Thursday 28 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অ্যালান গিন্সবার্গ; বাংলাদেশ তার হৃদয়ের দুয়ার


৩ জুন ২০১৮ ১৭:৪৭

।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ।।

কবিতা হচ্ছে সে জায়গা যেখানে মানুষ তার মনের কথা উজাড় করে বলতে পারে। এটা সেই দোকান যেখানে জনসম্মুখে এমন সব কথা বলা যায় যা সে একান্তে শিখেছিল।
~ অ্যালান গিন্সবার্গ

সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। প্রবল বর্ষায় ডুবে গেছে পথ-ঘাট। বঙ্গদেশের বন্যা কখনও শেষ না হওয়া কাঁদুনে ব্যাঙের ডাকের মতো অনুরণন তুলে যাচ্ছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে, পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের তাড়া খেয়ে আসা গরীব অসহায় মানুষদের আর্তনাদ।

প্রায় মধ্য বয়সী উদ্ভ্রান্ত, উষ্কখুষ্ক এক আমেরিকান কবি আর প্রায় একরকম বাহ্যিক বর্ণনার এক ভারতীয় বাঙালি কবি পূর্ববঙ্গের পথে রওনা হয়েছে। এই বাঙালি কবির শেকড়ও পূর্ববঙ্গে। আমেরিকান বন্ধুর সঙ্গে সেও এসেছে নিজের মানুষদের দেখতে।

পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী পথ যশোর রোড। যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেই মার্চে। সেপ্টেম্বর মাসে এসেও শরণার্থীদের কোনো আশ্রয় হয়নি। বৃষ্টি আর কাদামাটিতে মধ্যে কোনো ক্রমে বাসের ছাউনির নিচে গাদাগাদি করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কে জানে তারা নির্বাক চোখে কী দেখছে? তারা কাকেই বা খুঁজছে?

আমেরিকান কবি দেশে ফিরে গেলেন, তার আরেক বন্ধু বব ডিলন আমেরিকা বসেই তৈরি হচ্ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষদের জন্য কিছু করার, অর্থ সংগ্রহ অথবা সেখানে থাকা মানুষদের দুর্দশার কথা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কানে তুলতে। আমেরিকান সেই কবি দীর্ঘ এক কবিতা তুলে দিলেন বব ডিলনের হাতে, নিজেই তাতে সুর দিলেন, গান গাওয়া হলো কনসার্টে, সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড।
আজ ৩ জুলাই, এই কবিতার রচয়িতা বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু কবি অ্যালান গিন্সবার্গের জন্মদিন।

বিজ্ঞাপন

অ্যালান গিন্সবার্গ শুধু একজন কবি ছিলেন না। ৫০ এর দশকের বিট প্রজন্মের একজন অগ্রদূত। এই প্রজন্ম দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে আমেরিকার প্রাচীন ধ্যান ধারণায় একটা বড় আঘাত আনে। এর পরে ৬০ এর দশকের বিপরীত সাংস্কৃতিক যাত্রায়ও অ্যাালান গিন্সবার্গ যথেষ্ট প্রভাব রাখেন। আমেরিকার আগ্রাসী মনোভাব, যুদ্ধবাজ নীতির বিরোধিতা করা, নারীর স্বাধীনতা এরকম অনেক “ বলতে মানা” বিষয়ের বিপক্ষে আওয়াজ তুলেন তিনি।

গিন্সবার্গ এক আজব দুনিয়ায় বাস করতেন। তার পৃথিবী আমাদের দেখা বাস্তব পৃথিবী থেকে আলাদা ছিল। বাস্তব আর পরা বাস্তবের মধ্যেকার এক দুর্লভ সেতুর সন্ধান ছিল তার কাছে। ফলে পৃথিবীকে তিনি দেখতে পারতেন অন্য এক স্তর থেকে। যখন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ চলছিল আর দুনিয়া শুদ্ধ মানুষ যার যা শক্তি আছে তাই নিয়ে গটা দুনিয়া দখলের পাঁয়তারা করছিল, গিন্সবার্গ ছিলেন কিশোর এক বালক। তবে বয়স দিয়ে তার শক্তিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সে সময়ই তিনি যুদ্ধকে অনুভব করতেন নিজের মতো করে। তার মনের চিন্তাগুলো লিখে পাঠাতেন প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে। তার লেখার বিষয় হতো শ্রমিকের অধিকারও। বলা যায় নিপীড়িত মানুষের কান্নার ভাষা বোঝার ক্ষমতা নিয়েই তিনি জন্মেছিলেন।

গিন্সবার্গ অবশ্য এর কৃতিত্ব দেন তার মা নাওমী লিভারগ্যান্ট গিন্সবার্গকে। তার ভাষায়, মা আমাকে প্রতি রাতে ঘুমপাড়ানির গল্প বলতেন। তার গল্পগুলো হতো অনেকটা এরকম, “একদিন ভালো রাজা রাত প্রসাদ থেকে বেড়িয়ে এসে তার দেশের খটে খাওয়া মানুষদের কষ্ট দেখতে পেলেন, এরপর তিনি তার মানুষদের প্রাণে শান্তি আনলেন।” এই শান্তির পেছনেই ছুটতেন নাওমী নিজেও। কাজ করতেন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। দুই ছেলে অ্যালান আর ইউগেনকে নিয়মিত নিয়ে যেতেন পার্টির মিটিং এ। মায়ের চোখ দিয়েই অ্যালান পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষদের দেখতে শিখেন।

বিজ্ঞাপন

গিন্সবার্গের মা নাওমীর আরেক অসুখ ছিল। তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন। এমন অনেক কিছুই তিনি দেখতে পেতেন যার বাস্তব কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। তার মনোজগতে ছিল ব্যাখ্যাতীত সব ঘটনা। তিনি নিজেকে হত্যা করতে চাইতেন। একটা দীর্ঘ সময় তাকে রাখা হয়েছিল মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে। তখন গিন্সবার্গ সদ্য কিশোর। অনেক পরে যখন গিন্সবার্গের এই গল্পগুলো জীবনী আকারে লেখা হয়েছে, লেখক বিল মর্গান তার নাম দিয়েছেন, “আমি নিজেকে উদযাপন করি: অ্যালান গিন্সবার্গের কিছুটা ব্যক্তিগত জীবন”।

গিন্সবার্গ দাবি করতেন, তার মায়ের সঙ্গ আর মায়ের মানসিক অবস্থা তার বড় দুইটা কাজের রসদ জুগিয়েছে। একটার নাম ‘হাউল’ (আর্তনাদ) আরেকটা ‘কাডিশ ফর নাওমী গিন্সবার্গ’ ইহুদী ধর্মে কাডিশ শব্দের অর্থ ‘প্রতিদিনের প্রার্থনা। শ্রদ্ধা জানানোর জন্য, প্রশংসা করার জন্য, ধন্যবাদ দেওয়ার জন, শান্তির ডাক দেওয়ার জন্য। গিন্সবার্গ তার কবিতার শক্তি দিয়ে তার মায়ের অবদানকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘কাডিশ’ নামে। এর মধ্য দিয়েই গিন্সবার্গ বলেছেন নিজের জীবনের গল্প।

‘হাউল’ গিন্সবার্গের আরেকটি বড় কাজ যার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সাহিত্যের ইতিহাসে। ১৯৫৪ সালে হাউল লেখা শুরু হয় শেষ হয় ১৯৫৫ সালে। অবশেষে ১৯৫৬ সালে গিন্সবার্গ এটিকে প্রকাশ করেন। এটা অনেকটা মুখে মুখে রচনা করা হয়েছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, দর্শকদের সামনে, যেমনটা আমাদের দেশের কবিগান হয়। গিন্সবার্গ লম্বা সময় ধরে তার দর্শকের সামনেই উজাড় করে বলেছিলেন তার অনুভূতিগুলো। পরে তা জোড়া দিয়ে তৈরি হয় আস্ত কবিতা।

চার পর্বের এই দীর্ঘ কবিতায় গিন্সবার্গ বলেছেন আমেরিকার তরুণদের কথা, যাদের তিনি মেষের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন চৈতন্যের কথা যা গিলে ফেলছে তরুণদের সৃষ্টিশীলতাকে গিলে খাচ্ছে। তিনি প্রার্থনা করেছেন তরুণরা যেন এই বস্তুবাদের গরিমা থেকে মুক্তি পায়। আর কী শক্তিশালী সে কবিতার ভাষা, a lament for the Lamb in America with instances of remarkable lamb-like youths… (পরিতাপ আমেরিকার সেসব মেষদের জন্য যাদের আমরা তরুণ বলি)

হাউল কবিতাটি এতই দুর্বোধ্য আর উপমা দিয়ে পূর্ণ যে তার তর্জমার জন্য আলাদা একটি বই প্রকাশ করা লাগে। তাও এর সঠিক ব্যাখ্যা উঠে আসে না স্বয়ং গিন্সবার্গের মুখেই। কখনও তিনি বলেন এটা বিট প্রজন্মের উপাখ্যান কখনও তিনি বলেন এটা তার মায়ের জীবন থেকে পাওয়া, গিন্সবার্গ বলেন, “আমি দেখেছি আমার প্রজন্মের সেরা মাথাগুলো খেয়ালেই হারিয়ে গেছে।”

গিন্সবার্গ তার সারা জীবন একটা প্রথা ভাঙার চেষ্টাই করে গেছে। প্রথা ভাঙা তার কাছে ছিল শিকল ভাঙার মতো। এইসব ভেঙ্গে তিনি মনোজগতের একটা গভীরতম স্থানে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন তার দেখা সম্ভবত কেউই পায়নি।

বাংলা সাহিত্যের প্রথা ভাঙার রসদও যুগিয়েছিলেন এই আমেরিকান কবি। ৬০ এর দশকে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পরে প্রতিষ্ঠান বিমুখ হাংরি আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন গিন্সবার্গ। হাংরি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্যকে ঢেলে সাজানো, যুদ্ধপীড়িত মানুষের কথা আনা, ক্রীতদাসের কথা বলা। এই সহিত্যিকরা শ্মশানে, গোরস্থান, ভাটিখানায়, স্টেশনে সাহিত্য পাঠের আয়োজন করতেন আর তাদের আলোচ্য বিষয়ও হতো সেখানে থাকা জীবন।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় গিন্সবার্গ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে শরণার্থীদের দেখতেন। তিনি তার সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছেন যুদ্ধে পীড়িত মানুষদের পক্ষ কাজ করতে।

মহৎপ্রাণ এ কবি ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ৭০ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। আজ ৩ জুন কবি অ্যালান গিন্সবার্গের জন্মদিন। সারাবাংলার পক্ষ থেকে কবিকে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

সারাবাংলা/এমএ/এসবি

** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর