Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বামীকে কেন হতেই হবে স্ত্রীর চেয়ে বয়সে বড়?


২৮ মে ২০১৮ ১২:৪১

জান্নাতুল মাওয়া।।

বলতে গেলে প্রায় সারা পৃথিবীতেই স্বামী স্ত্রীর বয়স নিয়ে একটা অলিখিত নিয়ম চালু আছে। ধরে নেয়া  হয় যদি এদের দুজনের মধ্যে একজন যদি বয়সে বড় হয়, তবে সেটি হবে  স্বামী! বিশেষত  বাংলাদেশসহ এই গোটা অঞ্চলে এই নিয়মের বাড়াবাড়ি চোখে পড়ার মত। এমনকি স্বামী যদি বয়সে স্ত্রীর সমান হন, সেটাও অনেকে সহজ ভাবে নেন না।

স্বামীর বয়স স্ত্রীর চেয়ে দশ-পনেরো বছরের বড়, এই বিষয়টা এখানে অতি সাধারণ একটা বিষয়। অথচ  স্ত্রীর বয়স স্বামীর বয়সের চেয়ে দুই তিন বছর বেশি হলেই আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। এর কারন হিসেবে উঠে আসে অনেক বিষয়। একটা বহুল প্রচলিত ধারণা হল মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যায়। যদিও বুড়িয়ে যাবার বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করে মানসিক অবস্থা এবং শরীরের যত্নের ওপর।

অনেক সময়  বয়সের পার্থক্যের কারনে দুইজনের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দুইরকম হয়ে যায়। যাকে আমরা বলি জেনারেশন গ্যাপ। এই বিষয়টি স্বামী যদি স্ত্রীর চেয়ে বয়সে অনেক বড় হয় তাহলেও হতে পারে। অনেক সময় সমবয়সীদের মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারনে এই জটিল সমস্যা চলে আসতে পারে। তবে আমাদের সমাজে স্বামীর বেশি বয়স হবার কারনে দাম্পত্য সমস্যা যে হতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে কাউকে তেমন চিন্তিত হতে  দেখা না গেলেও স্ত্রীর বয়স  দুই এক বছর বেশি হলেই সবাই সেই দম্পতির বিষয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। দেখা যায়, দাম্পত্যের সাধারণ সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রেও স্ত্রীর সেই দুই/এক বছরের বড় হবার বিষয়টি টেনে এনে কমবয়েসী স্বামীটি সবার চোখে নিতান্তই শিশুর স্নেহ পেতে শুরু করেন। যেটি এই দম্পতির সম্পর্কের ভবিষ্যতকে ভয়াবহভাবে প্রভাবিত করে।

বিজ্ঞাপন

ইমানুয়েল ও ব্রিজিত

যদিও আমাদের দেশে এবং দেশের বাইরে তারকারা, বিখ্যাত ব্যাক্তিরা সমাজের এইসব ফেনিয়ে তোলা সমস্যাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বয়সে বড় স্ত্রী কিংবা বয়সে ছোট স্বামী নিয়ে দিব্যি আনন্দে সংসার করে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ৩৯ বছর বয়েসী এই রাষ্ট্রপতি  সমাজের সকল ধরণের কানাঘুষো এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের টিটকারিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তার ৬৪ বছর বয়েসী স্ত্রী ব্রিজিতের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছেন। শুধু তাই নয় তার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ফ্রান্সে ফার্স্ট লেডি পদটিকে রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়েছে।

আমাদের দেশে বিখ্যাত অভিনেত্রী  সুবর্ণা মুস্তাফা  পরিচালক বদরুল আনাম সৌদকে বিয়ে করে গোটা দেশে হাহাকার ফেলে দিয়েছিলেন! কারণ পাত্র সুবর্ণার চেয়ে বয়সে ১৫ বছরের ছোট!

খুব সম্প্রতি ব্রিটিশ রাজপুত্র হ্যারি বিয়ে করলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী মেগান মার্কেলকে। মেগান হ্যারির চেয়ে বয়সে তিন বছরের বড়। সুদূর বৃটেনের রাজপুত্রের বয়সে বড় নারীকে বিয়ে করার এই ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে।

যদিও এদেশে অগণিত পুরুষ বিনা দ্বিধায় নিজের চেয়ে বিশ পঁচিশ বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে। কোথাও কোনরকম সামাজিক গোলযোগ তৈরি হয়না। তবে এখন অনেক ছেলে মেয়েই সমবয়সীকে বিয়ে করছে। একসময় সমবয়সী বিয়েতেও যে আতঙ্ক বিরাজ করতো সেই আতঙ্ক কমে এসেছে। তবে মেয়ের বয়স ছেলের চাইতে বড় হবে, এই বিষয়টি এখনও অনেকেই হজম করে উঠতে পারেন না। কথা বলেছিলাম এমন দুইজন নারীর সাথে যারা বয়সে স্বামীর চেয়ে বড়।

বিজ্ঞাপন

মেরিনা আকতার (ছদ্মনাম)  তার স্বামীর চেয়ে  ছয় বছরের বড়। তাদের  তিন বছরের বিবাহিত জীবন। আশপাশের মানুষের কাছ থেকে এই বিষয়ে কেমন আচরণ পান জানতে চাইলে মেরিনা বলেন,   আমরা কখনো সেভাবে কাউকে জানাতেই যাইনি যে আমার বয়স ওর  চেয়ে বেশি। যার ফলে সরাসরি কোনরকম আজেবাজে কথার মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে বিয়ের আগে আমার বাবার বাড়ির যারা জেনেছেন তাদের অনেকেই নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে আমি তাড়াতাড়ি  বুড়িয়ে যাবো। ফলে স্বামী বহির্মুখী হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল! অথচ গত  তিন বছর সংসার করতে গিয়ে দেখি সে আমার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক ম্যাচিওরড। কখনোই মনে হয়নি আমি ওর চেয়ে বড়। এমন কি শারিরীক চাহিদাও আমার কোন অংশেই কম নয়। মূলতঃ আমার বয়স বেশি বলে শারিরীক কোন সমস্যায় আমাদেরকে পড়তে হয়নি এখনো। আমি প্রকৃতিগতভাবে অনেক হুল্লোড়বাজ। আমার মনে হয় আমার স্বামী যদি আমার চেয়ে বয়সে বড় হত তাহলে বেশ সমস্যা হত। সে  ভেবে বসতো যে আমি আদিখ্যেতা করছি বা আমি অকারন লাফাচ্ছি।

মেরিনার মতে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতির মূল কারন হল মানসিক গ্যাপ, যা একটা পর্যায়ে শারিরীক গ্যাপেরও কারন হয়ে দাঁড়ায়। আর এই গ্যাপ কিন্তু যে কোন বয়সের স্বামী স্ত্রীর মধ্যেও হতে পারে। এমন না যে স্বামী বয়সে বড় হলে এই গ্যাপ হয়না।  তিনি বলেন, দুইজন মানুষের সম্পর্ক অর্ধেকেরও বেশি নির্ভর করে ওই দুজন মানুষের উপর, বাকি কিছু বিষয়ে আশপাশের মানুষের ইন্ধন হয়তো  কাজ করে। তবে সম্পর্কের মূল ভিত দাঁড়িয়ে থাকে দুইজনের উপরই।

মেরিনা আরো বলেন, একটি বিষয় বলি, বয়সে ছোট বলেই কি না জানিনা, আমার স্বামী হুট করেই  রিঅ্যাক্ট করে ফেলে। অনেক লোকের মাঝেও রেগেমেগে হুট করে বেমক্কা কথা বলে ফেলে। অন্যদিকে আমি বেশ ধীরস্থির। তবে এটা তো যেকোন স্বামী স্ত্রীর সাধারণ সমস্যা।

কথা হয় উদ্যোক্তা রুখসানা রশীদের সাথে। রুখসানা তার স্বামীর চেয়ে সাড়ে তিন বছরের বড়।  তিনি বলেন,  আমার ক্ষেত্রে বাইরের চাপ অনেক বেশি ছিলো। যখন আমাদের এই সম্পর্ক হয় তখন থেকেই আমার বয়স বেশি এই  কারনে বাইরের থেকে  এত বেশি চাপের মুখে পড়েছিলাম যে হুট করে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো আমার শ্বশুরবাড়ির পরিবার এবং আমার পরিবার একত্র হয়নি।  বিয়ের নয়মাস পর আমাকে এবং আমার স্বামীকে আমার শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াত করেছিলো। আমার শ্বাশুড়ি বলেছিলেন, বউকে আদর করতাম যদি বয়সে ছোট হত! অথচ এমন না যে আমি একজন বৃদ্ধ। বয়সে বরের চেয়ে তিন বছরের বড় হলেও বউ হিসেবে তো আমি বুড়ি নই যে আদর করা যাবেনা!

রুখসানা বলেন, পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে ব্যাক্তিগত বিষয়গুলোতে  আমার বয়স আমার স্বামীর চেয়ে বেশি বলে তেমন কোন সমস্যায় আমরা পড়িনি। হ্যাঁ, আমার স্বামী সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। তবে এটি বয়সের জন্যে বলে আমার মনে হয়না। সে বাড়ির ছোট ছেলে বলে তাকে কখনো  সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি। তাই এমনটি হয়েছে। আর  এটি কোন গুরুতর সমস্যাও নয়।

তবে রুখসানা এবং মেরিনা দুইজনই অর্থনৈতিক বিষয়টির ওপর বেশ জোর দিয়েছেন। রুখসানা  বলেন, বিয়ের পরে বেশ কয়েক বছর ঘরের পুরো অর্থনৈতিক দায়িত্ব আমার ওপরেই ছিলো। এ সময়টাতে আমিও কখনো হুট করে উল্টাপালটা কথা বলিনি যেটা তাকে আঘাত করে। আবার সে-ও কোন নেতিবাচক আচরণ প্রকাশ করেনি।

এক্ষেত্রে রুখসানা মনে করেন এমন সম্পর্কের ক্ষেত্রে  মেয়েদের বেশ বড় একটা  দায়িত্ব রয়েছে এই অর্থনৈতিক অবস্থায় মানিয়ে নেয়ার ব্যাপারে। আমাদের সমাজে মেয়েদের মাইন্ডসেট তৈরি হয়েছে এমনভাবে  যে তারা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়  ছেলেটাই বেশি উপার্জন করবে। ছেলেটা সংসারের হাল ধরবে। আশেপাশের মানুষেরা এবং নিকটজনেরাও এর উল্টোটা হলে বেশ নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে।  অথচ যখন কম বয়সের ছেলেকে বিয়ে করছো তখন তো স্বাভাবিকভাবেই ছেলেটা স্ট্রাগলিং পিরিয়ডে আছে। সেই সময়টা তুমি তার  পাশে না থাকলে পরে আর এই সম্পর্কের তার জোড়া নাও লাগতে পারে।

ঠিক একই কথাই মেরিনাও বলেন। তিনি বলেন, স্বামী বয়সে ছোট হলে স্ত্রীদের এই কথা মাথায় রাখতে হবে যে সে কিন্তু সমাজের আর দশজন বয়সে বড় স্বামীর  মত অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারবেনা। এটা মেনে নিয়েই সংসার করতে হবে। আমাদের সমাজে ছেলেদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় সেই কর্তা, সেক্ষেত্রে বয়সের কারণে যদি কর্তৃত্ব কিছুটা হাত ফস্কে যায় তাতেও সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন মেরিনা।

সুবর্ণা ও সৌদ

স্বামীর চেয়ে স্ত্রী বয়সে বড় হলে আসলেই শারিরীক কোন সমস্যায় পড়তে হয় কি না জানতে চাইলে কুমুদিনী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধাপক ডাক্তার বিলকিস বেগম চৌধুরী বলেন, বয়স বাড়তে বাড়তে আমাদের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেমন দুর্বল হয়ে যেতে থাকে তেমনি ব্যাপার ঘটে আমাদের জরায়ুসহ অন্যান্য যৌনাঙ্গের ক্ষেত্রেও।  আমাদের বয়স যখন চল্লিশ পেরোয় ধীরে ধীরে শরীরের এস্ট্রোজেন হরমোন কমতে থাকে। যার প্রভাব আমাদের যৌনাঙ্গেও পড়ে। অনেকের এই সময় যৌন ইচ্ছা কমে আসে। তবে এই বিষয়টা যতটা শারিরীক তার চেয়েও বেশি  মানসিক বলে মনে করেন বিলকিস চৌধুরী। তিনি বলেন,  এইসময় পুরুষ সঙ্গী যদি স্ত্রীকে বোঝে, সে যদি নারী শরীরকে শুধুই ভোগের নয় ভালোবাসার সাথে আপন করে নেয় তাহলেই  অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। দেশের বাইরে অনেক  সত্তর  বছরের বেশি বয়সী নারীও সেক্সুয়ালি একটিভ থাকেন। পরিমিত কাজ এবং যথেষ্ট বিনোদনমূলক কাজে যুক্ত  থাকলে মেনোপজের পরেও সেক্সুয়ালি একটিভ থাকা যায়। এর জন্যে সবচেয়ে বেশি  দরকার সঙ্গীর সহযোগিতা, ভালোবাসা আর দুজনের মানসিক সংযোগ।

ড. বিলকিস আরও জানান তার কাছে অনেক রোগীই মেনোপজ পরবর্তী মানসিক আর পারিবারিক নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা বলেন। মজার ব্যাপার হল এই স্ত্রীরা কেউই স্বামীর চেয়ে বয়সে বড় নয়। তার মতে, আসলে স্ত্রী বয়সে ছোট হলেও কিন্তু এই অধ্যায়টার  মুখোমুখি হতেই হবে একটা সময়। শরীরকে ছাপিয়ে দুজন মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া আর ভালোবাসাটা যদি অটুট থাকে তাহলে এটি আসলে কোন সমস্যাই না বলে মনে করেন ডাক্তার চৌধুরী।

সারাবাংলায় প্রকাশিত “বিয়ের বয়স কে ঠিক করে, কেন ঠিক করে” ফিচারে উঠে এসেছে যে বিয়ের সম্পর্কটা অনেকক্ষেত্রেই রাজনৈতিকও বটে। যেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষটি হবে নিয়ন্ত্রক। সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর বয়স বেশি হয়ে গেলে নিয়ন্ত্রণের লাগাম হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয় রয়েছে সমাজের। আর তাই স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর বয়স বেশি হলে সমাজ উসখুস করতে থাকে, নানান কল্পিত সমস্যার বীজ বুনে দেয় স্বামী স্ত্রীর দুজনের মনেই। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে দুজনের দাম্পত্যে।

বিয়ের মত একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রকৃত অর্থে সফলতা আর সুখি রূপ দিতে চাই দুজনের মানসিক যোগাযোগ, বোঝাপড়া এবং ভালবাসা। এক্ষেত্রে কার বয়স কত, কে বড় কে ছোট- এ ধরণের বিষয় কোন প্রভাব সুখি দাম্পত্যের ক্ষেত্রে রাখতে পারে না। রক্ষণশীল সমাজই এইসব পুরোনো ধারণা জিইয়ে রাখে, যা দ্রুত ভেঙ্গে ফেলার সময় এসেছে।

 

 

সারাবাংলা/জেএম/এসএস

 

 

 

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর