Monday 24 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মহাবিশ্বে গ্রহাণুর বিচরণ ও পৃথিবীর উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব

মো. জাহিদুল ইসলাম
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:৪৫

যেসব গ্রহ-উপগ্রহ দিয়ে সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়েছে সেসব গ্রহ-উপগ্রহের অবশিষ্ট টুকরোগুলোই হচ্ছে গ্রহাণু। যা সূর্যকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। এদের মধ্যে মাঝেমধ্যে কয়েকটা ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর কক্ষপথে ঢুকে পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়। গ্রহানু হলো সৌরজগতের অংশ, ছোট গ্রহ, পাথুরে বস্তু যা সাধারনত মঙ্গল গ্রহ ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যে অবস্থান। আনুমান করা হয় প্রায় ১৩ লক্ষ গ্রহানু রয়েছে। মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যের এই অঞ্চলকে গ্রহানু বলয় বলে। এই বলয়ের মধ্যে গ্রহের তুলনায় অনেক ছোট পাথরখণ্ড এবং ধাতু রয়েছে। এই পাথরখণ্ডগুলিকে গ্রহাণুপুঞ্জ বা ছোট গ্রহ বলা হয়। এগুলি পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনেকগুলিকে দূরবীন বা ছোট দূরবীক্ষণ যন্ত্রের (টেলিস্কোপ) মাধ্যমে দেখা যেতে পারে। সৌরজগতে সম্ভবত কয়েক লক্ষ গ্রহাণু রয়েছে। ৯৬,০০০ এরও বেশি গ্রহাণুকে সংখ্যা দিয়ে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১২,০০০ এর নাম রয়েছে। কিন্তু যদিও অনেক গ্রহাণু আছে, গ্রহাণুপুঞ্জ বলয়ের বেশিরভাগ স্থানই ফাঁকা। সৌরজগতের প্রথম ১০ কোটি বছরে গ্রহাণুপুঞ্জ বলয় তার ভরের ৯৯.৯৯% হারিয়ে ফেলেছে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিনিয়ত অসংখ্য গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করছে। মহাকাশ থেকে রোজ শত শত টন ধুলোবালি নিক্ষিপ্ত হয় পৃথিবীর দিকে। কোন কোন সময় বছরে প্রায় একবার একটা ছোট আকৃতির (উদাহরণ স্বরূপ গাড়ির আকারের) গ্রহাণু আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারলেও মেসোস্ফিয়ার স্তরে এসে পুড়ে যায়। কখনো পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে না। এদিকে আশার কথা হচ্ছে যে অধিকাংশ গ্রহাণু আকারে খুব ছোট হয়। পৃথিবীর জন্যে পর্যাপ্ত ক্ষতিকর গ্রহাণুর সংখ্যা অবশ্য কম। তাই পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনাও কম। তবে পৃথিবীতে গ্রহাণুর আঘাত হানা একেবারেই অসম্ভব নয়। কিছু কিছু গ্রহাণু দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে এক কিলোমিটারেরও কম। অনানুষ্ঠানিকভাবে ৫০ মিটার পর্যন্ত গ্রহাণুর পরিধির সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর চেয়ে ছোট যে কোন কিছু উল্কা নামে পরিচিত। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের অগ্রগতির ফলে এবং বিশেষ করে পৃথিবীর কাছাকাছি ঘুরে বেড়ানো বস্তুগুলির ক্ষেত্রে, ৫০ মিটারের চেয়ে ছোট কিছু বস্তু মাঝে মাঝে পৃথিবীর কাছ দিয়ে যেতে দেখা যায়। তবে ডাইনোসর বিলুপ্তির জন্যে দায়ী ১০-১২ কিলোমিটার পরিধির একটি গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানলে সেটা হবে ভিন্ন এক বিষয়। এমন গ্রহাণুর সংখ্যা খুব কম এবং তা কয়েক মিলিয়ন বছরে একবার পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসতে পারে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে গ্রহাণু থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য বায়ুমণ্ডল রয়েছে। এর পাশাপাশি পৃথিবীর চারপাশে সমস্ত মহাকাশের শিলাগুলোর ওপর নজর রাখার জন্য নাসাসহ আরও অনেক স্যাটেলাইট রয়েছে। তবে গ্রহাণুর বিশেষ পর্যবেক্ষণ এবং গতিবিধি লক্ষ্য পর্যবেক্ষণ ব্যতীত পৃথিবীর দিকে আগত গ্রহাণু শনাক্ত করা খুব কঠিন। এ ছাড়া, বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ডার্ট নামে নাসা একটি যান মহাকাশে পাঠায়। যা মূলত পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা কোনো গ্রহাণুকে তার গতিপথ থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবার জন্য তৈরি করা হয়েছে। গ্রহাণু সাধারণত অনিয়মিত আকারের হয়। তবে কিছু কিছু প্রায় গোলাকার গ্রহাণুর দেখা যায়। গ্রহাণুর কোন বায়ুমণ্ডল নেই। গঠনগত দিক থেকে গ্রাহানু ৩ শ্রেণীর হয়ে থাকে। যেমনঃ- প্রথমটি হচ্ছে C- Type: (Chondrite)। এদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই C- Type: (Chondrite) গ্রহাণু সাধারণত কাদা ও সিলিকেট শিলা দ্বারা তৈরি । এরা মূলত সৌরজগতের অন্যতম আদি বস্তু। দ্বিতীয়টি হচ্ছে S- Type। এই S- Type ধরনের গ্রহাণু সিলিকেট ও নিকেল-আয়রন দিয়ে গঠিত। তৃতীয় এবং সর্বশেষ M- Type ধাতব গ্রহাণু ও নিকেল-আয়রন দিয়ে গঠিত। বিভিন্ন আকারের গ্রহানু রয়েছে, ছোট যেমন মাত্র ১০ মিটার ব্যাসার্ধের আবার বড় আকারেরও গ্রহানু আছে যেমন ভেস্তা যার ব্যাসার্ধ প্রায় ৫৩০ কিমি। গ্রহানু সৌরজগতের সমসাময়িক, বয়স প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। তবে গ্রহানু পৃথিবীর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে যদি পৃথিবীতে আঘাত হানে ঠিক যেমন ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছর আগে ১০ থেকে ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের একটি গ্রহানু পৃথিবীকে আঘাত হেনেছিল। যার ফলাফল হিসেবে আস্তে আস্তে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছিল।

বিজ্ঞানীদের মতে গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে সেটি হবে পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী। কোনো একটি শহরে গ্রহাণু এসে পড়লে ধ্বংসযজ্ঞ শুধু ওই শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। পুরো গ্রহেই তার মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। আর যদি একটা জায়গায় প্রভাব পড়তো তাহলে তো ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর যে স্থানে গ্রহাণু আঘাত হেনেছিল শুধু সেই স্থানের ডাইনোসরগুলো মারা যেত। ডাইনোসরগুলো পুরো পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতো না। অন্য জায়গার ডাইনোসরগুলো বেঁচে থাকতো। এদিকে পৃথিবীর সাথে গ্রহাণুর সংঘর্ষের ফলে যদি কোথাও বড় ধরনের আগুন লেগে যায়, কিম্বা একটা বিশাল গর্ত তৈরি হয় এবং সেখান থেকে যদি সব ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে চলে যায়, তাহলে সারা গ্রহেই ধুলোবালি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এরকম হলে পৃথিবীর প্রাণীরা হয়তো বেঁচে থাকতে পারবে না। এরকম ধূলিঝড় বা ডাস্ট স্টর্ম মঙ্গল গ্রহে দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলে সেখানে সূর্যের আলো দেখা যায় না। নাসার পাঠানো রোভার এই ধূলিঝড় প্রত্যক্ষ করেছে। এরকম ধূলিঝড় বা ডাস্ট স্টর্ম মঙ্গল গ্রহে দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলে সেখানে সূর্যের আলো দেখা যায় না। নাসার পাঠানো রোভার এই ধূলিঝড় প্রত্যক্ষ করেছে। গ্রহানুর অবস্থানের উপর ভিত্তি করে গ্রহানুকে তিনটি ভাগে বিভিক্ত করা হয়। এদের মধ্যে প্রধান গ্রহানু বলয় (Main Asteroid Belt) বলয়টি রয়েছে মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যে। আনুমন করা হয় ১১ লক্ষ থেকে ১৯ লক্ষ গ্রহানু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই বলয়ে। আরেকটি ট্রোজান (Trojans) এটি একটি বিশেষ এলাকা, প্রতি গ্রহের কক্ষপথের দুইটি অংশে সেই গ্রহের মহাকর্ষ বল ও সূর্যের মহাকর্ষ বল সমান, ঠিক এই কারনে ওই অংশে মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে, সেই অংশ ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্ট নামে পরিচিত। সর্বশেষটি হলো পৃথিবীর নিকটবর্তী গ্রহাণু (Near-Earth Asteroids) যা পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করে।

নাসা এই ধরনের গ্রহানুর উপর নজরদারি করে থাকে। সম্প্রতি একটি গ্রহাণুর গতিবিধির নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুবই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে ‘২০২৪ ওয়াইআর-৪’ নামের একটি গ্রহাণু। এটি ২০৩২ সালে পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। দিন দিন এ নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। শুরুতে ২০৩২ সালে গ্রহাণুটি পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে বলে ১ শতাংশ আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি নাসার বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়িয়ে ১ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে উন্নীত করেন। গ্রহাণুটির যাত্রাপথ সম্পর্কে নতুন তথ্য পাওয়ার পর এমনটিই জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি এ তথ্য নিশ্চিত করেছে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইএসএ)। বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির গতি এবং আকারের আরও নির্ভুলভাবে পরিমাপের জন্য জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে গ্রহাণুটি পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পৃথিবীকে নিরাপদ রাখতে কোনো সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন হয় কিনা এই বিষয়টির পাশাপাশি গ্রহাণুটির ছোট ছোট ঝুঁকির দিকটিও ভালোভাবে খতিয়ে দেখতেই টেলিস্কোপটি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো ‘২০২৪ ওয়াইআর-৪’ গ্রহাণু শনাক্ত করা হয়। এর পর থেকে এটি পৃথিবীর কাছাকাছি আছড়ে পড়তে পারে এমন গ্রহাণুদের ঝুঁকি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে এই গ্রহাণুর ব্যাস ৪০ থেকে ৯০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এটি ২০১৩ সালে রাশিয়ায় আঘাত হানা গ্রহাণুর আকারের মতো হতে পারে। যেই গ্রহাণুটি বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত হয়ে চেলিয়াবিনস্ক শহরে হাজার হাজার জানালার কাচ ভেঙে ফেলেছিল এবং এ ঘটনায় কয়েকশ মানুষ সামান্য আঘাত পেয়েছিল।

একটি বরফাচ্ছন্ন হ্রদে আছড়ে পড়ে এই গ্রহাণু। আছড়ে পড়ার পর এর মাত্র ১ মিটার অবশিষ্ট ছিল। তবে যদি ৯০ মিটার আকারের গ্রহাণু আঘাত হানে তাহলে তার প্রভাব অনেক বেশি হতে পারে। ১৯০৮ সালের সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কা ঘটনাটির মতো প্রভাব ফেলতে পারে। এটি লাখ লাখ গাছকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এবং প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, কয়েকজন মানুষ মারাও যান। যদি এমন আঘাত কোনো বড় শহরের ওপর হয় তবে তার ফলাফল মহাবিপর্যয়ের মতো হতে পারে।

লেখক: নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

প্রযুক্তি ফিচার মহাবিশ্বে গ্রহাণুর বিচরণ মো. জাহিদুল ইসলাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর