Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধুর যে জন্মদিনে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধি

ফিচার ডেস্ক
১৭ মার্চ ২০২৪ ১৩:৫০

নিজের জন্মদিন নিয়ে কোনদিনই খুব একটা উৎসাহ- উদ্দীপনা কাজ করতো না জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তিনি লেখেন, ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস!’ আর বাইরে থাকলেও চেষ্টা করতেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অনাড়ম্বরে পালন করতে।

প্রাণের চেয়েও প্রিয় বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর মাত্র চারটি জন্মদিন পালনের সুযোগ মিলেছিল। এর ঠিক এক বছর আগে ভয়াল একাত্তরের মার্চেই ছিল তার ৫২তম জন্মবার্ষিকী। সেদিন তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আজ আমার জন্মদিন। তবে ৫৩তম নয়। পত্রিকায় ভুল ছাপা হয়েছে, আজ আমার ৫২তম জন্মদিন।’

বিজ্ঞাপন

তখন একজন বিদেশি সাংবাদিক জন্মদিন পালনের প্রসঙ্গ তুললে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না। এই দুখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই বা কী, আর মৃত্যুদিনই বা কী? আপনারা বাংলাদেশের অবস্থা জানেন। এ দেশের জনগণের কাছে জন্মের আজ নেই কোনও মহিমা। যখনই কারও ইচ্ছা হলো আমাদের প্রাণ দিতে হয়। বাংলাদেশের জনগণের জীবনের কোনও নিরাপত্তাই তারা রাখেনি। জনগণ আজ মৃতপ্রায়। আমার আবার জন্মদিন কী? আমার জীবন নিবেদিত আমার জনগণের জন্যে। আমি যে তাদেরই লোক।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি জন্মদিন পালন করেন না। জন্মদিনে মোমবাতিও জ্বালান না, কেকও কাটেন না। ওই সময় সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের প্রত্যাশা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’

বিজ্ঞাপন

১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন। স্বাধীন বাংলার মাটিতে জাতির পিতার প্রথম জন্মদিন। তবে সেদিনও বরাবরের মতোই অনাড়ম্বর আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয় বাঙালির মুক্তির দূতের জন্মদিন। এর কারণ হতে পারে, বঙ্গবন্ধু হয়তো সেটি প্রত্যাশা করেননি বা হতে দেননি। আরও একটি কারণ ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সেদিনই উপস্থিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানকারী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ফলে দিনটি ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যেই কাটাতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। তবে সেদিন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ৫৫ কোটি ভারতবাসীর পক্ষ থেকে ফলমূল ও মিষ্টান্ন উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আয়োজনকে দিয়েছিলেন ভিন্নমাত্রা।

১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ‘বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব হউন’ শিরোনামে ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ছাত্র ও সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জাতির পিতার জন্মদিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ বেতার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কয়েকটি বিশেষ অনুষ্ঠানও প্রচার করে। সকাল ১০টায় ‘অন্তরঙ্গ সংলাপ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর বাল্যকাল এবং যৌবনকালের কথামালা প্রচারিত হয়। এতে বঙ্গবন্ধুর পিতা- মাতা, বন্ধু- বান্ধব এবং স্বগ্রামের বয়স্ক মানুষদের সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হয়। রাত একটায় বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশবিশেষ প্রচারিত হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্পোরেশন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বিশেষ অনুষ্ঠানাদি প্রচার করে। এর মধ্যে ছিল সন্ধ্যা ৬.৪০ মিনিটে ছোট ছোট ছেলে- মেয়েদের অনুষ্ঠান। ৮.৩০ মিনিটে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধুর পিতা- মাতার সাক্ষাৎকার।

সেদিন ছিল সরকারি ছুটি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজের জন্মদিন উপলক্ষে সরকারি ছুটির বিপরীতে দিনটিকে কঠোর শ্রম ও বৃহত্তর কল্যাণে আত্মনিয়োগের জন্য বিশেষভাবে পালনের পক্ষপাতি ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানার্থে সেদিন সরকারি ছুটি থাকলেও ভবিষ্যতে যেন সেটি আর না হয় সেজন্য একটি বিবৃতি দিয়েছিলন। ১৭ মার্চ ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ছুটি থাকিবে না’ শিরোনামে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল (বৃহস্পতিবার) বলেন যে, ভবিষ্যতে তাহার জন্মদিন আর সরকারী ছুটির দিন হিসেবে উদ্যাপিত হইবে না। এই দিনটি কঠোর শ্রম ও বৃহত্তর কল্যাণে আত্মনিয়োগের দিন হিসাবে পালিত হইবে।

গতকাল এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলতি বছর ১৭ই মার্চ অবশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছার প্রতীক হিসাবে সরকারী ছুটি হিসাবে পালিত হইবে।’

একই পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তাজুদ্দীন’ শিরোনামে অপর সংবাদে জানা যায়, “বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এক শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন- আজ ১৭ই মার্চ। মহান বাঙ্গালী জাতির পিতা শেখ মুজিবের জন্মদিন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠে আজ একটি মাত্র স্লোগান- জয়তু মুজিব! আর এই স্লোগানের মুহূর্মুহু ধ্বনির প্রতিধ্বনি মহান নেতার জন্মতিথিতে তাহাকে জানাইতেছে স্বাধীন দেশের প্রতিটি নাগরিকের হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধার্ঘ্য, প্রীতি, শুভেচ্ছা, আশিস, আর ভালবাসা। কামনা তাহাদের একটিই- মুজিব, তুমি দীর্ঘজীবী হও!

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আনন্দানুভূতির সাথে সাথে কোটি মানুষের হৃদয় আজ বাংলার মাটিতে আর একজনের শুভাগমনের আনন্দে উদ্বেল। তিরিশ লক্ষ নর- নারীর রক্তের আলেখ্যমাখা স্বাধীন বাংলার বুকে রক্তে রাঙ্গা রাখী বন্ধনে মিত্র মহান ভারতবর্ষে ছাপ্পান্ন কোটি মানুষের স্নেহ, প্রীতি ও ভালবাসার বাণী লইয়া শুভ পদার্পণ করিতেছেন আফ্রো- এশিয়া- ল্যাটিন আমেরিকার জনগণনন্দিত মহীয়সী নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলার ধ্বংসপূর্ণ পিঠে দাঁড়াইয়া সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর হৃদয়ের অর্ঘ্যে আজ তাহাকে জানাই স্বাগতম।

জয় বঙ্গবন্ধু- জয় শ্রীমতী গান্ধী- জয় বাংলা।”

একই দিনের খবর থেকে জানা যায় সেদিন চার ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ. স. ম. আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যৌথ বিবৃতিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে প্রধানমন্ত্রি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৫৩তম জন্মবার্ষিকীতে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেন।

১৮ মার্চ ইত্তেফাকে ‘মুক্তবাংলায় বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিনে’ শীর্ষক সংবাদ থেকে জানা যায়, “গতকাল (শুক্রবার) জাতি যুদ্ধবিধ্বস্ত, রিক্ত বাংলাদেশের বুকে অনাড়ম্বর অথচ শ্রদ্ধাবনত- চিত্তে নবীন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৩তম জন্মতিথি পালন করে।

রাজধানীর বিভিন্ন স্তরের মানুষ গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীস্থ বাসভবনে গমন করিয়া তাহাকে মালাভূষিত এবং প্রিয় নেতার দীর্ঘায়ু কামনা করে। মহান ভারতের শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ জাতির জনককে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ মহান ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি এই উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে ফলমূল ও মিষ্টান্ন উপহার দেন। ৫৫ কোটি ভারতবাসীর শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ তিনি এগুলি ভারত হইতে লইয়া আসিয়াছিলিন।

ভারতের ইন্দিরার সফর উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় তাহার জন্মদিনের অনুষ্ঠানাদি সর্বক্ষেত্রে যথাসম্ভব সংক্ষেপ করা হয়। এতদসত্ত্বেও বিভিন্ন দল ও সংস্থার পক্ষ হইতে কিছু কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হইয়াছে এবং হইতেছে।

গতকাল ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ ভাবগম্ভীর পরিবেশে এই দিনটিকে পালন করে। দলের পক্ষ হইতে ভোরে বঙ্গবন্ধুকে মালাভূষিত করিয়া দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়, যাহাতে তিনি বাঙ্গালী জাতিকে উন্নতি ও সমৃদ্ধি পথে আগাইয়া লইয়া যাইতে পারেন।”

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইতিহাস ফিচার বঙ্গবন্ধুর যে জন্মদিনে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর