স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উড়ানো হয়েছিল যেদিন
২ মার্চ ২০২৪ ১৭:২৭
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্মরণ করে আজ (২ মার্চ) পালিত হয়েছে ঐতিহাসিক পতাকা উত্তোলন দিবস। এই দিবসটিসহ আরও কিছু দিবসের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস জড়িয়ে আছে ওতোপ্রোতভাবে। এই বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে এই পতাকা উত্তোলন দিবসের প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস নিয়ে কিছু কথা জেনে নেই। কী ঘটেছিল এই পতাকা উত্তোলন দিবসে? ১৯৭১ সালের ২ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলে ঢাকার রাজপথ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নেতাদের উদ্যোগের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হয়। তৎকালীন ডাকসু ভিপি ও ছাত্রলীগ নেতা আসম আব্দুর রব সর্বপ্রথম মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন। ওই সময় নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ ছাত্রনেতাদের পাশাপাশি সাহসী ছাত্রসমাজ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম পতাকাটি প্রদর্শিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের গাড়ি বারান্দার উপর থেকে। সময়টা ২মার্চ সকাল ১১টার পর। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশ থেকে এই পতাকা ওঠানো হয়।
তবে পরবর্তী সময়ে পতাকা উত্তোলন দিবসকে ঘিরে বিভিন্ন সময়ে ইতিহাস যেভাবে বিকৃত হয়েছে তা অবিশ্বাস্য! আনুষ্ঠানিকতা বিবর্জিত এ পতাকা প্রদর্শন নিয়ে বিতর্কের সূচনা করেছিলেন আসম রব এবং তার পরিসমাপ্তি কবে ঘটেছিল বা ঘটবে তাও জানিনা। আসম রব এর সকল কৃতিত্ব তাদের নেতা সিরাজুল আলম খান ও সিরাজপন্থীদের অকাতরে ঢেলে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে শুধু কিঞ্চিতকর নয় আজ্ঞাবহের পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল। অবশ্য কাজী আরেফ ও আবদুর রাজ্জাক তাদের জীবদ্দশায় নিদ্বির্ধায় স্বীকার করেছেন যে এ সকল কর্মকাণ্ডের পেছনে সবসময় ও সর্বত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তার সম্মতি ব্যতিরেকে কোন কর্মসূচিই পালিত হয়নি।
তবে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নিয়ে বিতর্ক নেই। ১লা মার্চ ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের সংসদ অধিবেশন বাতিলের ঘোষনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে এই পরিষদ গঠিত হয়েছিল যাতে ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহ-সভাপতি আসম রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুস কুদ্দুস মাখন। এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই সেই সময় থেকে বিজয় দিবস পর্যন্ত ছাত্রদের পক্ষে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বহুল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। এই দিনটির গুরুত্ব কম নয় বরং বলা যায় এটা ছিল স্বাধীনতার প্রশ্নে ছাত্রপক্ষীয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। সভাটি ছিল আনুষ্ঠানিক এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সর্বসম্মতিতে ইশতেহার পাঠ করে শাহজাহান সিরাজ দু’বার- একবার বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে পৌছার পূর্বে আর একবার বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে পৌঁছার পরে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি দিয়ে ২ মার্চ প্রদর্শিত পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সম্মেলন শুরু হয়। সেদিন স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বার্থহীন উচ্চারণ হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে ভূষিত করা হয়। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি তার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বটতলায় সভা আহ্বান করে। মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে সেই সভায় স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। বাণিজ্য বিভাগের তদানিন্তন লেকচারার আবদুল মান্নান চৌধুরী তা উত্থাপন করেন এবং তাকে সমর্থন করে বক্তব্য দেন দুর্গাদাস ভট্টাচার্য ও শহিদউদ্দিন আহমেদ। ওই সভায় সর্ব সম্মতিক্রমে ৬ দফার স্থলে এক দফার দাবি মান্নান চৌধুরী উত্থাপন করলে তা বিনা বাক্যব্যয়ে গৃহীত হয়। প্রস্তাব গৃহীত হলে তা পাঠ করেন প্রস্তাবের উপস্থাপক। বঙ্গবন্ধুর উৎসাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শিক্ষকদের এ সভা ডাকা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ ও পরবর্তী আলোচনায় এ কথা স্পষ্ট হয় যে সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। এ কথা বঙ্গবন্ধু ২৮ তারিখেই তার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুল মান্নান চৌধুরীকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়ে প্রস্তুতির পরামর্শ দেন। বঙ্গবন্ধুর সেই পরামর্শের প্রতিফলন ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত সভায়। সকাল ১০-১১ টায় অনুষ্ঠিত সভাটির পরই সারাদেশের শিক্ষক সমাজ স্বাধীনতার প্রস্তুতিতে নেমে যায়।
এরপর ২৩ মার্চ তারিখে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ দিবস’ পালিত। ২ মার্চ প্রদর্শিত পতাকাটি শিল্পী কামরুল হাসানের পরিমার্জিত ডিজাইন অনুসারে তৈরি করে সেদিন তা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয়। সেখানে পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা এবং গান স্যালুট দেওয়া হয়। এই দিনটিকে বরং পতাকা দিবস পালনের জন্য আন্দোলনরত শীর্ষ নেতাদের সম্মতি রয়েছে। এই দিন পতাকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর কাছে অর্পিত হয় এবং তিনি সেটা সানন্দে ১৯৭০ সালের ৭ জুনের মত গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত ডিজাইনের পতাকাটি আমাদের জাতীয় পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইতিহাস-ঐতিহ্য ফিচার স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উঠেছিল যেদিন