সাম্রাজ্যবাদবিরোধের প্রবক্তা ফরাসী সাহিত্যিক অঁদ্রে জিদ
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৫৯ | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৪ ২০:০২
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মতবাদের প্রবক্তা ও নোবেলজয়ী ফরাসী সাহিত্যিক অঁদ্রে জিদ-এর ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী আজ। তার পুরো নাম অঁদ্রে পোল গিইয়োম জিদ। লেখক জীবনের শুরুতে প্রতিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মতবাদের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। অঁদ্রে জিদ তার কথাসাহিত্য ও আত্মজীবনীমূলক রচনাগুলির জন্য সুপ্রসিদ্ধ। তিনি তার মুক্তচিন্তা ও সামাজিক নৈতিকতার পক্ষপাতী তার দুটি বিপরীতমুখী চরিত্রকে জনসমক্ষে তুলে ধরেন।
জিদের রচনার মধ্যে দেখা যায় স্বাধীনতার অন্তর্তদন্ত এবং নৈতিকতা ও শুদ্ধতাবাদীদের ক্ষমতায়ণ। এভাবেই তিনি এগিয়ে গেছেন তার বৌদ্ধিক সততা লাভের উদ্দেশ্যে। তার আত্ম-উন্মোচনকারী রচনাগুলি তার আত্মানুসন্ধান, নিজের যৌন প্রকৃতির স্বরূপ অনুসন্ধান করে কারো মূল্যবোধকে আঘাত না করেই। তার রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপও একই প্রকৃতির।
১৮৬৯ সালের ২২ নভেম্বর প্যারিসের একটি মধ্যবিত্ত প্রোটেস্টেন্ট পরিবারে জিদের জন্ম। তার বাবা জ্যঁ পল গুইলাউমে জিদ প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ছিলেন, যিনি ১৮৮০ সালে মারা যান। তার মায়ের নাম জুলিয়েট মারিয়া রনডিউক্স। তার পিতৃপুরুষের পরিবার ইতালী থেকে ১৬ শতকের দিকে প্রটেস্ট্যান্টবাদে ধর্মান্তরিত হয়ে ফ্রান্সে চলে আসেন।
জিদ ছিলেন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আট বছর বয়সে তাকে প্যারিসের ইকোল আলসাসিয়েনে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। বাবার অকালপ্রয়াণের পর তার মায়ের একমাত্র কাজ হয় ছেলেকে মানুষ করা। বাড়িতে এসে যারা পড়াতেন, তাদের আচরণ ছিল বেশ কড়া। শারীরিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠার পর তাকে আবার ইকোল আলসাসিয়েনে ফিরতে হয়। ১৮৮৯ সালে তিনি বেকালরিয়েট পরীক্ষা পাস করেন এবং সে বছরই সিদ্ধান্ত নেন, জীবন কাটাবেন লেখালেখি, সংগীত আর দেশভ্রমণে। ১৮৯১ সালে প্রকাশ করেন তার প্রথম আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘দ্য নোটবুক অব আঁদ্রে ওয়াল্টার’।
বিশ শতকের হাতে গোনা কয়েকজন বিশুদ্ধতাবাদী লেখকের অন্যতম ছিলেন আঁদ্রে জিদ। লেখক ও একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে আঁদ্রে জিদ ছিলেন স্বকীয়তার অধিকারী। তার খ্যাতি মূলত তার লেখার জন্যই। কিন্তু তিনি অন্য অনেক লেখকের চেয়ে আলাদা ছিলেন একদিক থেকে। তিনি মোটেই অসামাজিক ছিলেন না। বন্ধুত্ব তার কাছে ছিল একটা বড় প্রয়োজনীয়তার। বন্ধুত্ব বজায় রাখার বুদ্ধিও তার ছিল। সে জীবনের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় তার আত্মজীবনীমূলক লেখা, চিঠিপত্র, জার্নাল এবং তার সম্পর্কে অন্যদের লেখায়। একাগ্রচিত্তে লেখার মধ্যে শুধু ডুবে থাকার মানুষ ছিলেন না তিনি। নিজের লেখা ও বন্ধুদের লেখা সম্পর্কে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। তার সময়ের প্রায় সব ফরাসি লেখকের সঙ্গেই তার পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল, দেখা-সাক্ষাৎ হতো অনেকের সঙ্গেই। এ ছাড়া সে সময়ের জার্মানি ও ইংল্যান্ডের অনেক লেখকের সঙ্গেও তার পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল। লেখক বন্ধুদের কাছে তার লেখা এবং তাদের কাছ থেকে পাওয়া তার চিঠিপত্রের সংখ্যা কয়েক হাজার। তিনি প্রতিনিয়তই লেখালেখির অনুপ্রেরণা পেতেন লাতিন, ফরাসি, জার্মান ও ইংরেজি ক্লাসিক রচনা থেকে। মানুষের পারিপার্শ্বিক জীবন ও বাইবেল থেকেও প্রাণশক্তি সংগ্রহ করেন জিদ।
গদ্য কাহিনি, নাটক, অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা, ডায়েরি— সবই লিখেছেন তিনি। তবে সব কিছুর ওপরে তার কথাসাহিত্যের স্থান। অবশ্য কথাসাহিত্যেও এনেছেন নতুনত্ব। সফল ধারাও বারবার অনুসরণ করেননি তিনি। প্রথম দিকের প্রতীকধর্মী রচনা থেকে আত্মজীবনীমূলক সিরিয়াস লেখাও আছে তার। ক্লাসিক্যাল দিক থেকে ফ্রান্সে তাকে উঁচু মানের স্টাইলিস্ট মনে করা হয়।
মোটের ওপর জিদের লেখায় উনিশ শতক থেকে চলে আসা রীতিপ্রথার সীমা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছেন বারবার। মানুষের নিজের আসল চেহারার ওপর পড়ে থাকা মুখোশ খোলার চেষ্টা করেছেন তিনি। মুখোশের ভেতর থেকে আসল চেহারা বের করে আনার কাজ করেছেন তিনি। নিজের আগের লেখার ধরনকেই উতরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন নিরন্তর। সামনে কী ধরনের লেখা আসতে পারে, তারও ইঙ্গিত আগের কোনও লেখায় দেখা গেছে। লেখক হিসেবে যে মূল্যবোধ মেনে চলছেন, সেটিরও নিরন্তর বদল হয়েছে তার ভেতরে। তিনি মনে করতেন, মূল্যবোধের সঙ্গে মানুষের মনের দ্বন্দ্ব ও ঐক্যের সতত পরিবর্তনশীল নাটক তার কাছে আগ্রহের একটা বিষয়। তিনি এ নাটক বারবার নতুনরূপে দেখতে চেয়েছেন। তার মতে, দ্বন্দ্বের এই নাটক মূলত ব্যক্তির নিজের মধ্যেই চলমান থাকে। এর সঙ্গে জড়িত আর যা যা ঘটে, সবই কাকতালীয়। ১৮৯৩ সালে তিনি প্রথম আফ্রিকা ভ্রমণ করেন। কড়া প্রোটেস্ট্যান্ট আবহে বড় হওয়ার কারণে একসময় তার দম বন্ধ মনে হতে থাকে। ভেবেছিলেন আফ্রিকা ভ্রমণের মাধ্যমে ওই অবস্থা থেকে মুক্তি পাবেন। আরব জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগের মধ্য দিয়ে তিনি সে অবস্থা থেকে মুক্তি পান। নিরন্তর অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়েই পরিবর্তন ঘটেছে তার লেখক মানসের।
সাহিত্যিক আঁদ্রে জিদের উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে ল-ইমমোরালিস্টে (১৯০২), লা সিমফোনি পাস্টোরাল (১৯১৯), পল ভ্যালেরি (১৯৪৭) প্রভৃতি। মুক্তচিন্তা, কথাসাহিত্য ও আত্মজীবনীমূলক রচনাগুলির জন্য সুপ্রসিদ্ধ এবং নোবেলবিজয়ী ফরাসী সাহিত্যিক অঁদ্রে জিদ ১৯৫১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ৮১ বছর বয়সে প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন।
মহান, কৃতিমান মানুষদের নিয়ে সব সময়ই লেখা যায় আমরা এটা বিশ্বাস করি। অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই বিশ্বজনীন মহান এই গুণীর সাহিত্য, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী।
মুক্তচিন্তা ও সামাজিক নৈতিকতার পক্ষপাতী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মতবাদের প্রবক্তা ও নোবেলজয়ী ফরাসী সাহিত্যিক অঁদ্রে জিদ-এর ১৫৫তম জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই