশের সাথে। এমনই এক আনন্দঘন পরিবার রেখে ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট ইউরোপ পাড়ি দিয়েছিলেন ওই বাড়ির বড় সন্তান শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা। সাথে শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া, শিশু পুত্র জয় ও কন্যা সায়মা। জার্মানীতে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর আমন্ত্রণে বন-এ গিয়েছিলেন তারা। সেখান থেকে ব্রাসেলস্ যান ১২ আগস্ট।

বিজ্ঞাপন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জামাতা ড.এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া শুধু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন পরমাণু বিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। তিনি বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রের অনেক উত্থান-পতন, চড়াই-উৎরাই খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ১৫ আগস্টের বিভীষিকার পর বঙ্গবন্ধু পরিবারের এক দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৫ আগস্টের পরেই সেই দিনগুলোর চিত্র পাওয়া যায় তার অত্যন্ত সুপাঠ্য স্মৃতিকথামূলক ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে । বইটির পাতায় পাতায় স্থান পেয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের দু:সহ সেই সব দিনের কথা।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। ঐ দিন ভোরে যখন ৩২ নম্বর আক্রান্ত, তখন সাত সমুদ্র তের নদী দূরের ব্রাসেলসে মাত্র মধ্যরাত পার হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে ভোর আর ইউরোপে মাত্র ঘড়ির কাটা অনুযায়ী নতুন একটা দিন শুরু। দিনটি সেই কালো দিন, ১৫ আগস্ট। জাতির পিতার নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের পাঁচ ঘন্টা পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার খবর পৌছায় শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার কাছে। ওয়াজের মিয়া লিখেছেন, ১৫ আগস্ট ভোরে আমার ঘুম ভাঙ্গে ব্রাসেলস্ এ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী’র ডাকে। তিনি জানান, জার্মানীর বন থেকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরি ফোন করেছেন। ফোনে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরি জানান ‘বাংলাদেশে কূ-দে-তা হয়ে গেছে। আপনারা আর প্যারিস যাবেন না। বিষয়টি হাসিনা আর রেহানাকেও জানাবেন না। ’… এরপর আমি আস্তে আস্তে তিন তলায় চলে আসি। হাসিনা অশ্রুজড়িত কন্ঠে জানতে চান কি হয়েছে? তিনি কি বলেছেন? আমি বলি, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরি প্যারিস যাত্রা বাতিল করে বন-এ ফিরে যেতে বলেছেন। আর বাংলাদেশে কি যেন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে যাতে আমাদের আর প্যারিস যাওয়া নিরাপদ নয়। এ শুনেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন দুই বোন।

ড. ওয়াজেদ বর্ণনা দিয়েছেন, ব্রাসেলস্ থেকে ১৫ আগস্ট সকাল ১০ টার দিকে তারা বন-এ উদ্দেশ্যে রওনা হন। হাসিনা আর রেহানা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছিলেন। বিকাল ৪ টার দিকে তারা হুমায়ূন রশীদ চৌধুরির বাড়িতে পৌছান। এদিকে যুগোস্লাভিয়া সফর শেষে ফ্রাঙ্কফুটে যাত্রা বিরতীর সময় হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর বাসায় আসেন ড. কামাল হোসেন। তখন জনাব ওয়াজেদকে বলা হয় বিবিসি’র ভাষ্য অনুযায়ী বেগম মুজিব আর রাসেল ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। আবার ঢাকায় ব্রিটিশ মিশনের বরাত দিয়ে কিছুক্ষণ পরই বলা হয় মুজিব পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। এমন সময় আমরা তিনজনই একমত হই যে একমাত্র ভারতই হতে পারে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরাপদ জায়গা।

এম.এ.ওয়াজেদ মিয়া আরও লিখেছেন কঠিন সেই দুঃসময়ে স্ত্রী শেখ হাসিনা, শ্যালিকা রেহানা, শিশু ছেলে জয়, মেয়ে পুতুলের ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা ও প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ২৫ আগস্ট জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুট থেকে দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা হন তারা। এয়ার ইন্ডিয়ার জ্যাম্ব জেটটি তাদের নিয়ে পৌছায় দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে। প্রথমে তাদের নেওয়া হয় দিল্লীর ডিফেন্স কলোনীর এক ফ্ল্যাটে। সে সময় ভারত সরকারের এক যুগ্ম সচিব জনাব ওয়াজেদ ও শেখ হাসিনাকে জানান রাত ৮ টায় আপনাদের এক বাসায় নেওয়া হবে বিশেষ সাক্ষৎকারের জন্য। সেই রাতে ঐ বাসায় যাওয়ার পথে আমাদের সাথে অপর এক গাড়িতে আসেন ভারত সরকারের উচ্চ পদস্থ আরেক কর্মকর্তা। ১৫ মিনিটের জার্নি শেষে আমরা পৌছায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির বাসভবনে। একটা লম্বা সোফায় বসেন শেখ হাসিনা। আমি অন্য একটি সোফায়। প্রায় ১০ মিনিট পর ঐ ঘরে প্রবেশ করেন ইন্দিরা গান্ধি। তিনি এসে শেখ হাসিনার সোফায় বসেন। সামান্য কুশল বিনিময়ের পর ইন্দিরা গান্ধি আমাদের কাছে জানতে চান ১৫ আগস্ট ঘটনা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি কি না? এর জাবাবে জার্মানীতে থাকা অবস্থায় আমরা যে সব তথ্য পেয়েছিলাম সে সব তথ্যই পুনরায় উল্লেখ করি। এ সময় ইন্দিরা গান্ধি তার শীর্ষ কর্মকর্তাকে এ সম্পর্কে সব শেষ তথ্য তুলে ধরতে বলেন। পাশে দাঁড়ানো কর্মকর্তা দুঃখভারাক্রান্ত মনে ইন্দিরা গান্ধিকে জানান, ঢাকায় মুজিব পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই। শেখ হাসিনা আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এ সময় ইন্দিরা গান্ধি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তুমি যা হারিয়েছে তা কোনভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। তোমার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে তোমার ছেলেকেই তোমার আব্বা আর মেয়েকেই মা হিসেবে ভাবতে হবে। তোমার ছেলে-মেয়ে ও বোনকে মানুষ করার ভার তোমাকেই নিতে হবে। এতএব তোমার কোন অবস্থাতেই ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। ’ (পৃষ্ঠা ২৫১-২৫২) ওয়াজেদ মিয়া আরও উল্লেখ করেছেন সেই দফায় ১৯৭৬ সাল এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতা থাকাকালে এটাই ছিল ইন্দিরা গান্ধির সাথে তাদের একমাত্র সাক্ষাৎ।

ইন্দিরা গান্ধির সাথে সাক্ষাতের পর সেপ্টম্বরের মাঝামাঝিতে ইন্ডিয়া গেইটের কাছে পান্ডারা রোডের এক দোতলা বাড়ি তাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়। এক তলায় দুটো ফ্ল্যাট। একটি ফ্ল্যাটে কোন আসবাপত্র ছিল না। এরপর ভাড়ায় কিছু আসবাপত্রের ব্যবস্থা করা হয়। এদিকে ভারত সরকার ড. এম.এ. ওয়াজেদ মিয়াকে ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশনে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ। যার শর্ত অনুযায়ী ওয়াজেদ মিয়াকে বাসা ও অফিসের যাতাযাত সুবিধাসহ দৈনিক প্রদান করা হতো মাত্র বাষট্টি রুপি পঞ্চাশ পয়সা। ড.ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, সেই সময় আমাদের কঠিন কিছু নিয়ম মেনে চলতে হত। অর্থাৎ বাইরের কারও কাছে আমাদের পরিচয় না দেওয়া। কারও সাথে কোন যোগাযোগ না করা এবং নিরাপত্তা প্রহরী ছাড়া বাইরে না যাওয়া। বিষয়গুলো আমরা কঠোরভাবে মেনে চলতাম। এদিকে সময় কাটানো ও নিজেদের ব্যস্ত রাখতে বাসায় সরবরাহ করা হয় ভারতীয় একটি সাদা-কালো টিভি। এছাড়া আরও একটি নিজস্ব ট্র্যানজিস্টার ছিলো। বাসায় কোন টেলিফোন ছিলো না। সুতরাং বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবরা খবর পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিলো ঐ ট্র্যানজিস্টার। এভাবইে নানা শঙ্কা আর অনিশ্চয়তায় দিন কাটে জাতির জনকের দুই কন্যার। ভারতে টানা ৬টি বছর সময় কাটে জাতির পিতার দুই কন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানার।

১৯৮১ সালে ভারত থেকে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। ইট কাঠের ঢাকা খুব একটা না বদলালেও ততোদিনে বদলে গেছে একজন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পুরো পৃথিবী।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এজেডএস

ওয়াজেদ মিয়া রাহাত মিনহাজ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর