লী রিডলে: বাকশক্তি ছাড়াই পৃথিবীকে ‘বাক্যহারা’ করছে যে মানুষটি
৭ জুন ২০১৮ ১০:১০
।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ।।
বাংলায় একটি কথন আছে, ‘বাক্যহারা’ হয়ে যাওয়া। এর অর্থ ভীষণ অবাক হওয়া। এত অবাক হওয়া যে বলার মতো শব্দ খুঁজে না পাওয়া। আরেকভাবে বললে বলা যায় ভীষণ মুগ্ধ হওয়া।
ইংরেজি ভাষাতেও ঠিক এই পরিস্থিতির বর্ণনা দেওয়া হয়, ‘স্পিচলেস’ বলে। যুক্তরাজ্যের কৌতুক বলিয়ে লী রিডেল এই শব্দটির সার্থক উদাহরণ। তিনি যখন কৌতুক বলেন, সারা পৃথিবী বাক্যহারা হয়ে যায়। তাদের মুখ থেকে অট্টহাসি ছাড়া আর কিছুই বের হয় না। মানুষকে মুগ্ধতায় বাক্যহারা করে দেওয়া মানুষটির নিজেই নির্বাক! সদ্য শেষ হওয়া ২০১৮ সালের হওয়া ব্রিটেন গট ট্যালেন্টের বিজয়ী এ লী রিডল। কথা বলার শক্তি ছাড়াই কীভাবে দুনিয়া মাতিয়ে রেখেছেন লী তাই বরং জানা যাক-
সেরিব্রাল পলসি নামে দুরারোগ্য এক পেশির রোগের কারণে লী ছোট বেলা থেকে কথা বলতে পারেন না। তো ব্রিটেন গট ট্যালেন্টের প্রাথমিক বাছাইতে লী নিজেই জানালেন কবে থেকে তিনি কথা বলতে পারেন না, “যেদিন থেকে বুঝতে পারলাম আমি আর কোনোদিন কথা বলতে পারব না আমি ‘বাক্যহারা’ হয়ে গেলাম!” লীয়ের এই কথার সঙ্গে সঙ্গে হেসে গড়িয়ে পড়লেন দর্শক।
লীর বিষয়টাই এরকম। প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তা আর দারুণ উপস্থাপনায় সে অনন্য। যেমন প্রথম দিনই সে নিজেকে ব্যাখ্যা করেন একজন সংগ্রামী স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হিসেবে। দর্শক এই কথাটা বোঝার আগেই লী যোগ করে, যার দাঁড়াতেও বেশ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ওমনি আরেক দফা হেসে লুটায় দর্শক। সেরিব্রাল পলসি শুধু লীর বাকশক্তি কেড়ে নেয়নি লীর সত্যিই দাঁড়াতে কষ্ট হয়। কিন্তু শরীর বাঁকিয়ে হাত মুড়ে লী যখন দাঁড়ায় তখন লীকে দেখতে অবিকল একটা কাঠের পুতুলের মতো লাগে, যেন কারও সুতোর টানে চলছে সে। আর লীর চমৎকার হাসিটি একটি বাড়তি পাওনা।
লীর বাড়ি ইংল্যান্ডের নিউক্যাসেলে। নিউক্যাসেলে মানুষদের একটি খুব অনন্য উচ্চারণ ভঙ্গি আছে। কারণ এখানে থাকা মানুষরা আসলে অন্য সব দেশ থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেছে। রাজকীয় ইংরেজদের শ্রমিক হিসেবেই কাজ করত এ এলাকার মানুষরা। নাক উঁচু ব্রিটিশরা এই উচ্চারণ ভঙ্গিকে নিয়ে বেশ নাক সিটকায়। লী তাই শুরুতেই জানিয়ে রাখে সে সারা জীবন নিউক্যাসেলে থাকলেও তার উচ্চারণে নিউক্যাসেলের প্রভাব নেই। কারণ লী তো কথাই বলতে পারে না।
সহজাত হাস্য রসবোধ আর খুব সাবলীল ভঙ্গি শুরু থেকেই মন কেড়ে নেয় সবার। তাই ব্রিটেন গট ট্যালেন্টের মতো একটা বারোভাজা ট্যালেন্ট শো যেখানে নাচ গান সার্কাস যাদু নেই হেন কোনো শাখা নেই-এর মধ্যে সবার মন জয় করে নেয় সাদা সিধা কমেডিয়ান লী রিডল।
অন্যকে হাসানোর বিষয়ে লী সবসময়ই সিদ্ধহস্ত। লীর কথা হচ্ছে, একজন মানুষ যদি একজন অক্ষম মানুষের অক্ষমতার উপর না হাসে তাহলে তো সে অক্ষম মানুষকে উপকার করতে আসবে। থাক বাপু তুমি তোমার মহানুভবতা নিজের কাছেই রাখো আমি বরং তোমাকে হাসাই।
সেমিফাইনালের গণ্ডি পার হবার পরে লীকে বলা হলো তুমি যদি জিতেই যাও সবাই তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। লী তার জবাব দিল আরে আমি তো জানি লোকে আমাকে নিয়ে হাসবে, তাও আমি জিততে তাই। অন্তত হাসার জন্য একটা ফিক্স টাইম তো থাকবে। আর আমি পথে ঘাটে লাইনে দাঁড়িয়ে হাসি দেখতে দেখতে বিরক্ত। আমি চাই আমি র্যাম্পে হাঁটব আর লোকে আমাকে নিয়ে হাসবে।
একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে উপহাস করার অসভ্যতা সব সভ্যতাতেই বিদ্যমান তবে লীর বিষয়টা আলাদা। লী তার প্রতিবন্ধকতাকে সেভাবে আমলে আনেনি কখনও। সে সব সময়ই হাসিখুশি এখন মানুষ। ব্রিটেন গট ট্যালেন্টই তার প্রথম কমেডিয়ান হিসেবে আত্মপ্রকাশ নয়। ২০১২ সাল থেকে সে এই কাজই করে আসছে। সে নিজেই নিজের নাম দিয়েছে দ্য লস্ট ভয়েজ গাই। আর তার ভক্তকূল কম ছিল না কখনও। বরং বলা যায় অসংখ্য ভক্ত থাকার কারণেই লী পেশাদার কমেডিয়ান হওয়ার চিন্তা মাথায় এনেছে।
মাত্র ছয় মাস বয়সে লীর পেশির সমস্যা দেখা দেয়। তার শরীরের একটি অংশ অপেক্ষাকৃত দুর্বল। হাঁটতে সমস্যা হয় এবং লীর মুখ দিয়ে সবসময় লালা ঝরে। এগুলোর পরেও লী সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নেয় এবং ঠিকঠাক একটি চাকরিও জুটিয়ে ভালোই জীবন পার করছিলেন। কিন্তু একজন মানুষকে ঈশ্বর যখন খুব অনন্য একটা শক্তি দেন সেটা বিকাশের সুযোগও তিনিই করে দেন।
লী তখন ইংল্যান্ডের উত্তর পূর্ব একটি শহর সান্ডারল্যান্ডের সিটি কাউন্সিলে মিডিয়া টিমে কাজ করতেন। প্রবল হাস্য রসবোধের জন্য ইতিমধ্যেই তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন। একটি আইপ্যাড ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয় তার। লী আইপ্যাডে টাইপ করে দিলে আইপ্যাড সেটা পড়ে শোনায়। তো ইংল্যান্ডের খুবই জনপ্রিয় স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান রস নোবেল একবার সান্ডারল্যান্ডে এলেন পারফর্ম করতে। রস নোবেলের খুব পরিচিত ও জনপ্রিয় কৌতুক অভিনয় ছিল স্টিফেন হকিং কে নকল করা। কথা নেই বার্তা নেই লী রস নোবেলকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসে যে সে রস নোবেলের থেকে ভালোভাবে স্টিফেন হকিং কে নকল করতে পারবে।
নোবেল বিষয়টাকে একদম সিরিয়াসলি নেননি। তিনি ভাবলেন একটা ছেলে যার কথা বলতে যন্ত্র লাগে সে আর কী করবে? এদিকে লী ভিতরে ভিতরে উত্তেজনায় ফাটছিলেন। কমেডি দুনিয়ায় নোবেলকে সে গুরুর মতো অনুসরণ করেন এমন একজনের থেকে সুযোগ পাওয়া তার জন্য নিঃসন্দেহে একটা দারুণ সুযোগ।
একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী খুব গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টার পিছে লেগে রইলেন ততদিন পর্যন্ত যতদিন লী ‘দ্য লস্ট ভয়েজ গাই’ নামে স্টেজে উঠে না এলো।
লী তার এলাকায় খুবই জনপ্রিয়। ২০১৩ সালে বিবিসি রেডিও লীকে ডেকেছিলেন তার এই সাফল্যের রহস্য বলতে। বিশেষ করে অধিকাংশ স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান তার দর্শকদের সঙ্গে কথোপকথন করেন লী কীভাবে এই বাঁধা উতরায়? লীয়ের সোজা সাপ্টা জবাব, হ্যাঁ এটা আমার জন্য সমস্যার কারণ আমার বলার আগে টাইপ করতে হয়। এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়।
তবে এটাকেও একটা হাস্যরসের বিষয়ে নিয়ে গেছেন লী। ব্রিটেন গট ট্যালেন্টের চূড়ান্ত মঞ্চে এই প্রশ্নের জবাবই লী দিয়েছেন অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে। তিনি বলেন, সেমিফাইনাল জেতার পরে আমি তো যার পর নেই খুশি। গেলাম একটা পাবে উৎযাপন করব। এর মধ্যে আমি অনেক জনপ্রিয় হয়ে গেছিল। লোকে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি ড্রিংকস নিবো কি না। আমি যতক্ষণে টাইপ করে বলি যে নিতে চাই না। ততক্ষণে আমার জন্য আরেকটা ড্রিংক চলে আসে। এভাবে চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আসলেই টাল হয়ে নিশ্চুপ না হয়ে যাই। যথারীতি হেসে গড়িয়ে পড়ে দর্শক।
অনুষ্ঠান শেষে লীয়ের কথাই সত্য হয়। সবাই তাকে নিয়ে হাসে। কারণ ২০১৮ সালের ব্রিটেন গট ট্যালেন্টের বিজয়ী সে। বিজয়ী বেশে সে যখন স্টেজে হেঁটে বেড়ায় তখন এই হাসি আর একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে দেখে হাসা হাসি থাকে না। এটা হয়ে উঠে একজন মানুষের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার হাসি। বিজয়ের হাসি।
লীয়ের এই বিজয় আনন্দ আর আশার সন্ধান দিন পৃথিবীর আনাচে কানাচে থাকা অসংখ্য প্রতিবন্ধী মানুষকে তারাও লীয়ের মতো জয় করতে পারুক জীবনের প্রতিবন্ধকতা, যেন এরপরে কোনো প্রতিবন্ধী মানুষকে আর কেউ উপহাস করে না হাসার সুযোগ পায়। হাসি হোক আনন্দের, হাসি হোক বিজয়ের।
সারাবাংলা/এমএ