নিপীড়িত জাতির নেতার কিসের জন্মদিন: বঙ্গবন্ধু
১৭ মার্চ ২০২৪ ১৪:১৯
“আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস!” এমনই সহজ সরল মানুষ ছিলেন বাঙালির স্বাধীনতার ঘোষক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তেমন ঘটা করে কখনোই নিজের জন্মদিন পালন করেননি। দেশের নিপীড়িত আর শোষিত মানুষের কথা ভেবে এই দিনটিও স্বাভাবিক দিনের মতোই পার করতেন। এ নিয়ে শেখ মুজিব বলেছিলেন, “আমি আমার জন্মদিন পালন করি না। যে জাতি অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটায়, কথায় কথায় গুলি করে হত্যা করা হয়, সে জাতির নেতা হিসেবে আমি জন্মদিন পালন করতে পারি না। নিপীড়িত জাতির নেতা হয়ে আমি কীভাবে জন্মদিন পালন করি”
দিনটিতে পরিবারের সঙ্গেই সময় কাটাতে পছন্দ করতেন বঙ্গবন্ধু। তবে দেশের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি জন্মদিন কেটেছে তার কারাগারে। তারমধ্যে ১৭ মার্চ ১৯৬৭ সালে, মহানায়কের ৪৮তম জন্মদিনটি ছিল একটু অন্যরকম।
কারাগারের রোজনামচা বইটিতে মহানায়ক লিখেছেন, “আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনদিন নিজে পালন করি নাই- বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটা উপহার দিত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস! দেখে হাসলাম।”
কারাবন্দি থেকে জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু পরিবারের কথাই ভেবেছিলেন। তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা ছিল মনে। ডায়রিতে বঙ্গবন্ধু সেদিন লিখেছিলেন, “মাত্র ১৪ তারিখে রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এসেছিল। আবার এত তাড়াতাড়ি দেখা করতে অনুমতি কি দিবে? মন বলছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালই হত। ১৫ তারিখেও রেণু এসেছিল জেলগেটে মণির সঙ্গে দেখা করতে।”
তবে শেষপর্যন্ত প্রিয়জনদের দেখা পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ডায়রিতে লিখেছেন—
“তখন সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে, বুঝলাম আজ বোধ হয় রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহুর্তে জমাদার সাহেব বললেন, চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়া রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে। ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেট থেকে। ওর সাথে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।
আর একটা কেক পাঠাইয়াছে বদরুন, কেকটার উপর লিখেছে ‘মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে।’ বদরুন আমার স্ত্রীর মারফতে পাঠাইয়াছে এই কেকটা। নিজে তো দেখা করতে পারল না, আর অনুমতিও পাবে না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘তোমার স্নেহের দান আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। জীবনে তোমাকে ভুলতে পারব না।’ আমার ছেলেমেয়েরা বদরুনকে ফুফু বলে ডাকে। তাই বাচ্চাদের বললাম, ‘তোমাদের ফুফুকে আমার আদর ও ধন্যবাদ জানাইও।’”
কারাগারে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে ফুল দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন সহবন্দি ও দলের নেতারা।
“ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম- আমার কাছে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে আমার ঘরে এসে উপস্থিত। আমাকে বলল, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার একটা রক্তগোলাপ এবং বাবু সুধাংশু বিমল দত্তও একটি সাদা গোলাপ এবং ডিপিআর বন্দি এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন।”
৮টি জন্মদিন জেলে কাটিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৭ সাল ছাড়া কারাগারের অন্যান্য জন্মদিন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্ত জীবনের জন্মদিনগুলো তেমনভাবে পালন না হলেও ৪৭ তম জন্মদিবস বেশ ভালোভাবেই পালন করেছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘জেলে থাকার কারণেই ওই বছর এমনটি হয়েছিল।’
লেখাসূত্র: কারাগারের রোজনামচা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
সারাবাংলা/এসবিডিই