Thursday 28 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছোট্ট লিলিবেট থেকে অটল এক রাণী হওয়ার গল্প


২ জুন ২০১৮ ১৬:১৭

।।মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর।।

১৯৫১ সাল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিপতি ষষ্ঠ জর্জ শয্যাশায়ী। তার উপর দিয়ে গিয়েছে ২য় বিশ্বযুদ্ধের ধকল। তার বড় মেয়ে রাজকুমারী এলিজাবেথ বয়স ২৫ বছর। বাবার হয়ে জনসংযোগের কাজ করছেন। এই কাজেই কানাডা আর আমেরিকায় ছিলেন তিনি। অক্টোবরের পাতা ঝরা রাঙা এক শরৎ-এ এলিজাবেথের একান্ত সচিব মার্টিন চার্টারিস একটি বার্তা নিয়ে আসেন, তাতে লেখা রাজকুমারী এলিজাবেথের সফরের সময় তার বাবা মারা গেছেন, এটা ছিল একটা খসড়া বার্তা, রাজার শরীর এতই খারাপ ছিল যে খসড়া বার্তা সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন রাজকুমারী এলিজাবেথ। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এমনই এক সফরে কেনিয়া ছিলেন এলিজাবেথ। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ। খবর আসে, রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর।

বিজ্ঞাপন

১৯৫৩ সালের ২ জুন, রাজ্যাভিষেক হচ্ছে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের

রাজা ষষ্ঠ জর্জের পরে তার কন্যা এলিজাবেথই ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি। ততদিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তগামী। ২৫ বছরের এলিজাবেথ তাকেই নিতে হবে এই বিশাল সাম্রাজ্যের ভার। তিনিই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম রাণী নন যিনি প্রধান হিসেবে রাজ্য পরিচালনা করতে যাচ্ছিলেন। তার আগে সেই ১৬শ শতকে রাণী প্রথম এলিজাবেথ আর মাত্র ১৮ শতকেই রাণী ভিক্টোরিয়া রাজ্য চালিয়েছেন সাফল্যের সঙ্গে।

রাজ্যাভিষেকের পোশাকে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ

ত১৯৫২ সাল রাণী হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় আসলো রাজকুমারী এলিজাবেথ অ্যালেক্সেন্ড্রা মেরির। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি রাজ্যভিষেকের সময় তার নাম বদলাবেন কি-না। সাধারণত নিজেদের শাসনকালকে চিহ্নিত করার অন্য রাজা-রাণীরা তাদের এমন একটা নাম নেন যেটা আগে কখনও কারও ছিল না। রাজকুমারী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজের ‘এলিজাবেথ’ রেখেই রাজ্য পরিচালনা শুরু করবেন। ১৬শ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম রাণী এলিজাবেথকে সামনে রেখে শুরু হলো রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্য চালনা। আজ ২ জুন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্য অভিষেকের ৬৬ বর্ষপূর্তি।

বিজ্ঞাপন

ছোট্ট লিলিবেট রাজপ্রাসাদে সবার চোখের মণি। তার দাদা রাজা পঞ্চম জর্জ লিলিবেটকে বিশাল সুন্দর একটি নাম দিয়েছেন, এলিজাবেথ অ্যালেক্সেন্ড্রা মেরি। তার মায়ের নামও এলিজাবেথ, আলেকজেন্ড্রা ছিল পঞ্চম জর্জের মায়ের নাম, এলিজাবেথের জন্মের মাত্র ছয় মাস আগে তিনি মরে গিয়েছিলেন। আর মেরি ছিল এলিজাবেথের দাদীর নাম। এত মানুষের নাম নিয়ে তৈরি নিজের নামটা একদম পছন্দ ছিল না ছোট্ট এলিজাবেথের। তাই সে নিজেকেই নিজে নাম দিয়েছিলেন লিলিবেট। লিলিবেটের বাবা জর্জ রাজ্যের উত্তরাধিকারের তালিকায় ছিলেন দ্বিতীয়। তার দাদা রাজা পঞ্চম জর্জ মারা গেলে রাজা হবেন লিলিবেটের চাচা এডওয়ার্ড। তখন সেই প্রিন্স অফ ওয়েলস।

তিন বছর বয়সী ছোট্ট লিলিবেট

রাজা পঞ্চম জর্জ মারা যাওয়ার পরে ১৯৩৬ রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড সিংহাসনে বসেছিলেনও। তাই কেউ ভাবেনি লিলিবেটের কোনোদিনও সাম্রাজ্যেও বসা হবে। এডওয়ার্ড তখন খুব তরুণ। বেঁচেও ছিলেন ১৯৭২ সাল পর্যন্ত। তিনি বিয়ে করলে তার ছেলেপুলে হবে। তারাই তো হবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্তরসূরি। কিন্তু সেই বায়বীয় সম্ভাবনাকে বাতাসেই মিলিয়ে দিয়ে রাজা এডওয়ার্ডের জীবনে আসেন ওয়ালিস সিম্পসন। আমেরিকান নারী মিসেস সিম্পসন তখন ইতিমধ্যে একবার বিবাহ বিচ্ছেদের পরে দ্বিতীয় বিয়ে বিচ্ছেদের চেষ্টা চালাচ্ছেন। রাজা এডওয়ার্ড দুম করে বিয়ে করে বসেন এই নারীকে। এরপর শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। সমালোচনার মুখে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড পদত্যাগ করেন। রাজ্যাভিষেক হয় রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের ভাই রাজা ষষ্ঠ জর্জের। তাও কেউ ভাবতে পারেনি সিংহাসন কোনোদিন লিলিবেটের হবে। কতই বা তার বাবার বয়স। হলে তো হয়েও যেতে পারত এলিজাবেথের একটা ভাই, নিয়ম অনুযায়ী সেই হতেন রাজা। কিন্তু না, রাজা ষষ্ঠ জর্জ তার দুই মেয়ে এলিজাবেথ আর মার্গারেটকে তৈরি করছিলেন রাজ্য পরিচালনার জন্য।

এলিজাবেথের বয়স যখন ছিল সাত বছর

ছোট্ট এলিজাবেথ খুব ঘোড়া পছন্দ করতেন। প্রবাদতূল্য ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ উইনস্টন চার্চিল দুই বছর বয়সী এলিজাবেথকে দেখে বলেছিলেন, “একটা চরিত্র বটে! একটা সহজাত কর্তৃত্বপরায়নতা একটা শিশুর মধ্যে সত্যিই বিস্ময়কর।”

১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় ব্রিটেন। সারা ব্রিটেন জুড়ে তখন হাওলার আতংক। সবাই যার যার সাধ্যমতো সন্তানদের ব্রিটেন থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আর যাই হোক যুদ্ধে যেন শিশুদের মৃত্যু না হয়। শিশুরা মরে গেলে দেশ উঠে দাঁড়াবে কীভাবে? সাম্রাজ্য থেকে সিদ্ধান্ত হলো এলিজাবেথ আর মার্গারেটকেও কানাডা পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যেখানে যুদ্ধের কোন ডামাডোল নেই। এলিজাবেথের মা জানালেন, না মেয়েদের ব্রিটেন ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। আমাকে ছাড়া তারা কোথাও যাবে না। আমি ব্রিটেন ছাড়ব না কারণ আমি রাজাকে রেখে কোথাও যাবো না আর রাজা কখনও যুদ্ধে ছেড়ে যাবেন না। এভাবেই সবাই যখন তাদের সন্তানদের যুদ্ধ থেকে দূরে গিয়ে নিজেদের রক্ষা করা শিখাচ্ছিল এলিজাবেথ শিক্ষা পাচ্ছিলেন, যুদ্ধের মোকাবেলা করতে।

ব্রিটিশ সৈন্যদের ছোটদের রেজিমেন্টের দায়িত্ব পালনকালে, ১৯৪৫ সাল

১৯৪০ সাল, ১৪ বছরের এলিজাবেথ প্রথমবারের মতো সরাসরি জনসংযোগে এলেন বিবিসির রেডিও অনুষ্ঠান চিল্ড্রেন আওয়ারের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধের কারণে বাড়ি ঘড় ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার শিশুদের উদ্দেশ্যে তিন বললেন, “ আমরা সবারি খুব চেষ্টা করছি আমাদের সৈন্যদের সহায়তা করতে। আমরা চেষ্টা করছি যুদ্ধের ভার বহন করতে কষ্টগুলো ভাগ করে নিতে। আমরা জানি এর শেষ হবে আর শেষে সবকিছু খুব সুন্দর হবে।” শুধু তাই না এলিজাবেথ ব্রিটিশ আর্মির ছোটদের একটা রেজিমেন্টে যোগ দেন, বাবা যখন দেশের বাইরে থাকতেন তিনি দেশের পাঁচজন কাউন্সিলরের একজন হিসেবে কাজ করতেন। মাত্র ১৪-১৫ বছর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন দেশ চালনার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

ইউনিফর্ম গায়ে বাকিংহাম প্যালেসের বারান্দায়, উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে

এভাবে এগুতে থাকে এলিজাবেথের গল্প। জীবনে সে অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আগে পতন হয়েছে এমন অনেক জৌলুসময় রাজত্ব। এলিজাবেথকেও তার শাসন আমলে ছাড়তে হয়েছে অনেকগুলো দেশ। এখন এলিজাবেথের সাম্রাজ্য বলতে ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডের একটা অংশ। তবুও পৃথিবীর ইতিহাসের একটা লম্বা সময়ের ভাগীদার এলিজাবেথ এখনও শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন তার সাম্রাজ্য। এই পতনের মুখে সাম্রাজ্যকে একটা স্থিতিশীল অবস্থানে রাখতেও এলিজাবেথের অবদান কম নয়।

১৯৬০ সালে কমনওয়েলথ কনফারেন্সে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মানুষেরা স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতিদিন বলে থাকেন, লং লিভ দ্যা কুইন বা রাণী দীর্ঘজীবী হোন। এই কামনা সত্য করে এলিজাবেথ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বেশিদিন রাজ্য পরিচালনা করা রাণী। আজ তার রাজ্য পরিচালনা বয়স ৬৬ আর নিজের বয়স ৯২। তার শরীর ভেঙ্গে গেছে, চামড়া কুঁচকে গেছে তবুও তার শক্তিশালী মানসিকতা শক্ত করে ধরে রেখেছে তার সাম্রাজ্য।

সারাবাংলা/এমএ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর