আয়কর রিটার্ন জমা না দিলে কী বিপদ হতে পারে?
৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:২১ | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:২৫
দেশে আয়করের ব্যাপ্তি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বর্তমানে দেশে ৯০ লাখের বেশি টিআইএন নম্বরধারী আছেন। অথচ টিআইএনধারী বাংলাদেশে অর্ধেক মানুষই সরকারের কাছে বছর শেষে আয়কর রিটার্ন জমা দেন না। অথচ এই নম্বর থাকার অর্থ কর দেবার উপযুক্ত হোন অথবা না হোন, অর্থবছর শেষে তার বার্ষিক আয়-ব্যয়ের একটি খতিয়ান অর্থাৎ আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে রাজস্ব বোর্ডে। এছাড়া অনেকেই আছেন যারা টিআইএন থাকা সত্বেও কয়েক বছর ধরে রিটার্ন জমা দেননি কিংবা নানা কারণে দিতে পারেননি।
২০২৪-২৫ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যারা এখনও রিটার্ন জমা দেননি তারাও এই সময়ের মধ্যে কোনও জরিমানা ছাড়া কর বা রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এ বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিশেষ আদেশে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে অবস্থিত সব সরকারি কর্মচারী, সারাদেশের সব তফশিলি ব্যাংকের কর্মকর্তা/কর্মচারী, সারাদেশের সব মোবাইল টেলিকম সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারী এবং ওই আদেশে উল্লেখিত বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের আয়কর রিটার্ন অনলাইনে দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে।
দেশে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এখন রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রমাণপত্র লাগে। আগে টিআইএন থাকলেই বিভিন্ন রকম সুযোগসুবিধা পাওয়া যেতো। এখন টিআইএন থাকলেই আপনার করযোগ্য আয় থাকুক বা না থাকুক, আপনাকে আয়কর রিটার্ন দিতে হবে- কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া। বছরে কারও আয় যদি তিন লাখ টাকার বেশি হয়, তাহলে তাকে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব করে বার্ষিক রিটার্ন জমা দিতে হবে।
আয়কর রিটার্ন হলো সরকার কর্তৃক নির্ধারিত একটি কাঠামোবদ্ধ ফরম যার মধ্যে করদাতা তার আয়-ব্যয়, সম্পদ ও দায়ের তথ্য লিখে আয়কর অফিসে দাখিল করেন। ব্যক্তি শ্রেণির করদাতা ও কোম্পানি করদাতাদের জন্য পৃথক রিটার্ন রয়েছে। ২০২৪-২৫ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যারা এখনও রিটার্ন জমা দেননি তারাও এই সময়ের মধ্যে কোনও জরিমানা ছাড়া কর বা রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এ বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিশেষ আদেশে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে অবস্থিত সব সরকারি কর্মচারী, সারাদেশের সব তফশিলি ব্যাংকের কর্মকর্তা/কর্মচারী, সারাদেশের সব মোবাইল টেলিকম সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারী এবং ওই আদেশে উল্লেখিত বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের আয়কর রিটার্ন অনলাইনে দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে।
আয়কর রিটার্ন জমা না দেওয়ার ফলে একজন জরিমানাসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে পারেন। এছাড়া জমি রেজিস্ট্রি থেকে শুরু করে ইউটিলিটি সংযোগ, ক্রেডিট কার্ডসহ ৩৮টি পরিষেবা পেতে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। আসুন জেনে নেই রিটার্ন জমা না দিলে কী বিপদ হতে পারে- সেগুলো কী জেনে নেই এবং আরও জানি এই সমস্যার সমাধানের উপায়।
আয়কর রিটার্ন জমা না দিলে যেসব ঝামেলা হতে পারে
আয়কর রিটার্ন জমা না দিলে যে কত রকমের ঝামেলা হতে পারে তা অনেকেই জানেন না। এমনকি আগে করযোগ্য ছিলেন কিন্তু পরে সেরকম আয় আর নেই এমন ব্যক্তিকেও বিপাকে পড়তে হতে পারে। নাম পরিচয় প্রকাশ না করে আমার একজন ক্লায়েন্টের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলছি। ঢাকার এই চাকুরিজীবী নিয়মিত কর দিতেন এবং সময়মত রিটার্নও জমা দিতেন। এক পর্যায়ে করোনা মহামারী ও বিভিণ্ন কারণে বেশ কিছুদিন তার চাকরি ছিল না। বেশ কিছুদিন পর তিনি খুব অল্প বেতনে নতুন যে চাকরি পেলেন তখন আর তিনি করযোগ্য ছিলেন না। প্রথমত আয় নেই, তারপর আর করযোগ্য নন চিন্তা করে পরপর দুই বছর রিটার্ন জমা দেননি তিনি। কিন্তু সমস্যা শুরু হল যখন তিনি একটা ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য ট্রেড লাইসেন্স করাতে গেলেন।
‘টিন (টিআইএন) নম্বর যেহেতু ছিল, সেটা হালনাগাদ হতে হবে, তা না হলে লাইসেন্স পাওয়া যাবে না। কিন্তু ব্যবসা চালু করতে অনেক সমস্যা দেখে সিদ্ধান্ত বদল করে বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। সেখানে আরেক ঝামেলা। ভিসার জন্য সর্বশেষ তিন বছরের ট্যাক্স ফাইল চাওয়া হল। তখন আয়কর বিষয়ক প্রফেশনাল কারও কাছে না গিয়ে উপায় ছিল না।’ বলেন তিনি। আরেকজনের কাছ থেকে শুনে তিনি আমার কাছে আসলেন। আলাপের পর আমাকে আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে, শুনানি করে, একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ জমা দিয়ে তবেই তিনি রিটার্ন জমা দেওয়ার ঝামেলা মেটাতে পেরেছেন। কিন্তু তারপরও ঝামেলা শেষ হয়নি। সনদ নিতে গিয়ে তাকে দফায় দফায় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর অফিসে যেতে হয়েছে। এসব সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে নিয়মিত রিটার্ন দেওয়া জরুরী।
আমরা সবসময়ই বলি, একজন ব্যক্তি রিটার্ন জমা না দিয়ে বা সমস্যা সমাধান না করে তিনি নিজের জন্য বড় ধরনের ঝামেলার পথ তৈরি করছেন। আয়কর আইন অনুযায়ী, যদি কোনও ব্যক্তি সময়মত আয়কর রিটার্ন দিতে ব্যর্থ হন এক্ষেত্রে অধ্যাদেশ অনুযায়ী এক হাজার টাকা অথবা আগের বছরের ট্যাক্সের দশ শতাংশ জরিমানা করা যাবে। এ দুটির ভেতরে যেটি পরিমাণে বেশি সেই অংকটি পেনাল্টি হতে পারে। কয়েক বছর ধরে যদি কেউ রিটার্ন দাখিল না করেন তাহলে ওই জরিমানা ছাড়াও যতদিন ধরে তিনি রিটার্ন দেননি ওই পুরো সময়ের দিনপ্রতি ৫০ টাকা করে জরিমানা হতে পারে। তবে নতুন করদাতা হলে সবমিলিয়ে জরিমানার পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকার ওপরে নেয়া হবে না। আর পুরান করদাতা হলে আগের বছর যে পরিমাণ অর্থ আয়কর হয়েছে সেটিসহ ওই অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি দিতে হতে পারে।
আয়কর রিটার্ন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান কী
রিটার্ন জমা না দিলে যদি জরিমানা এবং অন্যান্য ঝামেলায় পড়তে হয়, তা থেকে মুক্তির অবশ্যই সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে প্রতিবছর সময় মতো রিটার্ন জমা দেওয়া। কিন্তু কোন কারণে যদি তা না দিতে পারেন তাহলে রিটার্ন জমা দেওয়ার জন্য দুই মাস পর্যন্ত বাড়তি সময়ের আবেদন করতে পারেন। এই আবেদন করতে হবে উপ-কমিশনার বরাবর। যদি বাড়তি সময় দেওয়া হয় তাহলে রিটার্ন জমা দেবার সময় জরিমানার অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। যদি কেউ বাড়তি সময় না নেয় তাহলে তাকে পেনাল্টি দেবার আগে, কী কারণে রিটার্ন দেননি বা দিতে পারেননি সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য অবশ্যই শুনানির সুযোগ দিতে হবে।
শুনানির জন্য করদাতাকে নোটিশ পাঠানো হয়। অনেক ক্ষেত্রেই একের বেশি শুনানি হয়। শুনানিতে করদাতা নিজে অংশ নিতে পারেন অথবা সনদপাওয়া আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট নিয়োগ দিতে পারেন। সেজন্য অবশ্য আরও বাড়তি অর্থ খরচ হবে। তবে যদি করদাতা কোন গ্রহণযোগ্য কারণ, কাগজপত্র দেখাতে পারেন তাহলে খুব একটা ঝামেলায় তাকে পড়তে হয় না। কর্তৃপক্ষ কারণ শুনে সন্তুষ্ট হলে জরিমানা নাও করতে পারেন। জরিমানা হলে তার বিপক্ষে করদাতার আপিলের সুযোগ রয়েছে। কর কমিশনার ও ট্রাইব্যুনালে আপিল করার পরও যদি করদাতা হেরে যান তাহলে হাইকোর্টেও আপিল করতে পারেন। জরিমানার অর্থ জমা দেওয়ার জন্য কর অফিসের একটি নির্ধারিত ফর্ম রয়েছে। সেটি পূরণ করে সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকে ক্যাশ, অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক, পে অর্ডার করে এই অর্থ জমা দিতে হবে। অথবা উপ-কমিশনারের কাছে সরাসরি অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক কিংবা পে অর্ডার দিতে পারেন।
যারা একদমই আয়কর দেন না, তাদের কী হবে
আর যারা করযোগ্য হওয়ার পরও একেবারেই কর দেন না, তাদের ক্ষেত্রে, তিন ধরনের জরিমানা করা যায়। একটি হল যে পরিমাণ কর বকেয়া হয়েছে সেটি ছাড়াও আরও ২৫ শতাংশ বাড়তি জরিমানা করার বিধান রয়েছে। যে পরিমাণ কর বকেয়া হয়েছে তার ওপর ২ শতাংশ হারে মাসিক সরল সুদ। যে পরিমাণ কর বকেয়া হয়েছে তার সমপরিমাণ জরিমানা। এটি নির্ভর করে কার অপরাধ কতটুকু তার ওপর। এমনকি জেল জরিমানার বিধানও রয়েছে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে সময়মতো আয়কর না দেওয়া ব্যক্তির ক্ষেত্রে সম্পদ জব্দ করার বিধানও রয়েছে। তবে তা খুব একটা হতে দেখা যায় না। তবে, যদি কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ী কর জমা না দেয় তাহলে অনেক সময় তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সম্পদ জব্দ করার উদাহরণ বেশ রয়েছে।
লেখক: আয়কর আইনজীবী
সারাবাংলা/এসবিডিই