‘যোগ্য উত্তরাধিকারী সেই যে অগ্রজকে সমৃদ্ধ করে’
২০ জুন ২০১৮ ১৬:১৬
।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর।।
২০১২ সাল, মে মাস। ইয়ুথ এনগেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্টের জাতীয় কনভেশন চলছে। কবি সুফিয়া কামালের কন্যা সুলতানা কামাল তরুণদের উদ্দেশে বলছিলেন তার মায়ের দেওয়া শিক্ষা— ‘যোগ্য উত্তরাধিকারী সেই যে তার অগ্রজের সম্পদকে সমৃদ্ধ করে।’
আজ বাংলাদেশের প্রধানতম নারী কবি সুফিয়া কামালের জন্মদিন। ১৯১১ সালে ২০ জুন তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন বাংলায় নারীদের জীবনে লাগতে শুরু করেছে বদলের ছোঁয়া। বেগম রোকেয়া তখন নারীদের অগ্রগতির জন্য কাজ শুরু করেছেন। মেয়েরা খুব কম হলেও স্কুলে যায়, নিজেদের দুর্দশা নিরসনে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছেন তারা।
সুফিয়া কামাল জন্ম নিলেন বরিশালের শায়েস্তাবাদে, নানাবাড়িতে। তখনও কিন্তু নারীরা সেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পেতেন না। তবে বাড়িতে শিক্ষা পেতে বাধা আসা কমেছে অনেকটাই। সেই সুযোগটাই কাজে লাগান সুফিয়া কামাল। স্বশিক্ষায়ই শিক্ষিত হন তিনি। তবে এ কাজটাও খুব সহজ ছিল না।
সুফিয়া কামালের বয়স তখন মাত্র সাত বছর। কী এক খেয়ালে তখন সাধকদের সঙ্গে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন তার বাবা। ওই সময়টায় একজন নারীকে সব অবস্থাতেই কোনো না পুরুষের অধীনে বসবাস করতে হতো। আর্থিক, সামাজিকসহ সব প্রেক্ষিতেই তাদের নির্ভর করতে হতো পুরুষদের ওপর। ওই সময়ও মুসলমান সমাজে পিতা ও স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতেন নারীরা, তবে সেই সম্পদের নিয়ন্ত্রণও থাকতো কোনো না কোনো পুরুষের হাতেই। ফলে বলতে গেলে জীবনধারণের জন্যই পুরুষদের মুখাপেক্ষী হয়েই জীবন কাটাতে হতো তাদের।
এমন একটি সময়ে কাজ করে পরিবারকে টিকিয়ে রাখার কথা তো একজন নারীর জন্য ছিল ভাবনার অতীত। তখন না ছিল নারীদের জন্য কাজের জায়গা, না ছিল কাজ করার মতো শিক্ষা। অগত্যা সুফিয়া কামালের মাকে ফিরে যেতে হলো বাবার বাড়িতে। সেটা আবার শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবার। তাদের মুখের ভাষা উর্দু। অন্দরের মহিলা আরবি-ফারসি শেখার সুযোগ পেলেও পেতেন না বাংলা-ইংরেজি শেখার।
কিন্তু যে শিখতে চায়, তাকে আটকে রাখে এমন সাধ্যি কার? সুফিয়া কামালকেও কেউ আটকে রাখতে পারেনি। তিনি মামার লাইব্রেরিতে থাকা বই নিয়ে মায়ের কাছেই শিখে ফেলেন বাংলা ভাষা।
শিক্ষার সুযোগ না পাওয়াটাই অবশ্য সে যুগের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে একমাত্র অন্তরায় ছিল না। অধিকাংশ মেয়েরই খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে যেত। এরপর আর কী— বাচ্চা সামলাও, ঘরের কাজ করো; কোথায় লেখাপড়া আর কোথায় জ্ঞান চর্চা। সেই রীতি মেনেই মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাতো ভাই নেহাল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় সুফিয়া কামালের। তবু তিনি ছিলেন খানিকটা সৌভাগ্যবান।
সুফিয়া কামালের শিক্ষার প্রতি অনুরাগের কথা জানতেন নেহাল। তাই তিনি শুরু থেকেই সুফিয়া কামালকে উৎসাহিত করেছেন সমাজসেবা আর সাহিত্য চর্চায়। তিনিই সুফিয়া কামালকে সাহিত্য ও সাময়িকী পত্রিকাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে দেন। সেই পথ ধরে ১৯১৮ সালে কলকাতায় যান বেগম সুফিয়া কামাল। সেখানেই তার দেখা হয় বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সঙ্গে। তিনিই অগ্রজ বেগম সুফিয়া কামালের।
কলকাতা এসে সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ প্রকাশিত হয় সওগাতে। সওগাত সে সময়ের বেশ প্রভাবশালী পত্রিকা। তখনও নারীরা সেভাবে সাহিত্য রচনা করতে আসেন না। তবে সাহিত্য বেশ জনপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্রের মতো বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্ররা তখন সাহিত্যের মধ্য গগণে আলো ছড়াচ্ছেন। সেখানে নারীরা একদম অনুপস্থিত। নারীদের এই নিশ্চুপ জীবনের দুয়ারে একটা কড়া নাড়ার উদ্যোগ নেন সুফিয়া কামাল। বেগম রোকেয়া তখন মুসলিম নারীদের সাহিত্য চর্চায় উৎসাহী করার জন্য ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ বলে একটি প্রতিষ্ঠান চালান। সুফিয়া কামাল তার সঙ্গে যুক্ত হন নারীদের সাহিত্য চর্চা বাড়াতে।
এদিকে, সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে সুফিয়া কামালের সাহিত্য চর্চা চলছিল পুরোদমে। ১৯৩৭-এ তার গল্প সংকলন ‘কেয়ার কাটা’ প্রকাশ পায়। এর আগেই প্রথম কবিতার বই ‘সাঁঝের মায়া’ প্রকাশ হয় ১৯২৮-এ; সেই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছিলেন স্বয়ং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত সেই লেখার উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করেন।
এর মধ্যেই ফের বড় ধরনের আঘাত আসে কবির জীবনে। ১৯৩২ সালে মারা যান তার জীবনসঙ্গী নেহাল হোসেন। অবশ্য স্বামীকে হারিয়েও সুফিয়া কামাল তার মায়ের মতো ভেঙে পড়েননি। তিনি যে তার উত্তরাধিকারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। কলকাতার করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেন, কাজ করলেন প্রায় ১০ বছর। এর মধ্যেই তার আবার বিয়ে হয় কামালউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। বাংলায় তখন দেশ বিভাগের সময়। তার আগেই সুফিয়া কামাল নারীদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকা ‘বেগম’-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
১৯৪৭ সাল। দেশভাগের পর সুফিয়া কামাল তার পরিবার নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। তখন পাকিস্তানজুড়ে নতুন উত্তেজনা— কী আমাদের পরিচয়? আমরা বাঙালি? আমরা মুসলিম? আমরা পাকিস্তানি? সবার আগেই আঘাত আসে এই ভূখণ্ডের মানুষের মুখের ভাষার ওপর। বাংলা ভাষার প্রথিতযশা একজন কবি হিসেবে সুফিয়া কামালও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫৬ সালে শিশুদের জন্য কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। দাবি তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলটিকে বাংলার মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নামে নামকরণ করার।
১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রসঙ্গীত বন্ধের প্রতিবাদ হোক, আর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান— সবখানেই তার উপস্থিতি ছিল সাবলীল ও সরব। পাকিস্তান সরকার তাকে তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক দিয়েছিল। সে পদকও বর্জন করেন তিনি। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেও তিনি ছিলেন, ৯০-এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও ছিলেন তিনি। যতদিন বেঁচেছিলেন দেশের জন্য কাজ করে গিয়েছে। তার উত্তরাধিকারদের জন্য তৈরি করে যেতে চেষ্টা করেছেন একটি সুন্দর পৃথিবী।
সুফিয়া কামালের সংগ্রামমুখর বর্ণিল জীবনের অবসান ঘটে ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর। স্বাভাবিক মৃত্যু, আড়ম্বরের মৃত্যু। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নারী হিসেবে তিনি এই সম্মান পেয়েছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তার অগ্রজের সম্পদকে সমৃদ্ধই করে গিয়েছেন।
আজ আমরা যারা তার উত্তরাধিকারী, আমাদের ওপর দায়িত্ব এ উত্তরাধিকারকে সমৃদ্ধ করার। তিনি যেমন আজীবন লড়াই করে গেছেন অনুজদের কাছে তার সময়ের চেয়ে সুন্দর একটি পৃথিবী রেখে যাওয়ার, ঠিক সেই দায়িত্ব এখন আমাদের কাঁধেই। সুফিয়া কামাল যেমন তার পূর্বসূরীদের কাছ থেকে পাওয়া সম্পদকে সমৃদ্ধ করে গেছেন, তার উত্তরসূরী হিসেবে তার কাছে পাওয়া সম্পদকে আরো সমৃদ্ধ করে রেখে যাওয়ার দায়িত্ব এখন আমাদের।
জন্মদিনে কবির প্রতি সারাবাংলা পরিবারের পক্ষ থেকে রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
সারাবাংলা/এমএ/টিআর