চীনের আশ্চর্য বাঁধ যেভাবে পৃথিবীর ভয়ংকর ক্ষতি করছে
২৯ নভেম্বর ২০২৪ ২১:২৩
আমরা মহাবিশ্বের একটি সুরক্ষিত পৃথিবী নামের গ্রহে বাস করছি। পৃথিবীকে জীবের জন্য বসবাস উপযোগী অবস্থায় পৌছতে অনেক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিবর্তন সাধন করে অগ্রসর হতে হয়েছে। পৃথিবীতে জীব ও জড় যা কিছু আছে তার সবকিছুর মধ্যে রয়েছে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান। আমাদের পৃথিবীর বাইরের সম্পূর্ণ মহাশূণ্য বা স্পেস ক্ষতিকারক বিকিরণে পরিপূর্ণ। এটি একটি বিপজ্জনক জগত। আধুনিক সভ্যতা ও উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ আজ পৃথিবীতে বাসযোগ্য ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ আজ স্বোচ্চার। আজকের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আমাদের মতো দেশ যতটা দায়ী নয় তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছি। তাছাড়াও ভৌগোলিকভাবে আমরা একটি ক্লাইমেট ভালনারেবল দেশে বাস করছি। তেমনি চীনের থ্রি গর্জেস বাঁধ পৃথিবীর ঘূর্ণন গতিকে কমিয়ে দিয়েছে যা পৃথিবীর বাসিন্দাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে নাসার বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছে।
চীনের থ্রি গর্জেস বাঁধ নির্মানের ইতিহাস
এশিয়ার সবচেয়ে বড় নদী ইয়াংজি চীনের হুবেই প্রদেশে অবস্থিত। তিব্বতের তাংগুলা পর্বতমালার বরফগলা পানি থেকে নদীটি জন্ম নিয়েছে এবং সাংহাই শহরের কাছে পূর্ব চীন সাগরে মিলিত হওয়ার আগে এ নদী প্রায় ৬, ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে। চীনের বাঁধ নির্মাণের ইতিহাস নতুন কিছু নয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৮ অব্দ থেকেই তারা বাঁধ নির্মাণ করে আসছে। মৌসুমী বন্যা প্রতিরোধে ইয়াংজি নদীতে খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৫ থেকে বাঁধ নির্মিত হয়ে আসছে। ১৯৪৯ সালের পর থেকে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জলবিদ্যুত উৎপাদনের প্রকল্প হিসেবে অদ্যাবধি চীনে প্রায় ৮৭ হাজার বাঁধ নির্মাণ করেছে। তন্মধ্যে বড় বাঁধের সংখ্যা ২৩ হাজারেরও বেশি, যা বিশ্বের মোট বাঁধের ৪১ শতাংশ। ১৯১৯ সালে সান ইয়াৎ সেন ‘A plan to develop industry’ নামে একটি প্রবন্ধে ইয়াংজি নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি বড় বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করেন। ১৯৪৪ সালে আমেরিকান বাঁধ নির্মাণ বিশেষজ্ঞ জে এল সেভেজকে ইয়াংজি নদীতে মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে দেখার জন্য চীনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। চীনের রাষ্ট্রপতি মাও সেতুং ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি দেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করবেন এবং তিনি ১৯৫৮ সালে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে ব্যক্তিগতভাবে থ্রি গর্জেস বাঁধ প্রকল্প তদারকি করার নির্দেশ দেন। ১৯৯৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর, এ প্রকল্প নির্মাণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ২০০৬ সালে বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং ২০১২ সাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়।
থ্রি গর্জেস বাঁধ ও পৃথিবীর ঘূর্ণনগতির পরিবর্তন
চীনের থ্রি গর্জেস বাঁধের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২২, ৫০০ মেগাওয়াট যা বাংলাদেশের সব কেন্দ্র মিলিয়ে মোট দাবীকৃত উৎপাদন ক্ষমতার চেয়েও প্রায় এক তৃতীয়াংশ বেশি। কংক্রিট এবং ইস্পাতে তৈরি বাঁধটি দৈর্ঘ্যে ২.৩ কিলোমিটার লম্বা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা ১.৮৫ কিলোমিটার। এই বাঁধের মাধ্যমে যে জলাধার তৈরি হয়েছে তার গড় দৈর্ঘ্য ৬৬০ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ ১.১২ কিলোমিটার। এ বাঁধের মাধ্যমে ৪২ বিলিয়ন টন পানি সমুদ্র সমতল থেকে ১৭৫ মিটার উপরে সঞ্চিত হয় যা পৃথিবীর ভরকে খুব সামান্য পরিমাণে হলেও কেন্দ্রে থেকে পরিধির দিকে ঠেলে দেয়। কোনও অক্ষের সাপেক্ষে ঘূর্ণনরত বস্তুর ঘূর্ণন গতিকে বাধা দেওয়ার প্রয়াসকে জড়তার ভ্রামক বলা হয়। অক্ষ থেকে ঘূর্ণনরত বস্তুর দূরত্ব যত বেশি হয়, তার ঘূর্ণন গতিও তত কমে যায়। নাসার গবেষকরা হিসেব করে বের করেছেন এই পরিমাণ ভরের স্থানান্তরের কারণে পৃথিবীর আহ্নিক গতি কমে গেছে ০.০৬ মাইক্রো সেকেন্ড! এই বাঁধের ফলে পৃথিবীর বিষুব অঞ্চল আগের চেয়ে কিছুটা গোল হয়েছে এবং মেরু অঞ্চল কিছুটা চ্যাপ্টা হয়েছে যা খুব সামান্য। এই বাঁধের পানির কারণে মেরুর অবস্থান প্রায় ২ সেন্টিমিটার সরে গেছে।
পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি কমে যাবার আরও অনেক কারণ রয়েছে। ঘূর্ণন গতি কমার প্রধান কারণ হলো চাঁদের আকর্ষণে জোয়ার-ভাটা। সেই সঙ্গে সূর্যের আকর্ষণ। পৃথিবীর চারদিকে চাঁদ ঘুরছে। আবার সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘুরছে। আর সূর্য, পৃথিবী, চাঁদপ্রত্যেকেই নিজ অক্ষরেখার চারপাশে নির্দিষ্ট গতিতে ঘুরছে। এসব সমন্বিত প্রতিক্রিয়ায় প্রভাব পড়ছে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির ওপর। তবে এ ক্ষেত্রে আরও কিছু উপাদান কাজ করছে যেমন- পৃথিবীর ভেতরের বিভিন্ন খনিজ পদার্থের অবস্থান, পৃথিবীর অভ্যন্তরে টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়া, গ্লেসিয়ারের অবস্থান, জলবায়ু, মহাসাগর ও পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব ইত্যাদি। এসব উপাদানের সামগ্রিক প্রভাবে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি সামন্য হারে কমছে। এ বিষয়ে বিবিসি সায়েন্স ফোকাস ম্যাগাজিনে ড. অ্যালেস্টেয়ার গান একটি নিবন্ধ লিখেছেন। অ্যালেস্টেয়ার বলেন, পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি খুব ধীরে ধীরে কমছে। ফলে বাড়ছে দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য। ঘূর্ণন গতি ১০০ বছরে প্রায় ১ দশমিক ৮ মিলি সেকেন্ড হারে কমছে।
বাঁধের জলাধারের কারণে পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থানে কিছুটা গোলাকার ও মেরু অঞ্চলে কিছুটা সমতল হয়ে পড়েছে। ফলে পৃথিবীর জড়তার ভ্রামক বেড়ে কমে যাচ্ছে পৃথিবীর ঘূর্ণনগতি। বর্তমান সময়ে দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য ২৪ ঘন্টা এবং ৩৬৫ দিনে এক বছর। এ রকম পরিস্থিতিতে দিন ও রাতের সময় ২৪ ঘন্টা থেকে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে এবং বছরে দিনের সংখ্যা কমে যাবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ৯০০ মিলিয়ন বছর আগে দিন-রাতের দৈর্ঘ্য ছিল ১৮ ঘন্টা এবং এক বছরে দিনের সংখ্যা ছিল ৪৮৬ দিন, ৪৫০ মিলিয়ন আগে দিন-রাত্রির মোট সময়কাল ছিল ২১.২ ঘন্টা এবং বছরে দিনের সংখ্যা ছিল ৪১৩ দিন, ৭০ মিলিয়ন বছর আগে দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য ছিল ২৩.৭ ঘন্টা এবং বছরে দিনের সংখ্যা ৩৭০। পৃথিবী সৃষ্টি লগ্ন থেকে ঘূর্ণন গতি প্রতি ১০০ বছরে প্রায় ১ দশমিক ৮ মিলি সেকেন্ড হারে কমছে।
থ্রি গর্জেস বাঁধের কারণে পৃথিবীর কী ক্ষতি হচ্ছে?
চীনের জলাধার নির্মাণের মতো মানুষের সৃষ্ট কারণে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি যদি আরও কমে তাহলে সেটি পরিবেশের জন্য কিরূপ ক্ষতিকর হবে? পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘন্টায় প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। আবার নিজের অক্ষের চারপাশে ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার বেগে প্রতি ২৪ ঘন্টায় একবার ঘোরে। পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি কমার কারণে দিন-রাতের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পাওয়ায় যেখানে দিন থাকবে সেখানকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে, আর রাতের জায়গায় শীতলতাও বাড়বে। পৃথিবীর আহ্নিক গতির সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে অর্থাৎ প্রতিঘন্টায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার গতিতে বায়ুমন্ডলও ঘুরছে। কিন্তু হঠাৎ করে যদি পৃথিবীর গতি কমে যায় বায়ুমন্ডলের গতি অপরিবর্তিত বা ধ্রুবক থাকে তাহলে আপেক্ষিক গতির কারণে পৃথিবীতে ঘন ঘন ঝড়ো বাতাসের প্রভাব বাড়বে। বায়ু নয় পানিও তো ঘুরছে একই কারণে প্রবল জলোচ্ছ্বাসেরও সৃষ্টি হবে। উত্তর মেরুর দিকে সব থেকে বেশি ক্ষতি হবে। কারণ পৃথিবী তার নিজ অক্ষের উপর ২৩.৪ ডিগ্রি কোণে ঘুরছে। তাই সেখানে সূর্যের আলোর বেশি উপস্থিতির জন্য গরম বৃদ্ধি পাবে ও সেখানকার বরফ বেশি হারে গলতে থাকবে। তাপমাত্রার বাড়ার ফলে গত দশকে পৃথিবীর চারপাশে বরফের পরিমাণ কমে বছরে ৪ দশমিক ৫ মিলিমিটার হারে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও পানি অ্যাসিডিক হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্যে আরও দেখা যাচ্ছে, গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্ক টিকার প্রায় ৩৮ শতাংশ বরফ কমে গেছে।
যদি একদমই হঠাৎ পৃথিবীর গতি কমে যায়, তবে হঠাৎই দেখবেন আপনি নিজেও গড়িয়ে পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতির দিকে এগোচ্ছেন। কারণ তখন আপেক্ষিক গতি কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে একটি বহির্মুখী বল সর্বদাই আমাদের ওজনের উপর প্রভাব রাখছে, যার কারণে আমাদের ওজন কিছুটা হলেও কম মনে হয়। ঘূর্ণন কমে গেলে এই বহির্মুখী বলও কমে যাবে। পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি কমার প্রভাব পৃথিবীর চারপাশে থাকা স্যাটেলাইটগুলোর উপরও পড়বে। কারণ সেগুলোও তো পৃথিবীর বর্তমান গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে যাতে এগুলো ভূস্থির উপগ্রহ হতে পারে। তাই মাটি থেকে দেখে মনে হয় সেগুলো যেন স্থির অবস্থায় আমাদের উপরে ভাসছে। কিন্তু যদি ঘূর্ণন কমে যায়, তবে ওগুলো আর ভূস্থির থাকবে না। এদের আপেক্ষিক গতি বেড়ে যাবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পরপর পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে। তাই মোবাইল ও অন্যান্য নেটওয়ার্ক কিছুক্ষণ পরপর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ঘূর্ণনগত মন্থরতার ফলস্বরূপ, বিশ্ব মহাসাগরের রূপরেখা ক্রমাগত নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে। নিরক্ষীয় জল মেরু অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হবে।
অনেকে বলতে পারেন পৃথিবীর গতি কমার প্রভাব অনুভূত হবে না। তা বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক রহিম সাহেব বাসে চড়ে সোজা পথে ৬০ কিলোমিটার বেগে যাচ্ছেন এবং কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাসটি যতক্ষণ ৬০ কিলোমিটার গতিতে অর্থাৎ একই গতিতে চলতে থাকবে ততক্ষণ রহিম সাহেব টের পাবেন না। কিন্তু ব্রেক করার কারণে যদি বাসের গতি হঠ্ৎা ২৫ কিলোমিটারে নেমে আসে তাহলে রহিম সাহেব অবশ্যই ঝাকুনি খেয়ে টের পারেন। এরকমই পৃথিবী যতক্ষণ একটি নির্দিষ্ট গতিতে ঘুরবে ততক্ষণ কোনও পার্থ্যকই মনে হবে না। বিমানে অবস্থানকালেও বিমান যখন হঠাৎ উপরে-নিচে জাম্প করে কিংবা গতিতে পরিবর্তন আনে তা সহজেই অনুভূত হয়। স্বাভাবিক সময়ে এমনটি মনে হবে না।
থ্রি গর্জেস বাঁধের কারণে বাড়ছে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা
থ্রি গর্জেস বাঁধের পানির উচ্চতা ১৭৫ মিটার। চীনের ভূমিকম্প প্রশাসনের থ্রি গর্জেস বাঁধ এলাকায় ‘Influence of Three Gorges Dam on earthquakes based on GRACE gravity field’ শিরোনামে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে ২০০২ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৬ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত পানির উচ্চতা ৬৮ মিটার থেকে ১৪৫ মিটার পর্যন্ত এবং ২০০৮ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১৪৫ মিটার থেকে ১৭৫ মিটার পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হয় তখন উক্ত এলাকায় ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়তে থাকে আবার অনুরূপভাবে বাঁধের পানির উচ্চতা যখন ১৭৫ মিটার থেকে ১৪৫ মিটারে পর্যায়ক্রমে নামিয়ে আনা হয় তখন ভূমিকম্পের সংখ্যা কমে যায়। অর্থাৎ পানির উচ্চতা বাড়ার সাথে ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়ে আর পানির উচ্চতা কমার সাথে ভূমিকম্পের সংখ্যাও কমে। আবার লক্ষ্যণীয় যে, একই উচ্চতাও বাড়ার সময় ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়ে কিন্তু কমার প্রবণতার ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের সংখ্যা কমে। উল্লেখিত সময়ে থ্রি গর্জেস বাঁধ এলাকায় প্রায় ৩৪০০টি ভূমিকম্পের সূত্রপাত হয়। ভূমিকম্পের ফলে যে ভূমিধ্বসের সৃষ্টি হয় তার ফলেও ভূমিকম্পের ৩০% সম্ভাবনা বাড়ে।
থ্রি গর্জেস বাঁধে জলবায়ু বিপর্যয়ের সম্ভাবনা
‘দ্য আর্থ সায়েন্সের’ তথ্যমতে কোনও শহরে সুউচ্চ ভবনের ঘনত্ব বেশি হলে তাও পৃথিবীর ঘূর্ণনে প্রভাব বিস্তার করে যদিও সেটির মাত্রা খুবই কম। তবে আজকাল আধুনিক পদ্ধতিতে সেটিও হিসেবে করে বের করা সম্ভব। পৃথিবীর যে সকল দেশের শহরগুলোর ভূমি সীমিত এবং জনসংখ্যার অত্যধিক চাপ রয়েছে সেখানে সূউচ্চ ভবনের সংখ্যা অনেক বেশি। মূলত ১৯ শতকের গোড়ায়- উন্নত দেশগুলোয় বিস্ময়কর সুউচ্চ ভবনের নির্মাণশৈলীর দেখা মেলে। ‘The Council on Tall Buildings and Urban Habitat (CTBUH)’ এর মতে যে সকল ভবন ১৪ তলা বা তার চেয়ে বেশি এবং উচ্চতা ২০০ মিটার বা তার চেয়ে বেশি তাকে সুউচ্চ ভবন বলা হয়ে থাকে। বিশ্বের কয়েকটি শহর যেখানে সবচেয়ে বেশি উচু ভবন রয়েছে তার বর্ণনা দেওয়া হলো। সবচেয়ে বেশি উচু ভবন রয়েছে চীনের শেনজেন শহরে। এই শহরে ১৭ কোটি লোকের বাস এবং এখানে গড়ে ২০০ মিটারের বেশি উচ্চতার ১২০টি ভবন রয়েছে। আমিরাতের দুবাইয়ে ১০৭টি, চীনের হংকং এ ৯৪টি, আমেরিকার নিউইয়র্কে ৯২টি, চীনের সাংহাইয়ে ৬০টি, জাপানের টোকিওতে ৫৩টি, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ৪৪টি, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ৩৭টি এবং চীনের উহানে উচু ভবনের সংখ্যা ৩০টি। বিশ্বের সবচেয়ে উচু ভবন বুর্জ খলিফা সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবু ধাবিতে অবস্থিত যার উচ্চতা ৮২৮ মিটার এবং বিশ্বের ২৫টি উচুঁ ভবনের (সর্বনিম্ন উচ্চতা ৪৪২ মিটার) মধ্যে একমাত্র চীনেই ১২টি ভবন অবস্থিত।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে অন্তত ৪৩টি দেশ সমুদ্রে হারিয়ে যাবে। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী বছরে ৫৭ দশমিক ৪ গিগাটন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হচ্ছে যার ৫৫ শতাংশের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও রশিয়া। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্য বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৪৩ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন কমাতে হবে। ধনী দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানী জ্বালিয়ে কার্বনের পরিমাণ বাড়িয়ে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করছে। চীনের মতো দেশ থ্রি গর্জেস বাঁধ নির্মাণ করে পৃথিবীর ঘুর্ণন গতি কমিয়ে দিয়ে দিন রাত্রির দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দিয়ে মেরু অঞ্চলের বরফ গলাচ্ছে, তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে, জীবচক্রে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। বিমান, রকেট, সাবমেরিন, কৃত্রিম উপগ্রহ চালনায় জিরো এরর পদ্ধতি যেমন কার্যকর তেমনি জীবমন্ডল রক্ষায় জিরো ভুলও মোটেই কাম্য নয়।
গাছ থেকে মাথার উপর আপেল পড়ার বিষয়টি নিউটন হাল্কাভাবে নেননি। বরং তিনি এটি নিয়ে চিন্তা করতে যেয়ে পদার্থবিদ্যার আবিস্কারে যুগান্তকারি বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তেমনি আমাদেরকে জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন, পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি নিয়ে পৃথিবী রক্ষায় আরও সচেতন হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্রের তলায়ও পরিলক্ষিত হচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বছরে খরায় প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার, সাইক্লোন ও ঝড়ে ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৩২, বন্যায় ৫৮ হাজার ৭০০ এবং উচ্চ তাপমাত্রায় প্রায় ৫৫ হাজার ৭৩৬ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে শিশুরা ২০০০ সালের তুলনায় ৮ গুণ বেশি তাপপ্রবাহ, ৩ গুন বেশি মারাত্মক বন্যা এবং ১.৭ গুন বেশি দাবানলের সম্মুখীন হবে। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনে সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৪০ শতাংশ ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কান্না নিরারণে জলবায়ু তহবিলে নিয়ে বৈশ্বিক চুক্তির বিভাজন ও অসন্তোষ কোনওভাবেই কাম্য নয়।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই