আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই—শেখ হাসিনা
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩৪
১৯৪৭ সালে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে কোনো মিল না থাকার পরও শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে ১২শ মাইল ব্যবধানের দুটি পৃথক ভূখণ্ডকে এক করে পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। অন্যদিকে শুধু ৭.২ শতাংশ মানুষ কথা বলত উর্দুতে। সেই উর্দুকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জোর পাঁয়তারা শুরু করে। কিন্তু বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তা হতে দেয়নি।
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, “‘১৯৪৮ সাল ফেব্রুয়ারি ৮তারিখ (সম্ভবত) করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলী) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ও আলোচনা চলছিল। বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। ’ আমরা দেখলাম বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, ‘বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। ’ আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করা হলো।”
‘বাংলা ভাষা’র এই দাবি দিবসকে সফল এবং আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান (ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ/মার্চ ১৯৪৮-এর প্রথম সপ্তাহে) খুলনা দৌলতপুরসহ দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে ছাত্র সমাবেশ করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে, খুব মারপিট হয়। কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম। উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনকে গতিশীল এবং কমিটি গঠন করার লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে ছাত্রছাত্রী সমাবেশ করে ভাষণ দিয়েছিলেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে খুলনা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। খুলনার দৌলতপুরে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বাঙলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি এবং দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলা হয়। শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে ১১ই মার্চ বাংলাভাষা দাবি দিবসকে সফল করার জন্য সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে পিকেটিংয়ের এলাকা নির্ধারণ ও কে কোথায় নেতৃত্ব দিবে সে বিষয়ে নির্দেশনা দিলেন। তিনি বলেছেন, ‘১১ই মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোষ্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। নয়টায় ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হলো। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াদুদ গুরুতর রূপে আহত হলো। ১৯৪৮ এর ১১ মার্চ সকাল ১০টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
১৯৪৮ এর ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত আমতলায় শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে বাংলা ভাষার দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মিটিং শেষে তিনি ছাত্রদের নিয়ে স্মারকলিপি দেন। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘১৬ তারিখ সকাল দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র সভায় আমরা সকলেই যোগদান করলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হল। ১৯৫১ খ্রি. খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন নুরুল আমীন। ইতোপূর্বে ছাত্র আন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যাবতীয় দাবি মেনে নিতে তিনি সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়ে ১৯৫২ খ্রি. জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এসে পল্টনের জনসভায় ঘোষণা দিলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। এই ঘোষণার প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হরতালের ডাক দেওয়া হয় এবং মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা খালেক নেওয়াজ খানের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সমাবেশ করা হয়। এ বিষয়ে শেখ মুজিব বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হয়ে ২৬ জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করলেন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে। তখনই প্রতিবাদের ঝড় উঠল।
আন্দোলন সংগ্রামের সপক্ষে মিছিল মিটিং প্রতিবাদ সমাবেশ করে ছাত্র জনতাকে উসকে দেওয়ার অপরাধ খাড়া করে পুলিশ শেখ মুজিবকে ১৯৪৯-এর ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে সাজা দেওয়ার প্রতিবাদে আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়ে অনশন শুরু করলে পাকিস্তান সরকার তাকে এবং জনাব মহিউদ্দীন সাহেবকে ঢাকা কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করে। তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি ৫২-তে ফরিদপুর কারাগারে পৌঁছান। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ থেকে এক টানা ১২ দিন তিনি আমরণ অনশন পালনকালে সরকার বাধ্য হয় তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মুক্তি আদেশ পড়ে শুনানোর পর ফরিদপুর জেলে অনশন সঙ্গী মহিউদ্দীন সাহেব দুই চামচ ডাবের পানি মুখে দিয়ে তার অনশন ভঙ্গ করান। তিনি এতো অসুস্থ হয়েছিলেন যে বাঁচার মতো আশা ছিল না। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান অতিকষ্টে কয়েকদিন ধরে বাড়ি নিয়ে যান। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘পাঁচদিন পর বাড়ি পৌঁছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। ‘হাসু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, “আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। ”
ভাষার দাবিতে ১৯৫২ খ্রি. মে মাসে শেখ মুজিব একাই পাকিস্তান যান। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদুল হক ওসমানী এবং জেনারেল সেক্রেটারি শেখ মঞ্জুরুল হক দলবল নিয়ে তাকে অর্ভ্যথনা জানান। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ সতীর্থ রাজনীতিকগণের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষা আন্দোলন, নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন বিষয়গুলো তুলে ধরেন এবং কয়েকস্থানে সভা করেন ও প্রেস কনফারেন্স করে নির্যাতন বন্ধ এবং তদন্ত ও বিচারের দাবি জানান। তিনি (তৎকালীন) প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনে জেলে আটককৃত নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানিয়ে বলেন, ‘আমি তাকে অনুরোধ করলাম, মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আবুল হাশিম, মাওলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, খান সাহেব, ওসমান আলীসহ সমস্ত কর্মীকে মুক্তি দিতে। আরও বললাম, জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি বসাতে, কেন গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছিল। পরে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন এবং সাংগঠনিক কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৯৫২-এর অক্টোবরে চীনের জাতীয় সম্মেলনে আত্মপ্রত্যয়ী বাঙালি শেখ মুজিব ভাষণ দিয়ে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ১৯৫৩-এর একুশের প্রথম বার্ষিকী উদ্যাপনে শেখ মুজিব অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আরমানীটোলায় অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার জোর দাবি জানান।
১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা ১ মিনিটে শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালের আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যথেষ্ট রক্ত দিয়েছি। আর আমরা শহীদ হওয়ার জন্য জীবন উৎসর্গ করব না। এবার আমরা গাজী হব। সাত কোটি মানুষের অধিকার আন্দোলনের শহীদানের নামে শপথ করছি যে আমি নিজের শরীরের শেষ রক্তবিন্দু উৎসর্গ করব। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামে নিয়োজিত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকদের কারাগারে ৪৬৮২ দিন জেল খেটেছেন। তবু তিনি মাথা নত করেননি অন্যায়ের কাছে। একুশের চেতনায় মাথা নত না করার প্রত্যয় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া।
বিশ্বসভায় বাংলাভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে জাতির পিতা ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন যা অনুসরণ করে প্রতিবছর সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৯সালে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন ১৭ নভেম্বর নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। এই দিনে ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের ভাষা আন্দোলনকে পৃথিবীর মানুষের গৌরবিত উত্তরাধিকারে রূপান্তরিত করেছে। ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি তেমনি পালিত হচ্ছে পৃথিবীজুড়ে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কেবল বাংলা ভাষাই নয়, গোটা বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল সব ইতিহাসই এখন উঠে আসবে বিশ্ব-মানুষের সামনে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা আমাদের জাতিগত পরিচয় এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসকে আরো গৌরবোজ্জ্বল ও মহীয়ান করেছে।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই
‘আব্বা- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’-শেখ হাসিনা ইতিহাস তাজিন মাবুদ ইমন ফিচার