Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যে রাতে নিমতলীতে আগুনরূপী মৃত্যু নেমেছিল

ফিচার ডেস্ক
৩ জুন ২০২৪ ১৭:৩০

২০১০ সালের ৩ জুন রাত ৯টা। রাজধানীর চানখারপুলের নিমতলীতে একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন ধরে যায় পাশের প্লাস্টিক কারখানায়। কারখানাটিতে ছিল দাহ্য ক্যামিকেলের গোডাউন। মূহুর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বেশ কটি ভবনে। সেই ভবনগুলোতেও ছিল বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ ও ক্যামিকেল। ফলে ভয়ংকর সেই আগুন সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।

চোখের সামনে বহু মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। প্রাণ হারান ১২৪ জন। আহত প্রায় অর্ধশতাধিক। পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা।

বিজ্ঞাপন

সে রাতে যেন মৃত্যুর বাড়িতে পরিণত হয়েছিল পুরান ঢাকার নিমতলী। আহতদের মধ্যে যারা বেঁচে আছেন, শুধু তারাই বলতে পারবেন মৃত্যুর বিভীষিকা কী ভয়ংকরভাবেই না ফুটে উঠেছিল তাদের চোখের সামনে!

পুরান ঢাকাকে নিয়ে একটি প্রবাদ আছে, বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি। সেই আদি প্রবাদ একবিংশ শতাব্দীতেও বহাল রয়েছে। সেদিন রাতে নিমতলীতে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের অনেকগুলো ইউনিট ছুটে আসে। কিন্তু সরু রাস্তার কারণে তারা গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা হতাশার সুরে বলেন, রাস্তা সরু থাকায় পাইপ নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সক্ষম হননি। দ্রুত কাজ শুরু করতে পারলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আরও কম সময় লাগত। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কমানো যেত।

নিমতলী ট্রাজেডি আলোড়ন ফেলেছিল দেশজুড়ে। আগুনে পুড়ে এতোসংখ্যক বীভৎস করুণ মৃত্যু যে স্মরণাতীতকালে দেখেনি বাংলাদেশ।

নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে স্বজন হারিয়েছিলেন রুনা, রত্না ও আসমা। মা-বাবাসহ স্বজন হারানো এই মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগেই গণভবনে তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। এখনও তারা সবার কাছে শেখ হাসিনার মেয়ে বলেই পরিচিত।

বিজ্ঞাপন

আজও সেই ভয়াল ৩ জুন আসলে ভয়ে কুঁকড়ে উঠেন নিমতলীবাসী, স্বজনদের মনে করে আহাজারিতে ভেঙে পড়েন।

নিমতলী দুর্ঘটনার পর আবাসিক এলাকা থেকে সব ধরনের রাসায়নিক পদার্থের দোকান, গুদাম ও কারখানা অপসারণ করার কথা হয়েছিল। আজ ১৩ বছর পার হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এরপরেও পুরান ঢাকায় আরো আগুন লেগেছে। লাশের মিছিল দেখেছে পুরান ঢাকাবাসী। নিমতলী থেকে চকবাজারের চুড়িহাট্টা, এরপর আরমানিটোলা। প্রতিনিয়ত পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। প্রশ্ন উঠেছে, বার বার কেন এতো দুর্ঘটনা? এত প্রাণহানি? এই দায় কার? কবে এই অবস্থা থেকে স্থায়ী পরিত্রাণ মিলবে তা আজও অজানা। পুরান ঢাকার বাড়িতে বাড়িতে এখনও আছে কেমিক্যাল গুদাম। বিশেষ করে এখানকার ঘিঞ্জি এলাকায় কেমিক্যাল কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি যেন মেনেই নিয়েছে সবাই। এই ঝুঁকি এড়াতে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।

প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরপরই একাধিক সংস্থা তদন্ত কমিটি গঠন করে। শুরু হয় নানা রকম আলোচনা। আগুনের সূত্রপাত, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও বেশকিছু সুপারিশ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু মাস ঘুরে বছর যায়, সেই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয় না। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মামলা হয়নি। আবার দুএকটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ীদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, দুই দশকে বাংলাদেশে শিল্পকারখানায় ২৬টির বেশি দুর্ঘটনায় দুই হাজারের মতো শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আর গত ১৪ বছরে শুধু পুরান ঢাকায় পৃথক ঘটনায় অন্তত দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৫টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে মাত্র ৩টি ঘটনার পর মামলা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা গেলেও তারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় উঠে এসেছে পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসা-বাড়িতে। মাত্র আড়াই হাজার গোডাউনকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের মতো গোডাউন অবৈধ। এসব গোডাউনে ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে। পুরান ঢাকার এসব গোডাউনে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল-ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইলসসহ আরো অনেক ধরনের রাসায়নিক। ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনের ৯৮ ভাগই অবৈধ। ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো কামরাঙ্গীচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য পৃথক দুই জায়গায় ১৭টি ভবন তৈরি করা হচ্ছে।

এ ছাড়াও প্রতিনিয়ত পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। প্রশ্ন উঠেছে, বার বার কেন এতো দুর্ঘটনা? নিমতলী ট্র্যাজেডির পর কেরানীগঞ্জে ৫০ একর জায়গায় কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক করার সিদ্ধান্ত হয়। চুড়িহাট্টার পর তা সরিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত হয় মুন্সিগঞ্জে। তবে ১৩০৭ কোটি টাকার এই প্রকল্প শেষ হয়নি আজও। এখন পুরান ঢাকায় অনুমোদিত রাসায়নিকের গুদাম আছে অন্তত ২ হাজার। তবে নতুন করে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রেখেছে সিটি করপোরেশন। কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের পরপরই একাধিক সংস্থা তদন্ত কমিটি গঠন করে। শুরু হয় নানা রকম আলোচনা। মারা গেলেই কেবল নানা রকম কথা হয়। কিন্তু আজও এর সুরাহা হয়নি। কবে হবে তা-ও জানেন না কেউই!

সারাবাংলা/এসবিডিই

যে রাতে নিমতলীতে আগুনরূপী মৃত্যু নেমেছিল