শুভ জামাইষষ্ঠী
২০ জুন ২০১৮ ২১:১০
।। ফারুক ওয়াহিদ ।।
বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বণের একটি হলো জামাইষষ্ঠী অনুষ্ঠান। বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচলিত মধু মাস তথা জ্যৈষ্ঠের শুক্লা ষষ্ঠীতে মেয়ের জামাইকে নিমন্ত্রণ করে ভালো উপঢৌকন দিয়ে আশীর্বাদ করার অনুষ্ঠানকে জামাইষষ্ঠী বা জামাই দিবস বলা হয়। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসামের ঈশানবাংলা, ত্রিপুরা তথা গোটা বাংলা এবং প্রবাসসহ বিশ্বের সব বাঙালিদের মধ্যেই এই দিনটি পালনের রীতি রয়েছে।
পবিত্র ধর্ম যার যার, তবে উৎসব কি সবার হতে পারে না? বিশেষ করে সংস্কৃতিমনা বাঙালিদের? জামাইষষ্ঠী কোনো ধর্মীয় উৎসব নয়। তাই সার্বজনীন এই অনুষ্ঠানটি বাঙালিমাত্রই পালন করতে পারে, সে যে ধর্মের লোকই হোক না কেন। তবে মনে রাখতে হবে, জামাইকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানটি বাঙালিদের একটি নিজস্ব অনুষ্ঠান।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কত দিবসই তো পালন করা হয়। কিন্তু জামাইকে ঘিরে কোনো দিবসের আয়োজন কেবল বাঙালিরাই করে থাকে। তাই আমরা কি পারি না বাঙালিদের একান্ত এই দিবসটিকে ‘বিশ্ব জামাই দিবস’ হিসেবে পালন করার জন্য সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে!
জামাইষষ্ঠীর দিনটিতে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন শাশুড়ি। মেয়ের জামাইকে আপ্যায়নের জন্য সকাল সকালই ঢুকে পড়েন রান্নাঘরে। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়েন হরেক পদের খাবার তৈরিতে। বিশেষ করে জামাইয়ের জন্য সেদিন রান্না হয় পঞ্চব্যঞ্জন, সাথে মুগের ডালের মুড়িঘণ্ট। আরো থাকে পদ্মার ইলিশ, পাবদা, চিতল, গলদা চিংড়ি, খাসির মাংস আর দৈ-চিড়া-মুড়ি-খৈ-মিষ্টান্ন। মধু মাসের ফল আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, আনারস, পেয়ারা, জামরুল তো রয়েছেই। ইদানীং মধু মাসের ফল-ফলাদির সাথে পদ্মার রূপালি ইলিশ দিয়েও জামাইকে আপ্যায়ন করা শুরু হয়েছে। পদ্মার ইলিশ না হলে যে জামাই আপ্যায়নটাই মনে হয় অসম্পূর্ণ রয়ে গেল!
জামাই নতুন হোক বা পুরাতন— শ্বশুরবাড়িতে তার কদর সবসময় আলাদা। আর জামাই যেন পুরনোই হয় না। সেই ভাগ্যবান জামাইদের জন্য আজকের দিনটি বিশেষ। এদিন জামাইকে শাশুড়ি ধান-দূর্বা দিয়ে বরণ করে নেন। আর নেবেনই বা না কেন, জামাইকে খুশি করতে পারলেই না নিজের মেয়েটিও সুখে থাকবে!
জামাইরাও এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকেন, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন শাশুড়ির চরণধূলিটুকু আশীর্বাদ হিসেবে মাথায় তুলে নিতে। বছরের অন্য কোনো দিন না হোক, অন্তত এই দিনটিতে সব জামাই-ই শ্বশুরবাড়িমুখী হয়ে থাকেন। এই বিশেষ উৎসবের দিনে মেয়ের বাবা-মা পরিবারসহ জামাইয়ের বাড়িতে গিয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ করে আসেন। জামাইদের জন্য সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি থাকে নানা উপহার সামগ্রী।
জামাইও তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন, বিশেষ করে শাশুড়ির জন্য তাঁতের শাড়ি বা ঢাকাই জামদানি শাড়ি, ঝুড়ি ভর্তি মধুমাসের আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, পেয়ারা, পান-সুপারি, নিজের পুকুরের বা বাজারের সেরা রুই, কাতল মাছ, পদ্মার চকচকে রূপালি ইলিশ, রসগোল্লার হাঁড়ি, ছানার সন্দেশ আনতে ভুলেন না। তাছাড়া শ্যালিকাসহ অন্যরাও বঞ্চিত হয় না জামাইয়ের উপহারের তালিকা থেকে।
নানা পদের খাবার রান্নার পর তা সাজিয়ে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে শাশুড়ি নতুন শাড়ি পড়ে সাজগোজ করে বসে পড়েন পরম মমতায় তালপাখা দিয়ে বাতাস করে জামাইকে আপ্যায়ন করতে। জামাইয়ের কাছেই ঘিরে থাকে শ্যালিকা ও বাড়ির অন্য মেয়েরা। এই পরম ঐতিহাসিক মধুর মুহূর্তে বাড়ির পুরুষদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। জামাইকে খাওয়াতে উপস্থিত থাকেন বাড়ির শুধু নারীরা।
ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল রাশিয়া ২০১৮-এর প্রভাব এবার শুভ জামাইষষ্ঠীতেও পড়েছে। জামাই আপ্যায়নে জামাইয়ের পাতে শোভা পাচ্ছে মিষ্টির বিশ্বকাপ, সে জামাই যে দলেরই সমর্থক হোক না কেন।
জামাইষষ্ঠী পালনের মধ্যে দিয়ে বাঙালিদের আত্মীয়তার বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ষষ্ঠী পূজার জন্য ৬০টি দূর্বা, করমচা ফল, আম্রপল্লব দিয়ে একটি তোড়া বানানো হয়। ষষ্ঠি পূজার পর সেই পূজার ঘটের জল ছিটিয়ে আর্শীবাদ করা হয় এবং ষষ্ঠীমাতার কাছে জামাইয়ের জন্য দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়। এদিন বাড়ির গৃহপালিত বিড়ালদের আদর বেড়ে যায়। কারণ বিড়াল হলো ষষ্ঠী দেবীর বাহন।
জ্যৈষ্ঠ তথা মধু মাসে জামাই আপ্যায়নের রীতি রয়েছে মুসলিমদের মধ্যেও। জামাইষষ্ঠীর মতো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ মেনে না হোক, জামাইকে নিমন্ত্রণ করে জ্যৈষ্ঠ মাসের আম-জাম-কাঁঠালের সাথে দুধ-দই-চিড়া-মুড়ি-খই দিয়ে আপ্যায়ন না করলে যেন তাদেরও মধু মাসের স্বাদগ্রহণ অপূর্ণ থেকে যায়। এক অর্থে তাই বলা যায়, জামাইষষ্ঠীর রীতি বাঙালির সার্বজনীন উৎসব।
বাঙালির সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে পহেলা বৈশাখ ও হালখাতা, পহেলা ফাল্গুন, নবান্ন উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি, পৌষ মেলা, জৈষ্ঠ্যের জামাইষষ্ঠী, ভাদ্র মাসের পিঠা-পার্বণ। ছয় ঋতুকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেওয়া তো রয়েছেই। সারাবিশ্বে বাঙালিই হলো সবচেয়ে উৎসবপ্রবণ জাতি। তাই বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একে বিকশিত করার দায়িত্ব আমাদেরই। স্মরণীয় হোক বাঙালির জামাইষষ্ঠী উৎসব, তথা জামাই দিবস এবং সেইসাথে মাছে-ভাতে বাঙালির সকল সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। বাঙালির জয় হোক, বাংলার জয় হোক।
লেখক: প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা