Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শহীদ শিশু শঙ্কু এবং রংপুর

ফরহাদুজ্জামান ফারুক
৩ মার্চ ২০২৪ ২০:৩৮

স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ শঙ্কু সমাজদার। যার রক্তে রক্তাক্ত হয়েছিল রংপুরের মাটি। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল বিদ্রোহের আগুন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল মুক্তির সংগ্রাম আর স্লোগানে। একাত্তরের ৩ মার্চ পূর্ব ঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়ায় কথা থাকলেও হঠাৎ করেই কোন কারণ ছাড়া পাকিস্তানি শাসক প্রধান ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। এই হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় ৭০’র নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া আওয়ামী লীগসহ সারা বাংলার মানুষ।

বিজ্ঞাপন

২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। ৩ মার্চ কারফিউ ভেঙ্গে রংপুরেও হরতাল পালিত হয়। সেই অসহযোগ আন্দোলনে বিক্ষোভ মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন শঙ্কু সমাজদার। ১২ বছর বয়সী এই শহীদের নাম গেজেটভুক্ত হলেও সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না তার পরিবার।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, পাকিস্তানি দখলদারদের শোষণ-শাসন এবং ষড়যন্ত্রের খপ্পর থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধুর আহবানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল রংপুরের মানুষ। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ যুবক, ছাত্র, কৃষক, দিন মজুর, নারী পুরুষসহ সর্বস্তরের জনতা কারফিউ ভাঙ্গার জন্য রংপুর শহরের কাচারি বাজারে সমবেত হয়েছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম গোলাপ, অলক সরকার, মুকুল মুস্তাফিজ, নূর উর রসুল চৌধুরী, হারেস উদ্দিন সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, মুসলিম উদ্দিন (মুসলিম কমিশনার), আবুল মনসুর আহমেদসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। ওই দিন সকাল নয়টায় ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র শঙ্কু সমাজদার তার বড় ভাই কুমারেশ সমাজদারের হাত ধরে গুপ্তপাড়ার বাসা থেকে বেড়িয়ে ছিলেন মিছিলে অংশগ্রহনের জন্য। বিভিন্ন এলাকা থেকে কারফিঊ ভাঙতে শত শত ছাত্র-নেতাদের সাথে মিশে গিয়েছিল আমজনতা।

হাজারও মুক্তিকামী সাহসী বাঙালি সেই মিছিলে উচ্চারিত হতে থাকে- ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব-শেখ মুজিব। ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ মিছিলটি শহরের তেঁতুলতলা (বর্তমান শাপলা চত্ত্বর) এলাকায় আসতেই কলেজ রোড থেকে কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি শহীদ মুখতার ইলাহি, জিয়াউল হক সেবুসহ অন্যান্যদের নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল এসে যোগ হয় মূল মিছিলের সাথে। কথা ছিল মূল মিছিল তেঁতুলতলা থেকে ফিরে যাবে। কিন্তু কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের চাপে নেতৃবৃন্দ মিছিলটি আলমনগর স্টেশনের অবাঙালি বিহারি ক্যাম্পের দিকে এগুতে থাকে। মিছিলটি আলমনগর এলাকার অবাঙ্গালী ব্যবসায়ী সরফরাজ খানের বাসার সামনে যেতেই এক কিশোর ঐ বাসার দেয়ালে একটি উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ড দেখে তা নামিয়ে ফেলতে যান ছুটে যায়। আর তখনই বাসার ছাদ থেকে মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন ভাইয়ের হাত ধরে মিছিলে আসা স্কুলছাত্র শঙ্কু সমজদার। গুলির বিকট শব্দে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মাটিয়ে লুটিয়ে পড়া গুলিবিদ্ধ কিশোর শঙ্কুকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

পথেই কিশোর শঙ্কু মারা গেছেন। এদিকে শঙ্কুর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ক্ষোভের আগুনে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পুরো রংপুর। গুলিবিদ্ধ কিশোর শঙ্কুর রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখে জনতা উত্তেজিত হয়ে সারা শহরে অবাঙ্গালীদের দোকান ভাংচুর, সামগ্রী রাস্তায় এনে আগুন দিতে থাকে। যে বাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছিল সেই বাড়িতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করার সময় ইপিআর এসে বাধা দেয়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওইদিনে আরও দুইজন নিহত হয়েছেন অবাঙ্গালীদের হাতে। তাদের একজনের নাম আবুল কালাম আজাদ। যাকে গিনি এক্সচেঞ্জের (বাটার গলির পাশের মূল সড়কের সাথেই, বর্তমান রেইনবো প্লাজা) সামনে এক অবাঙ্গালী গুলি করে হত্যা করে। অপরজন ওমর আলী। বাসা শহরের মুলাটোলে। তিনি জেনারেল বুট হাউসের (ঢাকা হোটেলের গলির পাশে, টাইম হাউস, ক্রোকারিজ মার্কেটের বিপরীতে) সামনে ছুরির আঘাতে। এছাড়াও সেদিন আরও দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।

সারাবাংলা/এজেডএস

শহীদ শিশু শঙ্কু